‘ঢেঁকি’ শব্দটি বললে যেমন ধান ভানার কথা মাথায় আসে, তেমনি ‘পাখি’র কথা বললেই সাথে সাথে যুক্ত হয় ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার স্বাধীনতা। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি যদি পাখি হতেন, তাহলে কী করতেন?” এর সহজাত উত্তর আসতো, “যখন খুশি তখন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতাম আকাশে।” অবশ্য কারো বাসনা যদি হয় পাখির মতো পোকামাকড় খেয়ে বেড়ানো, সেক্ষেত্রে আমার কোনো বাঁধা নেই! আমাদের শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে আকাশে উড়ে বেড়ানো এই পাখির রহস্যজট সমাধা করতে করতে। মায়ের কাছে প্রশ্ন করতাম, “পাখি কীভাবে উড়তে পারে?” এই এক প্রশ্নের তাড়না আমাদের হাজার বছর ধরে ভুগিয়েছে। একসময় মানুষ পাখির উড্ডয়ন স্বাধীনতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজেই আকাশে উড়ার চেষ্টা করা শুরু করলো।
এরপরের ইতিহাস কমবেশি আমাদের জানা। যাকগে, আমাদের আজকের আলোচনায় সেই ইতিহাস নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। এমনকি পাখির উড়তে পারার সক্ষমতা নিয়েও আগ্রহ নেই। আমাদের আজকের আলোচনা থাকবে এমন পাখিদের নিয়ে, যারা উড়তে পারে না। আকাশের দোয়েল, শালিক, কাক দেখে যেমন আমরা পাখির উড্ডয়ন ক্ষমতায় বিস্মিত হয়েছি, তেমনি হাঁস, মুরগির মতো না উড়া পাখিও আমাদের অবাক করেছে। তবে জেনে রাখা ভালো, মুরগি এবং হাঁস সামান্য দূরত্ব পর্যন্ত উড়তে পারে। কিন্তু এমন কিছু পাখির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যারা একদমই উড়তে পারে না। উড়তে না পারার অভাবটুকু পূরণ করতে তারা বেছে নিয়েছে অভিনব সব অভিযোজন।
উড়তে তাদের মানা
পাখিদের দেহের হাড় বেশ ফাঁপা এবং বায়ু দ্বারা পূর্ণ হয়। এই গুণকে কাজে লাগিয়ে এরা আকাশে উড়তে পারে। উড্ডয়ন করার ক্ষমতা পাখিদের জন্য খুব দরকারি একটি বৈশিষ্ট্য। হিংস্র শিকারি পশুর হাত থেকে বাঁচতে, আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্যত্র পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে, খাবার সন্ধানের জন্য অন্য এলাকায় গমন করার জন্য পাখির উড়ার কোনো বিকল্প নেই। পায়ে হেঁটে বড় দূরত্বের পথ পাড়ি দেওয়ার চেয়ে তা উড্ডয়নের মাধ্যমে পাড়ি দেওয়া সুবিধাজনক। এসব প্রয়োজনে পাখিরা আকাশে উড়ে বেড়ায়।
উড়তে পারার ক্ষমতা পাখির জন্য দরকারি হলেও, এর জন্য পাখির প্রচুর পরিমাণ শক্তি খরচ করতে হয়। এর ফলে উড়তে পারা পাখিদের দেহের আকার ক্ষুদ্র হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব পাখি উড়তে পারে না, তারা এই শক্তি দেহে জমা রেখে ডাঙায় বেঁচে থাকার কাজে খরচ করে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০ প্রজাতির উড়তে না পারা পাখিদের অনেকেই বৈরী পরিবেশে খাদ্য স্বল্পতার মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। উড়তে না পারা পাখিদের তালিকায় রয়েছে- পেঙ্গুইন, উটপাখি, ইমু, ওয়েকা, ক্যাসোওয়ারিস, স্টিমার হাঁস, রিয়াস, গ্রেবেস প্রভৃতি পাখি।
কীভাবে আবির্ভূত হলো উড়তে না পারা পাখিরা?
পাখিদের যদি উড়ার কোনো প্রয়োজন না থাকে, তাহলে তারা উড়বে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এমন বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু হয়ে এদের উড্ডয়নহীনতার যাত্রা। ধরা যাক, ‘এক্স’ একটি পাখি। এক্স পাখি এমন অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে তাকে কোনো শিকারি পশু আক্রমণ করে না। আশেপাশে খাদ্যের অভাব নেই। তাই সে উড়াউড়ি কমিয়ে দিলো। এভাবে কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত এক্স পাখিরা উড়লো না। এর মাধ্যমে এক্স পাখির সদস্যদের মাঝে কম উড়ার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হলো। পরবর্তী কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনে এক্স পাখির ফাঁপা হাড় ঘন হয়ে উঠলো। এদের হালকা পালকের স্থলে গজিয়ে উঠলো ভারী পালক। এদের পাখা সংকীর্ণ হয়ে গেলো। অনেকক্ষেত্রে পাখার হাড় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেলো। এরপর যেসব এক্স পাখি জন্ম নিলো, তারা তাদের কয়েক প্রজন্ম পূর্বের উড়তে পারা পাখিদের চেয়ে একদম আলাদা হয়ে উঠলো।
বিবর্তনবিদরা মনে করেন, অনেক পাখি কোনো নিরাপদ দ্বীপে প্রত্যাবর্তন করার পর তাদের উড়ার ক্ষমতা ত্যাগ করেছে। যদি দ্বীপে কোনো শিকারি পশু না থাকে এবং এর আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকে, সেক্ষেত্রে একই স্থানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দিতে পারে এসব পাখি। তবে সব পাখির আবির্ভাব একরকম নয়। উড়তে না পারা পাখিদের দেহ কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। অনেক সময় এরা আকারে বেশ বড় হতে পারে। পৃথিবীর বৃহত্তম পাখি উটপাখির কথাই ধরা যাক। এরা গড়ে প্রায় ২.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পুরুষ উটপাখির ওজন হয় প্রায় ১২০ কেজি। বিবর্তিত পাখির পক্ষে এই ভারী দেহ বহন করে উড়তে পারা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। উড়তে না পারা পাখিদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু পাখির বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে এদের সম্পর্কে ধারণা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
পেঙ্গুইন
আমাদের তালিকা শুরু হলো অ্যান্টার্কটিকার শীতল পরিবেশে বসবাস করা সাঁতার কাটা পাখি পেঙ্গুইনের মাধ্যমে। প্রায় ১৮ প্রজাতির পেঙ্গুইন রয়েছে এবং এদের কেউই উড়তে পারে না। তবে এদের পাখা রয়েছে যা সাঁতার কাটার জন্য মোক্ষম অঙ্গ হিসেবে কাজে দেয়। একটি পেঙ্গুইন তার জীবনের বড় একটা সময় সাঁতার কেটে কাটিয়ে দেয়।
অ্যান্টার্কটিকা ছাড়াও এরা গ্যালাপাগোস দ্বীপ অঞ্চলে বসবাস করে। এরা লম্বায় মাত্র ৪ ফুটের মতো হয়। সরু এবং ক্ষুদ্র পায়ের সাহায্যে এরা বেশ নান্দনিকভাবে হেঁটে বেড়ায়। এরা মাছ, ক্রিল এবং স্কুইড জাতীয় প্রাণীর উপর জীবনধারণের জন্য নির্ভরশীল।
অস্ট্রিচ
শুধু উড়তে না পারা নয়, বরং সকল পাখির সর্দার ধরা হয় এই শক্তিশালী অস্ট্রিচ বা উটপাখিকে। এদের আকার, ওজন নিয়ে একটু আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এই বিশালদেহী উটপাখির ডিমও কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম (পরিধি ৫ ইঞ্চি, ওজন ৩ পাউণ্ড)। উড়তে না পারা এই পাখিদের প্রধান প্রতিরক্ষা অস্ত্র এদের পা। এই শক্ত পায়ের সাহায্যে এরা বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারে। এদের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। শত্রুর মুখোমুখি হলে এরা পায়ের সাহায্যে আঘাত করতে পারে।
উটপাখির প্রধান বাসস্থান আফ্রিকা। আফ্রিকার উন্মুক্ত ভূমিতে এরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারে। এছাড়া দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কিছু অঞ্চলে খুব অল্প সংখ্যক উটপাখি পাওয়া যায়।
ক্যাসোওয়ারিস
ক্যাসোওয়ারিস পাখি একটু দস্যি ধরনের। পাপুয়া নিউগিনি অঞ্চলে বাস করা এই পাখি তার গুণ্ডামির জন্য বিখ্যাত। এরা উড়তে না পারলেও অন্যান্য পাখিদের ভয়ে উড়িয়ে দিতে ভালোবাসে। এরা শিকারি পশু এবং শত্রুর দিকে ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ করে এবং কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে। এদের গোপন অস্ত্র হিসেবে রয়েছে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা ধারালো নখর। এই নখরের সাহায্যে এরা বড় আকারের প্রাণী, এমনকি মানুষকেও মেরে ফেলতে পারে।
এই ভয়ঙ্কর পাখি সর্বভুক বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। ফলমূল, লতাপাতার বাইরে পোকামাকড় খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। ওজন এবং আকারের বিচারে এদের অবস্থান উটপাখির ঠিক পরে। এরা স্থলে বেশ দাপটের সাথে পদচারণা করেন। যদি ডাঙায় বসেই রাজত্ব করা যায়, তাহলে আর আকাশে উড়ে বেড়ানোর প্রয়োজন কী?
কিউই
পাঁচটি ভিন্ন প্রজাতির সমন্বয়ে গঠিত কিউই পাখির জাত। দেখতে বেশ নাদুসনুদুস এই পাখির প্রধান বাসস্থল নিউজিল্যাণ্ড। এই পাখির নামের সাথে মিলিয়ে নিউজিল্যাণ্ডের স্থানীয়দের কিউই নামে ডাকা হয়ে থাকে। এদের লুকানো পাখা রয়েছে, যেখানে চুলের মতো বেশ হালকা পালক রয়েছে। কিউইদের নাসারন্ধ্রের অবস্থান এদের সরু ঠোঁটের শীর্ষে।
পর্যটকদের নিকট কিউই পাখি এক অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, এরা দেখতে বেশ আদুরে হয়ে থাকে। কিউই পাখির ডিম তুলনামূলক ছোট হলেও, দেহের বিচারে এরা সবচেয়ে বড় ডিম পাড়ার বিশ্বরেকর্ড দখলে রেখেছে।
স্টিমার হাঁস
জানা যায়, চার প্রজাতির স্টিমার হাঁসের মধ্যে তিন প্রজাতি উড়তে পারে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, চতুর্থ প্রজাতির উড়ন্ত স্টিমার হাঁসদের মধ্যে অনেক পুরুষ উড়তে পারে না। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত ওজন বা ওভারওয়েট! ল্যাটিন আমেরিকার না উড়তে পারা এই হাঁসদের নামের সাথে যুক্ত আছে জলযান স্টিমারের নাম। এর কারণ, এরা যখন পানি দিয়ে দ্রুত ছুটে যায়, তখন এরা স্টিমারের মতো পানি ছিটিয়ে দেয়।
এরা দেখতে হাঁসের মতো নিরীহ হলে বাস্তবে খুবই আগ্রাসী স্বভাবের হয়ে থাকে। নিজের জায়গা ভাগাভাগি নিয়ে এরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে মেতে উঠে। এরা লড়াইয়ে নিজের আকারের চেয়ে বড় যেকোনো পাখিকে হত্যা করতে পারে।
ওয়েকা
নিউজিল্যাণ্ডে কিউই ছাড়াও আরেকটি উড়তে না পারা পাখির বসবাস রয়েছে, যার নাম ওয়েকা। নিউজিল্যাণ্ড এদের জন্মস্থান হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এদের বাস করতে দেখা গেছে। ওয়েকা পাখির অভিনব বৈশিষ্ট্যের তালিকায় আছে এদের জোরালো ডাক। অনেক সময় এরা ঐকতানে স্ত্রী ওয়েকার সাথে অনবদ্য সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে।
উড়তে না পারা এই ওয়েকা স্বভাবে বেশ পাকা চোর। এরা অন্যের খাদ্য চুরিতে উস্তাদ। মাঝে মাঝে এরা ঘরবাড়ির ফেলে দেওয়া ছোটখাট বস্তু ঠোঁটে নিয়ে চলে আসে। এই অদ্ভুত পাখিটি প্রয়োজনে সাঁতার কাটতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এরা বেশ চৌকস সাঁতারু হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে।
ফ্লাইটল্যাস পাখিরা আমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু চার্লস ডারউইন এবং সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, একসময় এরা এক মহাদেশে বাস করতো। ভূপৃষ্ঠের বড়ধরনের পরিবর্তনের জের ধরে এরা আজ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিবর্তনের লক্ষ বছর পরে এসে বর্তমান পৃথিবীতে ভালো নেই এসব উড়তে না পারা পাখিরা। মানুষ এবং বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের খপ্পরে পড়ে আজ তারা বিলুপ্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে,ইউনেস্কো থেকে এসব পাখিকে বিপন্ন চিহ্নিত করে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের সচেতনতা এবং মুনাফালোভীদের করাল গ্রাসে পড়ে এদের সংখ্যা দিনের পর দিন কমেই চলেছে। দ্রুত কোনো জরুরি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে হয়তো আর কয়েক বছর পর এই প্রবন্ধটি শুধু ইতিহাস হিসেবে টিকে থাকবে।
This is a Bangla article about the flightless birds. These birds have interesting characteristics just to make up for the lackings of flight capabilities.
References: All references are hyperlinked.
Feature Image: Mother Nature.