Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বৈদ্যুতিক ঈল: বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে যে মাছ

জীবজগৎ বড়ই বিচিত্র। এখানে নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে এমনই একটি বিচিত্র প্রাণী হচ্ছে বৈদ্যুতিক ঈল। এটি একধরনের বৈদ্যুতিক মাছ, যারা ৬.৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা ও ২০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে। মাছটিকে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদী ও অরিনোকো নদীর অববাহিকায় পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Electrophorus electricus। মাছটি শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে বলেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। আজকের লেখায় বিচিত্র প্রাণী বৈদ্যুতিক ঈল সম্পর্কে কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করবো।

বৈদ্যুতিক ঈল; Source: fthmb.tqn.com

ইংরেজিতে ঈল বা বানমাছের সাথে মেলানো হলেও প্রকৃতপক্ষে মাছটি ছুরি মাছের প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত এবং দেখতে অনেকটা মাগুর জাতীয় মাছের ন্যায়। এই মাছ নিয়ে বিজ্ঞানী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের আগ্রহের শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা একে কোন শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করবেন তা নিয়ে বরাবরই দ্বিধায় থাকতেন। তাই বহুবার এর শ্রেণীবিন্যাস পরিবর্তন করেছেন। অবশেষে একে Electrophorus গণের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।

ঘোলা পানিতে বৈদ্যুতিক ঈল © Dave Lonsdale

বৈদ্যুতিক ঈল নিশাচর প্রাণী। এটি নদী, জলস্রোত, জলাশয় এবং নিমজ্জ্বিত জলজ এলাকার তলদেশে কর্দমাক্ত স্থানে থাকতে পছন্দ করে। যদিও মাছটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব তেমন নেই, তথাপি বহু বছর ধরে এটিকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। বাচ্চা ঈলের বৈদ্যুতিক ক্ষমতা কম থাকায়, অ্যামাজন এলাকার স্থানীয় লোকেরা ছোট ঈল মাছকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। তবে পূর্ণাঙ্গ ঈলের মৃত্যুর প্রায় ৮ ঘন্টা পর পর্যন্ত শরীর থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় খাবার হিসেবে ঈল মাছকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এরা জলজ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

গবেষণায় লাফিয়ে উঠে শক দেয়ার চেষ্টারত ঈল; Source: independent.co.uk

ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও লেখক কেনেথ ক্যাটানিয়ার সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, জলের তলদেশে থাকলেও শিকারের জন্য বৈদ্যুতিক ঈল পানির উপরও লাফিয়ে ওঠে। তিনি লক্ষ্য করেন, ঈল ধরার জন্য ব্যবহৃত জালের সাথে লাগানো ধাতব লাঠিতে লাফ দিয়ে উঠে উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক শক দেয় মাছটি!

সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে এদের খুবই অদ্ভুত একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে পুরুষ ঈল থুথু বা লালা দিয়ে ফেনাযুক্ত বাসা নির্মাণ করে। এই বাসায় স্ত্রী ঈল হাজার হাজার ডিম পাড়ে। সঠিকভাবে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ডিমের হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। অসংখ্য ডিমের মধ্য থেকে গড়ে ১,২০০টি বাচ্চা বৈদ্যুতিক ঈলের জন্ম হয়। উভয়েই বাচ্চাকে রক্ষার জন্য নিয়োজিত থাকে। বাচ্চাগুলো ৪-৬ ইঞ্চি লম্বা না হওয়া পর্যন্ত পিতা-মাতা নজরে রাখে।

বৈদ্যুতিক ঈল মুখ দিয়ে বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। শতকরা ৮০ ভাগ অক্সিজেন এরা বাতাস থেকে নেয়। যদিও এদের ফুলকা আছে তথাপি অক্সিজেন গ্রহণের জন্য প্রধানত মুখের উপরই নির্ভরশীল। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে এরা ফুলকা ব্যবহার করে পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে না।

কর্দমাক্ত পানিতে বাস করলেও বৈদ্যুতিক ইলের দৃষ্টিশক্তি প্রখর নয়। তবে এরা তৈরিকৃত বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রটিকে রাডারের মতো ব্যবহার করতে পারে। এজন্য প্রথমে শিকার করার জন্য প্রাণীকে বৈদ্যুতিক শক দেয়। পরে বৈদ্যুতিক শকের স্থান সনাক্ত করে ও শিকার খুঁজে নেয়। কর্দমাক্ত পানিতে তারা ক্রমাগত ১০ ভোল্ট পরিমাণ চার্জ প্রদান করে উভচর প্রাণী, মাছ এবং পাখিকে শনাক্ত করে।

শরীর বাঁকা করে ভোল্ট বৃদ্ধি করছে; Source: sciencemag.org

শিকারের আকার-আকৃতি ও শক্তি বিবেচনায় ঈল নিজেদের শরীর বাঁকা করে মাথা ও লেজ কাছাকাছি নিয়ে আসে। ঈলের মাথা ধনাত্মক ও লেজ ঋণাত্মক প্রান্তের কাজ করে। তাই অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার উদ্দেশ্যে ঈল এমনটি করে থাকে। এরপর ক্রমাগত ইলেকট্রিক শক দিতে থাকে। এতে শিকারের পেশী দ্রুত অবসন্ন হয়ে আসে। শিকারের দেহ নিস্তেজ হওয়ার পর ঈল দ্রুত তাকে গিলে ফেলে।

একটি পূর্ণবয়স্ক বৈদ্যুতিক ঈল মাত্র ২ মিলিসেকেন্ডে ৬০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে, যা আমাদের বাসা-বাড়িতে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় প্রাপ্ত ভোল্টের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি। সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতেও এরা কয়েক’শ থেকে কয়েক হাজার পেশী কোষ ব্যবহার করে। জানা যায়, ৬০০-৮৬০ ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে ৬ ফুট লম্বা ঈল ৬ হাজার পেশী কোষকে ব্যবহার করে।

বৈদ্যুতিক ঈল উৎপন্ন বিদ্যুতের সাহায্যে কুমিরকেও নিস্তেজ করতে পারে বলে ব্রাজিলের একজন কৃষক জানিয়েছিলেন। এছাড়াও ক্রমাগত বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে এরা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকেও মেরে ফেলতে পারবে! তবে ঈল নিজে বৈদ্যুতিক শক পায় কিনা এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। অনেকের মতে, শক পেলেও তা খুবই কম। হয়তো এদের ত্বকে বিদ্যুতরোধী ব্যবস্থা রয়েছে।

বৈদ্যুতিক ঈল সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য জানার পর নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার কৌশলটাও জানার ইচ্ছা হচ্ছে। এখন জানাচ্ছি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল।

বৈদ্যুতিক ঈলের অঙ্গসংস্থান; Source: thescienceof.org

বৈদ্যুতিক ঈলের পেটে তিন জোড়া বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী অঙ্গ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান অঙ্গ হচ্ছে হান্টার’স (Hunter’s) এবং স্যাচ’স (Sachs’) অঙ্গ। স্যাচ’স অঙ্গের চেয়ে হান্টার’স বা শিকারী অঙ্গ থেকে অধিক বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। আলাদাভাবে হান্টার’স অঙ্গ ৬৫০ ভোল্ট ও স্যাচ’স অঙ্গ মাত্র ১০ ভোল্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। এই ১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ যোগাযোগের জন্য, প্রজননের জন্য বিপরীত লিঙ্গকে খুঁজতে ও শিকার সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়। এই অঙ্গগুলো হাজার হাজার ইলেকট্রিক সেল বা বৈদ্যুতিক কোষ দিয়ে তৈরি। প্রতিটি কোষ ০.১৫ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। কোষগুলো একটির সাথে আরেকটি শ্রেণী সংযোগে যুক্ত থাকে। কোষগুলো থেকে এরা টানা এক ঘন্টা পর্যন্ত বিরতিহীন বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম।

মাথার দিক থেকে এভাবেই জলে ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ (ডায়াগ্রাম) © Kwasi Agyenim Boateng

ঈলের বৈদ্যুতিক কোষগুলো সারিবদ্ধভাবে স্তুপাকারে বিন্যস্ত থাকে। কোষের সারিগুলোর মাঝে রোধক থাকে। প্রতিটি স্তূপ আলাদা আলাদা ব্যাটারির ন্যায় কাজ করে। আলাদা আলাদা কোষের স্তুপ একত্রে সক্রিয় হয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।

ঈলের বৈদ্যুতিক কোষের একটি প্রান্ত মসৃণ ও অপর প্রান্তটি অমসৃণ বা ভাঁজ ভাঁজ থাকে। যখন স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে কোষে সংকেত পৌঁছায় তখন মসৃণ প্রান্তে থাকা বিশেষ ধরনের ছিদ্রগুলো খুলে যায়। ফলে ধনাত্মক আয়ন দ্রুত কোষের ভিতর প্রবেশ করে। তখন ক্ষণস্থায়ীভাবে ০.০৬৫ ভোল্ট আধান উৎপন্ন হয়। এরপর কোষের ভিতর ঋণাত্মক ও বাইরে ধনাত্মক আধান থাকায় অমসৃণ প্রান্তে ক্ষণস্থায়ীভাবে ০.০৮৫ ভোল্টের পার্থক্য সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে মসৃণ প্রান্তেও ০.০৬৫ ভোল্ট আধান উৎপন্ন হয়। এভাবে প্রতিটি কোষের মসৃণ ও অমসৃণ প্রান্ত মিলে ০.১৫ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।

পরিষ্কার পানির বিদ্যুৎ পরিবাহিতা খুবই কম। তাই বৈদ্যুতিক ঈল যেখানে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করবে সেখানকার পানিতে লবণ ও অন্যান্য খনিজ উপাদান থাকতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ঈল মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ুর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক কোষগুলোতে সংকেত প্রেরণ করে। তখন মাছের মাথার দিক থেকে পানির মাধ্যমে লেজের দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ সময়ে মাছের চারদিকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের নিকট কোনো প্রাণী থাকলে, তা শক্তিশালী শকের মাধ্যমে অচেতন হয়ে যায়। এভাবেই শিকার ধরা, খাদ্য অনুসন্ধান, যোগাযোগ ও আত্মরক্ষার কাজে আশ্চর্যজনকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বৈদ্যুতিক ঈল।

ফিচার ইমেজ – nationalgeographic.com

Related Articles