Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভয়ঙ্কর লুজান চিড়িয়াখানা: যেখানে সিংহের পিঠেও বসতে পারেন দর্শনার্থীরা!

চিড়িয়াখানা বলতে এমন এক স্থানকে বোঝায় যেখানে প্রাণীদের আবদ্ধ করে দর্শনার্থীদের দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়। চিড়িয়াখানায় বিশ্বের নানা প্রান্তের স্থানীয় প্রাণীদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আধুনিক চিড়িয়াখানা তৈরির পূর্বে, বিত্তশালী লোকেরা হাজার হাজার বছর ধরে তাদের বাসায় প্রাণীদের ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করতেন। এই সংগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতার পরিচয় দেয়া। পারিবারিকভাবে সংগ্রহে রাখার ব্যবস্থাকে বলা হতো মেনাজেরিস (Menageries)। বন্যপ্রাণীকে আবদ্ধ করে দর্শককে দেখানোর প্রক্রিয়াকে বলা হয় মেনাজেরিস। খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দে মিশর ও মেসোপটেমিয়ার শাসক এবং অভিজাতদের মধ্যে এরকম ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা তৈরির ইতিহাস রয়েছে বলে জানা যায়। সেই সময় তাদের সংগ্রহশালায় জিরাফ, হাতি, ভালুক, ডলফিন এবং নানা ধরনের পাখির দেখা মিলতো।

জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে গড়া আধুনিক চিড়িয়াখানা © লেখক

অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটতে থাকে তখন মানুষ প্রাণীদের নিয়ে নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভের চেষ্টা করে। সেই সময় প্রাণীদের আচরণ ও অঙ্গসংস্থানিক গঠনবিদ্যা লাভের জন্য মানুষ প্রাণীদের অনেকটা প্রাকৃতিক পরিবেশের ন্যায় স্থানে আবদ্ধ করে আধুনিক চিড়িয়াখানার সূচনা ঘটায়। প্রথম আধুনিক চিড়িয়াখানা তৈরি করা হয়েছিল ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুর © লেখক

বিশ্বের ভয়ঙ্কর ও সবচেয়ে সমালোচিত চিড়িয়াখানাটি সম্পর্কে জানার পূর্বে পাঠকদের সাফারী পার্কের মূল বিষয় সম্পর্কেও ধারণা নেয়া উচিত। চিড়িয়াখানার চেয়ে বড় পরিসরে তৈরি করা হয় সাফারি পার্ক, যেখানে প্রাণীরা মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে আর দর্শনার্থীরা তাদের নিজস্ব গাড়িতে অথবা পার্কের গাড়িতে চড়ে ভ্রমণ করতে পারে, অর্থাৎ এখানে দর্শনার্থীরা আবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের গাজীপুরে ও কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় সাফারী পার্ক রয়েছে।

শেখ মুজিব সাফারী পার্কের সিংহ (গাড়ির ভিতর আবদ্ধ থেকে তোলা) © লেখক

মূলকথা হলো, বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী থাকে প্রাণী। অপরদিকে সাফারী পার্কে আবদ্ধ থাকে মানুষ। কিন্তু কথা হলো যদি বন্যপ্রাণী ও মানুষ একইসাথে মিলেমিশে ঘুরতে পারে, ছবি তুলতে পারে, হিংস্র প্রাণীর পিঠে বসার সুযোগও পেয়ে থাকে তবে তাকে কি বলা যায়? আদৌ কি এমন চিড়িয়াখানা আছে? আজকে জানাবো এমনই এক ভয়ঙ্কর চিড়িয়াখানা সম্পর্কে।

আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের লুজান চিড়িয়াখানা এমনই এক চিড়িয়াখানা যেখানে বন্যপ্রাণী ও মানুষ একসাথে ঘুরতে পারে। এ কারণেই একে ভয়ঙ্কর চিড়িয়াখানার তকমা দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে সিংহের মতো হিংস্র প্রাণীর পিঠে ওঠার পরও সিংহ কেন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে না, সেই পদ্ধতির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে সমালোচিত চিড়িয়াখানার নামে স্থান পেয়েছে লুজান চিড়িয়াখানা।

সিংহের পিঠে দর্শনার্থী; Source: kn3.net

চিড়িয়াখানাটিতে প্রাণী ও মানুষের মাঝে কোনো বাধা থাকে না। সেখানে মাত্র ২৫ ডলারের মতো খরচ করে অনায়াসে সিংহ, ভালুক, চিতাবাঘ ইত্যাদির কাছে যাওয়া যায়। মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীগুলোকে খাবার খাওয়ানো যায়, আদর করা যায়। এছাড়াও অনুমতি রয়েছে প্রাণীগুলোর পিঠেও ওঠার!

সিংহের সাথে আলিঙ্গন; Source: travel and travel

কথায় বলে টাকায় বাঘের চোখও মেলে। লুজান চিড়িয়াখানায় এই কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। সেখানে অর্থ ব্যয় করে ভালুক, সিংহের খাঁচার ভিতর হাঁটা যায়। এছাড়াও বিপজ্জনক প্রাণীগুলোকে আলিঙ্গন করারও সুযোগ পাওয়া যায়।

নিজের মুখ থেকে খাবার দিচ্ছে ভালুককে; Source: SNTAT

ভয়ঙ্কর এই চিড়িয়াখানায় অনেক সাহসী দর্শনার্থীরা নিজের মুখ থেকে প্রাণীদের খাবার খাওয়ানোর মতো অবস্থাতেও দেখা যায়। মন চাইলে শুয়ে ছবি তুলতে পারবেন বাঘের সাথেও! তাছাড়া ছোট ছোট প্রাণীদের অনায়াসে কোলে তুলে নিতে পারেন দর্শনার্থীরা। এই চিড়িয়াখানার খাঁচাগুলোতে শিশুদেরও প্রবেশাধিকার রয়েছে।

৩৭ একর জমির উপর নির্মিত লুজান চিড়িয়াখানাটি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন লুজান চিড়িয়াখানায় কিছু সিংহ, একটি বানর, কিছু টাট্টু ঘোড়া এবং কিছু অন্যান্য প্রাণী ছিল। তবে বর্তমানে বাঘ, সিংহ ইত্যাদি দিয়ে চিড়িয়াখানার প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ৪০০ প্রাণী রয়েছে সেখানে।

কুকুর, সিংহ ও প্রশিক্ষণার্থী; Source: rocknrove.com

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাণী ও মানুষ পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ পায়। এভাবে কাছে আসার সুযোগ পেলেও, আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের দুর্ঘটনার কথা জানা যায়নি। তাছাড়া চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, এসব ভয়ঙ্কর প্রাণীদের কাছে যাওয়ার পূর্বে কোনো প্রকার স্বত্বত্যাগ পত্রেও স্বাক্ষর করান না। কোনো প্রকার দুর্ঘটনা না ঘটলেও সমালোচনা পিছু ছাড়েনি চিড়িয়াখানাটির। এমন কী চিড়িয়াখানাটি বন্ধ করার জন্য অনেক প্রাণী কল্যাণে নিয়োজিত সংগঠন ও সংস্থা যেমন – Animal protection charity, The Born Free Foundation ইত্যাদির পক্ষ থেকে জোর দাবী করা হয়েছিল।

তাহলে কি দর্শকের হাত হয়েই ঔষধ খায় প্রাণীগুলো! Source: awearoundtheearth.com

অনেক দর্শনার্থী ও প্রাণীদের কল্যাণে নিয়োজিতরা দাবী করেন যে, চিড়িয়াখানায় আনা প্রাণীগুলোকে ঘুমের ঔষধ প্রয়োগ করে শান্ত রাখা হয়। এছাড়াও প্রশিক্ষণের সময় নানাভাবে প্রাণীদের কষ্ট দেয়া হয় বলেও অনেকের অভিযোগ রয়েছে! জোরপূর্বক মুখে মাংস ঠেসে দেয়া, গলায় শক্ত করে শিকল বেঁধে রাখা, মুখে গরম পানি নিক্ষেপ করার মতো অমানবিক কাজেরও অভিযোগ তোলা হয়েছিল চিড়িয়াখানায় কর্মরত লোকদের উপর। তাছাড়াও সামান্য ভুলের জন্য প্রাণীগুলোকে পেটানোরও অভিযোগ ছিল অনেকের।

গলায় শক্ত করে বাঁধা শিকল; Source: kn3.net

অভিযোগ যা-ই থাকুক না কেন, লুজান চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সেগুলো মানতে নারাজ। চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপক ক্লাওডিয়ো নিয়েভা জানান, সাধারণত পেট ভরা থাকলে বন্যপ্রাণী শিকার করে না। তারা এ বিষয়টিকেই সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। তারা প্রাণীগুলোকে কখনও ক্ষুধার্ত রাখেন না। পর্যাপ্ত খাবার ও আদর-যত্নে বড় করে তোলেন। তারা এমন সব প্রাণীদের চিড়িয়াখানায় স্থান দেন যারা বন্য পরিবেশে ভাল ছিল না কিংবা যে প্রাণীগুলোকে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো আবার চিড়িয়াখানায় যত্নে না রাখলে হয়তো বাঁচতো না। এছাড়াও প্রাণীগুলোকে কুকুরের সাথে রাখেন। কুকুরের সাথে রাখার ফলে সেগুলো কুকুরের মতো মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। নিয়েভা ঔষধ প্রয়োগে প্রাণীগুলোকে অনুত্তেজিত রাখার অভিযোগের বিষয়ে বলেন, বন্যপ্রাণীকে বারবার ঔষধ প্রয়োগে অনুত্তেজিত করলে সেগুলো মারা যাবে। নিয়েভার এই কথাটির সাথে কিন্তু প্রাণীবিদরা ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন না।

গলায় শক্ত শিকল বাঁধা! Source: kn3.net

বন্যপ্রাণীদের আচরণবিধি  সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য নয়। এমন কী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রাণী প্রশিক্ষণ প্রদানকারীরাও অনেক সময় বুঝতে ব্যর্থ হন। এ কারণেই বন্যপ্রাণীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সময় নিহত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। কাজেই সাধারণ মানুষের জন্য চিড়িয়াখানাটি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে একটু কল্পনা করুন। তাছাড়াও আর্জেন্টিনার আইন অনুযায়ী সাধারণ জনগণ সরাসরি এসব বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে যেতে পারেন না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও চিড়িয়াখানাটিকে অবৈধই বলা যায়।

প্রশিক্ষণকালীন বন্যপ্রাণী আক্রমণ করতে কতক্ষণ (লুজান নয়)? ‍Source: Youtube

প্রাণী অধিকারে নিয়োজিত কর্মীরা ২০১৪ সালের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লুজান চিড়িয়াখানাটি বন্ধের জন্য জোরালো তৎপরতা চালান। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে নানা ধরনের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ আর্জেন্টিনা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠান। ফলে সেই সময়ে সরকার একটি তদন্ত কমিটি পাঠায়। অতঃপর সরকার গঠিত কমিটি, চিড়িয়াখানাটির ভয়াবহতা তথা যে কোনো সময়েই বিপদ ঘটার আশঙ্কা আমলে নিয়ে তা বন্ধের নির্দেশ প্রদান করেছিল। সরকারিভাবে বন্ধের নির্দেশ প্রদান ও আর্জেন্টিনার আইনানুযায়ী অবৈধ হলেও, এখনও সক্রিয় রয়েছে চিড়িয়াখানাটির ওয়েবসাইট। সেখানে দর্শনার্থীদের চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সময়সহ বিভিন্নভাবে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে।

ফিচার ইমেজ – thefivefoottraveler.com

Related Articles