Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অতিথি পাখিরা কি একটু সহানুভূতি পেতে পারে না?

শীতের শুরুতেই হিমালয়ের উত্তরে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া আর তিব্বতের হিমশীতল এলাকা থেকে দলে দলে পাখি আসা শুরু হয় বাংলাদেশে। তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ায় বেঁচে থাকা আর পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর মুখ দেখাবার আকুতি নিয়ে ভবঘুরে পাখিরা পাড়ি দেয় নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশও ভবঘুরে পাখিদের এমনই একটি গন্তব্য। বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন, উপকূল, সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওর, টাংগুয়ার হাওড়, বাইক্কা বিল, ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ভোলা সহ বিভিন্ন উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা আর চরগুলো অতিথি পাখির কোলাহলে মুখরিত থাকে পাঁচ থেকে ছয় মাস। স্থানভেদে অক্টোবর থেকে পাখির পরিযান শুরু হয়। নভেম্বর আর ডিসেম্বরে অতিথি পাখির পরিযানের হার সবচেয়ে বেশি থাকে। জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রেশমি শীতের ছোঁয়া গায়ে লাগিয়ে আবারো ভবঘুরে হয় অতিথি পাখিগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে অতিথি পাখি আসার হার কমে গেছে।

টাংগুয়ার হাওরে অতিথি পাখির ঝাঁক; ছবিসূত্র: smithsonianmag.com

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি পাড়ি জমায়। তীব্র শীত থেকে বাঁচার পাশাপাশি অনেক পাখিই এখানে এসে তাদের বাচ্চা জন্ম দেয়; যেমন, ‘Pallas’s Fish Eagle’ এর কথাই ধরা যাক। এই ঈগল প্রজাতি বাংলাদেশে আসে মূলত প্রজননের খাতিরে। বসন্তের শুরুতে বাংলাদেশের তাপমাত্রা যখন একটু করে বাড়তে শুরু করে, এই ঈগল তখন ফিরে যায়, আবার শীতের শুরুতেই ফিরে আসে।

সুনামগঞ্জ জেলার জামখোলা হাওরে প্রাপ্তবয়স্ক ‘Pallas’s Fish Eagle’ (Haliaeetus leucoryphus) এবং এর বাসা (Haliaeetus leucoryphus), চিত্রগ্রাহক: M. S. H. SOURAV

তবে দুর্লভ এই প্রজাতির ঈগল দ্রুতই বিলুপ্ত হচ্ছে, মাছের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা এই ঈগলের প্রধান প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে জেলেরা। হাওর কিংবা জলাশয়ে বাড়ছে কচুরিপানা, সাথে সাথে ঈগলের জন্যে মাছ শিকারও কঠিন হয়ে পড়ছে। হাওরের মাছের জন্যে যুদ্ধ করে ক্লান্ত শিকারীর টান পড়েছে বাসা বাধার স্থানেও। মূলত ডিম আর বাচ্চার সুরক্ষা দিতেই বড় গাছের মগডালে বাসা বাঁধে এই ঈগল। হাওরে বড় গাছ কেটে ফেলায় বাসস্থান সংকটও বাড়ছে এদের।

ভারতের উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে ‘Pallas’s Fish Eagle’; ছবিসূত্র: Wikimedia Commons

বাংলাদেশে ঠিক কত অতিথি পাখি আসে?

আট থেকে নয় বছর আগেও বাংলাদেশে চার থেকে পাঁচ লক্ষ অতিথি পাখি আসতো। কিন্তু সেই সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। ২০১৬-১৭ সালের এক হিসেব অনুযায়ী, হাওর সহ বিভিন্ন উপকূলীয় জলাশয় এলাকায় সেই সংখ্যা মাত্র ১ লক্ষে নেমে এসেছে। তবে বাংলাদেশে অতিথি হয়ে আসা ৩০০ প্রজাতির মধ্যে মাত্র ৮০ প্রজাতি জলাভূমি দাপিয়ে বেড়ায়। বাকি ২২০ প্রজাতির বিচরণ বনাঞ্চলে। তাই অতিথি পাখি মাত্রই হাওর কিংবা জলাশয়ে থাকবে এমন ধারণাটিও সঠিক নয়।

অতিথি পাখির ঝাঁক; ছবিসূত্র: thedailystar.net

কীভাবে অতিথি পাখি গোনা হয়?

আকাশে ডানা ঝাপটে বেড়ানো এই জীবদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত না করে তাদের সংখ্যা নিরূপণ করা বেশ কঠিন কাজ। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যরা এই কঠিন কাজটিকে বেশ ভালোবাসেন। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে এই কয়েক মাস তারা ঘুরে বেড়ান জলাশয় থেকে জলাশয়ে। পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে এমন দূরত্ব থেকেই তাদের কাজ করতে হয়। পাখিদের মাথা গোনা থেকে শুরু করে ছবি তোলা, বৈজ্ঞানিক নাম সংগ্রহ করার পাশাপাশি প্রতিটি প্রজাতির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য নোট করে নেন দলের সদস্যরা। আর এভাবেই কয়েকটি জরিপের তথ্যকে গড় করে পাখির অনুকূল সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। এ তো গেলো জলার পাখিদের গোনার গল্প, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো পাখিদের সংখ্যা নিরূপণ করাও বেশ কঠিন। পাখিদেরকে কয়েক বছর ধরে লক্ষ করতে হয়। শব্দ শুনে, ডানার আকৃতি দেখে আলাদা করতে হয়।

পাখিদের পায়ে রিং পরানো হয়, প্রযুক্তির কল্যাণে অতিথি পাখিদের সাথে জুড়ে দেওয়া যায় স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার, গতিপথ নিরূপণের পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভ্যাস আর প্রজননের হাল-হকিকতের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানা যায় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

পায়ে রিং পরিহিত অতিথি পাখি; source: timesofindia.indiatimes.com

কিন্তু পাখি কমছে কেন?

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই মূলত পাখি পরিযানের জন্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। তবে বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে কানাডা, সাইবেরিয়া সহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে যাচ্ছে পাখিরা।

বিশ্বজুড়েই তৈরি হচ্ছে পাখিদের প্রতিকূল পরিবেশ; source: climatekids.nasa.gov

আর অতিথি পাখিদের দুরবস্থার তো আর সীমা নেই, পথে পথে লম্বা সব মোবাইল আর ইলেকট্রিক টাওয়ার, পাখিদের পরিযানের চিহ্নগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে পাখিদের পরিযানে সৃষ্টি হচ্ছে বাধা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলাশয়গুলো ভরাট হচ্ছে, গড়ে উঠছে মানুষের বাসস্থান আর কৃষিজমি।

বন্ধ্যাত্বের শিকার হচ্ছে পাখিরা

পৃথিবীতে মানুষ বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, অল্প জমিতে বেশি ফলনের আশায় মানুষ ব্যবহার করছে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক। কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক একদিকে যেমন পাখিদের খাদ্যসংকট তৈরি করছে, অন্যদিকে এসব ক্ষতিকারক দ্রব্য খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে। ফলে পৃথিবী জুড়ে বিপুল সংখ্যক পাখির প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আর এ পাখিরা শিকার হচ্ছে বন্ধ্যাত্বের। পরিযায়ী পাখিরা এই রাসায়নিক বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকির সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করছে। পাশাপাশি মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের ফলেও পাখিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রজননক্ষমতা হারাচ্ছে বলে গবেষকদের কাছে তথ্য রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য হারে পাখিদের প্রজননক্ষমতা কমছে;source: kval.com

বাড়ছে অবৈধভাবে পাখি শিকার

আইনের তোয়াক্কা না করেই অনেকেই অতিথি পাখি শিকার করে চলেছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের নজরদারি থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসা অতিথি পাখিদের পড়তে হয় শিকারীদের কবলে। বিশেষ করে ভোলা সহ মাঝির চর, নেয়ামতপুর চর, চর ফ্যাশন, চর কুকড়ি-মুকড়ির মতো অর্ধশতাধিক চরে দেখা যেত বালি হাঁস, লেঞ্চা বালি হাঁস, রাঙা ময়ুরি, পান্থামুখী, খঞ্জনার মতো পরিযায়ীদের

চরে বাড়ছে পাখি শিকার; source: theindependentbd.com

আইন অনুযায়ী অতিথি পাখি ধরা আর শিকার নিষিদ্ধ হলেও ভোলার বিভিন্ন এলাকায় শিকার করা হচ্ছে পাখি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শিকারীরা ধান ক্ষেতগুলোতে নানা ধরনের রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করেই পাখিদের কাবু করে। পাশাপাশি আছে জালের মাধ্যমে পাতা ফাঁদ, যেগুলোতে খুব সহজেই পাখি ধরা পড়ে।

বিষপ্রয়োগে মারা যাওয়া পাখি; ছবিসূত্র: daily-sun.com

শিকারকৃত পাখির একটি বড় অংশ বিক্রি হচ্ছে বাজারে। পাখিটিকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে কিনা এ কথা চিন্তা না করেই ৫০০-৬০০ টাকা দরে বিভিন্ন চর এলাকার বাজারে অতিথি পাখি কিনে নিচ্ছেন স্থানীয়রা। ডাক্তার আর বিষেশজ্ঞদের মতে, পাখি ধরার জন্যে যে বিষ ব্যবহৃত হচ্ছে তা মানবদেহেও বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।

অবৈধভাবে শিকারকৃত পাখি; source: thedailystar.net

অতিথি পাখির সুরক্ষায় করণীয় কী?

সারা বিশ্ব জুড়ে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে। অতিথি পাখির বাসস্থান, শিকার আর প্রজননের অনুকূল পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে আইনের ফোঁকর দিয়ে কিংবা কোস্ট গার্ডের চোখে ধুলো দিয়ে যারা অতিথি পাখি শিকার করছে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি আমাদের দেশে প্রতি বছর ঠিক কী সংখ্যক পাখি আসছে, তাদের কেউ কি বার্ড ফ্লু কিংবা অন্যান্য রোগের জীবাণু বহন করছে কিনা এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা আর রেকর্ড থাকাও জরুরি।

পাখিদেরও দরকার ডাক্তার; ছবিসূত্র: indiatimes.in

অতিথি পাখিদের সহনশীল ছোট এই পদক্ষেপগুলোই হয়তো পাখিদের এবং মানুষের জন্যে আগামী পৃথিবীকে বাসযোগ্য করবে।

ফিচার ইমেজ- Doug Worrall Photography

Related Articles