Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানুষের ত্বকে বসবাসকারী ৫টি বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া

বিশ্বের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে অনেক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে হাত ধোয়ার পর হাতের দিকে ভালো করে খেয়াল করুন। কিছু দেখা যায় কি? যা দেখা যায় তা হচ্ছে হাতের পরিষ্কার, ‘জীবাণুমুক্ত’ তালু। নাহ্‌, তথ্যটি সঠিক নয়। হাতের তালু পরিষ্কার ঠিকই হয়, জীবাণুমুক্ত হয় না। একই কথা প্রযোজ্য পুরো দেহের জন্যই। যত ভালো সাবানই ব্যবহার করুন না কেন, আপনার পুরো দেহে ত্বকজুড়ে লক্ষ-কোটি জীবাণু থাকবেই! নির্দিষ্ট করে বললে, ব্যাকটেরিয়া। মানবদেহে যত সংখ্যক কোষ রয়েছে, তার দশগুণ রয়েছে ব্যাকটেরিয়া! অর্থাৎ প্রতিটি মানবদেহই একেকটি ব্যাকটেরিয়াল কলোনি! তবে ভয় পাবার কিছু নেই, এই কলোনির প্রায় সব ব্যাকটেরিয়াই হয় দেহের জন্য উপকারী, নাহয় উপকারী কিংবা অপকারী কোনোটাই নয়।

ব্যাকটেরিয়া; source: the-gist.org

ত্বকে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া মূলত ত্বকীয় পরিবেশ বা অঞ্চলের উপর নির্ভর করে। জীববিজ্ঞানীরা তিনটি ত্বকীয় পরিবেশ চিহ্নিত করেছেন, যেখানে প্রধানত তিন প্রকারের ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। প্রথম অঞ্চলটি হচ্ছে সেবাসিয়াস বা তৈলাক্ত পরিবেশ, যেমন- মাথা, গলা, স্কন্ধ, মুখমণ্ডল ইত্যাদি। দ্বিতীয় অঞ্চলটি হচ্ছে আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের অঞ্চল, যা মানুষের কনুইয়ের ভাঁজ, আঙ্গুলের ফাঁকে অবস্থিত। আর সবশেষে রয়েছে শুষ্ক পরিবেশ, যেমন- হাত ও পায়ের উন্মুক্ত বৃহৎ উপরিতল। তৈলাক্ত পরিবেশে মূলত বসবাস করে ‘প্রোপিয়নিব্যাকটেরিয়াম’ গণের ব্যাকটেরিয়া। ‘করিনেব্যাকটেরিয়াম’ গণের ব্যাকটেরিয়া প্রধানত বাস করে আর্দ্র অঞ্চলে। ‘স্টেফাইলোকক্কাস’ গণের ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে শুষ্ক অঞ্চলে। তবে পুরো দেহেই এরা কমবেশি বসবাস করে। এরকম পাঁচটি ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে জেনে নিই চলুন, যেগুলো আমাদের ত্বকে বৃহৎ পরিমাণে বসবাস করছে।

১) প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেস

প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেস আমাদের দেহের তৈলাক্ত ত্বকীয় অঞ্চলে বেড়ে ওঠে। চুলের ফলিকলও এই ব্যাকটেরিয়ার বসবাসের অন্যতম প্রিয় স্থান। মুখমণ্ডলে ব্রণ তৈরি করতে ওস্তাদ এই ব্যাকটেরিয়া তৈলাক্ত পরিবেশে দ্রুত বেড়ে ওঠে। বাসস্থানে যত তেল, এদের বংশবৃদ্ধিও হয় তত বেশি। যখন কোনো কারণে ত্বকে অতি মাত্রায় তেল উৎপন্ন হয়, তখন প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেস অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করে। ফলে লোমকূপগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় ব্রণের। অন্যদিকে প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেসকে একটি সুযোগসন্ধানী ব্যাকটেরিয়াও বলা হয়, যা অস্ত্রোপচারের সময় বা পরে বিভিন্ন সার্জিক্যাল যন্ত্রের সাথে দেহে প্রবেশ করতে সক্ষম। অনেক সময় এই ব্যাকটেরিয়া প্রস্টেট গ্রন্থিতে সংক্রমিত হয় এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহ থেকে ক্যানসারও হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এরকম ঘটনা অত্যন্ত বিরল। সার্বিকভাবে এই ব্যাকটেরিয়া নিরীহ প্রজাতির।

প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম; source: ighttherapyoptions.com

আমাদের ত্বকের সেবাসিয়াস গ্রন্থি সেবাম নামক একপ্রকার তৈলাক্ত তরল ক্ষরণ করে। এই সেবাম হচ্ছে ফ্যাট, কোলেস্টেরল এবং আরো কিছু পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার লিপিড। প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেসের জন্য এই লিপিড অত্যন্ত উপাদেয় বস্তু, যা একে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। তবে সেবামের পরিমিত ক্ষরণ আমাদের ত্বককে নানা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে এবং চুল পড়া রোধ করে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন কোনো কারণে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরণ হয়। অনেকসময় লোমকূপ বন্ধ হয়ে গেলে সে স্থানে ছুটে আসে অসংখ্য শ্বেত রক্তকণিকা, যা প্রদাহের সৃষ্টি করে। তাই ত্বকে বেশি তেল যেন জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। আবার অতিরিক্ত সাবান বা ফেসওয়াশ ব্যবহারে ত্বকে সেবামের পরিমাণ কমে গেলেও আবার হিতে বিপরীত হতে পারে।

২) কোরিনেব্যাকটেরিয়াম

কোরিনেব্যাকটেরিয়াম গণের ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে প্যাথোজেনিক এবং ননপ্যাথজেনিক উভয় প্রকার ব্যাকটেরিয়াই রয়েছে। এগুলো সাধারণত রড আকৃতির হয়। কোরিনেব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরিয়া একটি প্যাথোজেনিক বা সংক্রামক প্রজাতি। এটি এমন একপ্রকার টক্সিন ক্ষরণ করে, যা ডিপথেরিয়া রোগ সৃষ্টি করে। ডিপথেরিয়া হলে গলা এবং নাকের মিউকাস মেমব্রেন আক্রান্ত হয়। ত্বকের ছোটখাট ক্ষত নিয়ে আমরা প্রায়ই মাথা ঘামাই না। কিন্তু এসব ক্ষত কোরিনেব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরিয়ার বেড়ে ওঠার জন্য আদর্শ জায়গা। সামান্য সচেতনতার অভাবে তাই হতে পারে ডিপথেরিয়ার মতো জটিল রোগ, যা চূড়ান্ত অবস্থায় রোগীর হৃদযন্ত্র, কিডনি এবং স্নায়ুতন্ত্রের সমূহ ক্ষতি করতে সক্ষম। আবার নন-ডিপথেরিয়াল কোরিনেব্যাকটেরিয়ামও অনেক সময় সংক্রামক হতে দেখা যায়। বিশেষ করে যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, তারা খুব সহজেই কোরিনেব্যাকটেরিয়ামের সাধারণ প্রজাতি দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে।

কোরিনেব্যাকটেরিয়া; source: Wikimedia

কোরিনেব্যাকটেরিয়াম গণের অসংক্রামক প্রজাতিগুলো শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অ্যামিনো অ্যাসিড, নিউক্লিওটাইড, হাইড্রোকার্বন, এনজাইম, স্টেরয়েড সহ আরো অনেক জৈব উপাদান তৈরিতে এই গণের ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। কোরিনেব্যাকটেরিয়াম গণের সবচেয়ে পরিচিত অসংক্রামক প্রজাতি হচ্ছে কোরিনেব্যাকটেরিয়াম গ্লুটামিকাম, যা খাদ্যশিল্পে একটি মূল্যবান ব্যাকটেরিয়া। এর দ্বারা গ্লুটামিক অ্যাসিড উৎপাদন করা হয়, যা থেকে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট তৈরি হয়। এই গ্লুটামেটের সাহায্যে সয়াসস, ইয়োগার্ট সহ আরো অনেক খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতি বছর এই ব্যাকটেরিয়া থেকে বিশ্বে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন টন গ্লুটামিক অ্যাসিড উৎপাদিত হচ্ছে। তাছাড়া এই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আমাদের ত্বকের জন্যও বেশ স্বাস্থ্যকর।

৩) স্টেফাইলোকক্কাস এপিডার্মিডিস

স্টেফাইলোকক্কাস ভাইরাসগুলো দেহের চারদিকে একপ্রকার মোটা ‘বায়োফিল্ম’ বা প্রতিবন্ধক আবরণ তৈরি করে, যার সাহায্যে এই ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত শুষ্ক ত্বকেও আটকে থাকতে পারে। তবে বায়োফিল্মের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াকে সকল প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক, ক্ষতিকর পদার্থ ও রাসায়নিক এবং প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করা। এই প্রজাতির মধ্যে স্টেফাইলোকক্কাস এপিডার্মিডিস মূলত দেহের ভেতরে ‘সার্জিক্যাল ইমপ্লান্টেশন’ এর মাধ্যমে প্রোথিত মেডিক্যাল যন্ত্রাংশের মধ্যে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। ক্যাথেটার, প্রোস্থেসিস, পেসমেকার, কৃত্রিম ভাল্ব ইত্যাদি যন্ত্রাংশে এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। যদিও এই আক্রমণ একজন সুস্থ মানুষের দেহে হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তথাপি ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাকটেরিয়া ক্রমেই অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল হয়ে উঠছে!

স্টেফাইলোকক্কাস; source: ecop.pbworks.com

স্টেফাইলোকক্কাস এপিডার্মিডিসের প্লাস্টিক জাতীয় বস্তুতে বসতি গড়ার ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। কারণ এর কোষ প্রাচীর থেকে ‘পলিস্যাকারাইড ইন্টারসেলুলার অ্যাডহেশন’ বা ‘পিআইএ’ নামক একপ্রকার রাসায়নিক ক্ষরণ হয়। এই পিআইএ’র জন্য স্টেফাইলোকক্কাস এপিডার্মিডিস আরো অধিক সুরক্ষিত হয়। কারণ পলিস্যাকারাইড ব্যাকটেরিয়ার তৈরি বায়োফিল্মের উপর আরো একাধিক স্তরের বায়োফিল্ম তৈরি করে। ফলে যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিকই খুব সহজে এদের দমন করতে পারে না। ইতোমধ্যে এরা পেনিসিলিন, এমোক্সিসিলিন এবং মেথিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল হয়ে উঠেছে।

৪) স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস

স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস; source: microbiologiaitalia.it

স্টেফাইলোকক্কাস গণের ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে মানবদেহে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস। ত্বক ছাড়াও এদের বসবাস রয়েছে নাসারন্ধ্র এবং শ্বসনযন্ত্রেও। স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াসের আবার কয়েকটি উপপ্রজাতি রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি নিরীহ এবং কয়েকটি প্রজাতি ক্ষতিকর। বিশেষ করে ‘মেথিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস’ বা ‘এমআরএসএ’ দেহে জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া অধিকাংশ সময়ই হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত হয়। এদের কোষ প্রাচীরে রয়েছে একপ্রকার ‘সেল অ্যাডহেশন মলিকিউলস’ বা কোষ আসক্তি অণু, যা এদেরকে সহজেই যেকোনো তলে আটকে যেতে সহায়তা করে। বিশেষ করে বিভিন্ন মেডিক্যাল যন্ত্রাংশে স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে এবং ফিনাইল বা অন্যান্য রাসায়নিক দিয়ে পরিষ্কার করলেও অনেক সময় থেকে যায়। এমআরএসএ যদি একবার দেহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে তাহলে এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাকটেরিয়া কোনোপ্রকার শারীরিক সম্পর্ক বা কাটাছেঁড়া ছাড়া দেহে প্রবেশ করতে পারে না। তাই ত্বকের ছোট বড় যেকোনো ক্ষতকে অবহেলা না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

৫) স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস

স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস; source: medscape.com

শতকরা ৯৫ ভাগ সময়ই স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস কোনো ক্ষতিকর ভূমিকা নেয় না। এরা সাধারণত গলা এবং আশেপাশের ত্বকীয় অঞ্চলে বসবাস করে। তবে এই নিরীহ ব্যাকটেরিয়াই সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে, যদি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ কিংবা দুর্বল হয়। ছোটখাট সংক্রমণ থেকে জীবনঘাতী সংক্রমণও সৃষ্টি করতে পারে এই ব্যাকটেরিয়া। স্ট্রেপ্টোকক্কাস ফ্যারিঞ্জাইটিস বা স্ট্রেপ থ্রোট, চর্মদল, স্কারলেট জ্বর, নেক্রোটাইজিং ফ্যাসিটিস (ফ্লেশ ইটিং ডিজিজ), পক্ষাঘাত, সেপটিসেমিয়া এবং তীব্র বাতজ্বরের মতো মারাত্মক সব রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম এই ব্যাকটেরিয়া। স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস সংক্রমিত হবার পর দেহকোষ ধ্বংস করতে শুরু করে। নির্দিষ্ট করে বললে লোহিত আর শ্বেত রক্ত কণিকা ধ্বংস করে। যে কোষে একবার স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস সংক্রমিত হয়, সেই কোষের ধ্বংস নিশ্চিত। তাই একে ‘ফ্লেশ ইটিং’ ব্যাকটেরিয়াও বলা হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এই ব্যাকটেরিয়া থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায়।

ফিচার ইমেজ: Wallpaper Cave

Related Articles