আমাদের চারপাশের প্রাণিজগতে প্রতিনিয়িতই এমন সব ঘটনা ঘটে, যেগুলো সাধারণত আমাদের নজরে আসে না। মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীর ভেতরও মৃত্যু রয়েছে। তবে মানুষের ভেতর যেমন আইন-কানুন রয়েছে, মানবাধিকার রয়েছে, অন্য প্রাণীরা মানুষ নয় বলেই হয়তো তাদের মানবাধিকার নেই! তাই আকারে বড় এবং শক্তিশালী প্রাণীরা নিমেষেই ছোট প্রাণীদের খেয়ে ফেলছে।
প্রয়োজনের তাগিদে তাই এসব প্রাণীদের আত্মরক্ষার জন্য থাকে নানা কৌশল। এসব কৌশলের কিছু থাকে প্রাকৃতিক নিয়মে, আবার কিছু কৌশল তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে শিখে নেয়। যে কৌশল খাটিয়ে শত্রু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, সে কিছু মুহূর্ত নতুনভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়। তাই এসব প্রাণীর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই সংগ্রামের, খাবার সংগ্রহ করা হোক কিংবা লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য।
কে শত্রু কে বন্ধু!
প্রাণীদের আত্নরক্ষার জন্য নিজস্ব যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে, তাকে কার্যকর করার জন্য আগে তাকে শত্রু-মিত্র চিনতে হয়। আর এটি করার জন্য তারা নিজেদের শরীরের অংশগুলো ব্যবহার করে। এসব অংশের কার্যকরী ব্যবহারই পারবে কোনো প্রাণীকে শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ রাখতে।
১. চোখে দেখা
চোখ দিয়ে দেখার ব্যাপারটি প্রাণীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কেউ যদি তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে, তবে সে প্রাথমিকভাবে অন্য প্রাণীটিকে পর্যবেক্ষণ করতে চাইবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার এটাই প্রথম ধাপ। পর্যবেক্ষণের সময় গুরুত্ব পায় অপর প্রাণীর আকার, আকৃতি, গায়ের রং, হাঁটাচলার ধরন ইত্যাদি। একটি প্রাণী তার কাছাকাছি থাকার মানেই যে প্রাণীটি ক্ষতিকর, তেমন নয়। আকারে বড় হলেই যে সে আক্রমণ করবে এমনও নয়, বরং অনেক ছোট প্রাণীও তার জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হয় যেকোনো প্রাণীকে।
২. নিঃসৃত রাসায়নিক দ্রব্য
চোখে দেখার মতো প্রাণীদের শরীরের রাসায়নিক উপাদানও গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। শুধুমাত্র এসব উপাদানের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও কোনো প্রাণী সচেতন হয়ে উঠতে পারে শত্রুর ব্যাপারে। সাধারণত সব প্রাণীরই আলাদা আলাদা ঘ্রাণ থাকে, তারা যেখান দিয়ে যায় সেখানে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ তৈরি হয়। সেসব রাসায়নিক তাদের লালা, শরীর থেকে নিঃসৃত হয় এবং বাতাসে, মাটিতে, পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণীদের প্রখর ঘ্রাণশক্তির জোরেই তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী শনাক্ত করতে পারে, চোখে দেখাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না-ও হতে পারে। রাসায়নিকগুলোর উপস্থিতি থেকে প্রাণীরা বুঝতে পারে অপর প্রাণীটি তার জন্য হুমকি, নাকি সে এড়িয়ে যেতে পারে। সেই সাথে বুঝতে পারে সেই নির্দিষ্ট প্রাণীর দূরত্ব, এখানে কত সময় অবস্থান করেছিল, আকার-আকৃতি ইত্যাদি।
৩. শ্রবণ
শুনতে পাওয়ার মাধ্যমেও কোনো প্রাণী অন্যদের উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন হতে পারে। শ্রবণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আশপাশের কোনো প্রাণীর ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। শব্দের উৎস এবং তীব্রতা থেকে কোনো প্রাণীর অবস্থান, আচরণ, সংখ্যা সম্পর্কে জানা যায়। তাই শুনতে পাওয়ার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে প্রাণীদের কৌশলও নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন- টড ফিস ডলফিনের আওয়াজ চিনতে পারে সহজেই। তাদের ঝাঁক যখন ডলফিনের উপস্থিতি টের পায় শব্দ শোনার মাধ্যমে, তারা দ্রুত নিজেদের অবস্থান বদলে নেয়। সাধারণত নিশাচর প্রাণীদের শ্রবণশক্তি প্রখর হয়। তারা রাতে খাবার খু্ঁজতে এবং শিকার করতে বের হয় বলে চোখে দেখার ক্ষমতা কোনো কাজে আসে না।
৪. স্পর্শ
প্রাণীদের ভেতর অনেকেই স্পর্শ এবং কম্পনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তারা কোনো প্রাণী শনাক্ত করতে শরীর থেকে একধরনের কম্পন সৃষ্টি করে। সেই সাথে অন্য কোনো প্রাণী কম্পন তৈরি করলেও সে বুঝতে পারে। কম্পনের মাত্রা থেকে অপর প্রাণীর দূরত্ব, অবস্থান, আচরণের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু প্রাণী আছে যারা তথ্য সংগ্রহ করে অপর প্রাণীর শরীরের সংস্পর্শে এসে। যেমন- সামুদ্রিক তারামাছ যদি তার শরীরে কিছু টের পায়, তবে প্রথমেই সে সাড়া দেয় না, প্রথমে শরীরের সংস্পর্শে থাকা প্রাণীটির ব্যাপারে ধারণা নেয়। তারপরই সিদ্ধান্ত নেয় সে কী করবে।
প্রাণীদের আত্মরক্ষার কৌশল
আত্মরক্ষায় পটু কিছু ছোট প্রাণীর কথা নিয়েই আজকের আয়োজন, যারা একইসাথে আক্রমণাত্মক এবং প্রয়োজনে রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করতে পারে।
১. মৌমাছি
মৌমাছির নাম শুনলেই হুল ফোটানোর কথা মনে আসে সবার! জীবনে একবার হলেও মৌমাছির আক্রমণের শিকার হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। শুধু কি মানুষ, মৌমাছির আক্রমণের শিকার হয় অনেক বড় প্রাণীও। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মৌমাছি তখনই কাউকে আক্রমণ করে, যখন তারা মনে করে কেউ তাদের জন্য হুমকিস্বরুল। 'তারা' বলার কারণ হলো, তারা একাকী আক্রমণ করে না সাধারণত। আর করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গীসাথীরা যোগ দেয় আক্রমণে।
তাদের দেহের পেছনের অংশে বড় নলের মতো একটি অংশ থাকে, যা তারা শত্রুর শরীরে ঢুকিয়ে দেয় এবং নল দিয়ে বিষাক্ত তরল বেরিয়ে আসে। বিষাক্ত তরলের পাশাপাশি একধরনের হরমোনও নিঃসৃত করে তারা, যাতে অপর সঙ্গীরা শত্রুকে চিনে রাখে এবং আক্রমণ করতে পারে।
২. কাঁকড়া
প্রাণীজগতের ভেতর আত্মরক্ষায় পটু প্রাণিদের ভেতর কাঁকড়া অন্যতম। এদের শরীরের দুই পাশে দুটো বাঁকানো দন্ড থাকে যার খোলসটি অনেক মজবুত ও টেকসই। দন্ডটির একেবারে মুখে থাকে দু'ভাগে বিভক্ত চিমটার মতো অংশ, যেটি সত্যিকার অর্থেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে শত্রুর জন্য। পানির এই ক্ষুদে দানব তার দন্ডগুলো খাবার খুঁজতেও ব্যবহার করে। খাবার খু্ঁজতে গিয়ে যদি অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হয়, সাথে সাথে সে দন্ড দুটো উঁচিয়ে তেড়ে যায় শত্রুর দিকে এবং আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। শত্রু যদি আকারে ছোট হয় তবে সেখানেই তার মৃত্যু হতে বাধ্য। আকারে বড় শত্রুদেরও সে ছাড় দিয়ে কথা বলে না, যথেষ্ট ভোগায় এই লিটল বিস্ট!
৩. গিরগিটি
আমেরিকার টেক্সাসের মরুভূমিতে দেখা পাওয়া যায় একধরনের বাদামি রঙের গিরগিটির, যারা প্রয়োজনের সময় নিজের শরীরের রঙের বদল ঘটাতে পারে। শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের প্রথমে তারা নিজেদের শরীরের স্পাইকসদৃশ অংশ নাড়াতে থাকে, যাতে শত্রু তাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে না আসে এবং পালিয়ে যায়। এতে কাজ না হলে চোখের ভেতর থেকে একপ্রকার তরল ছুঁড়ে মারে সাপের মতো করে। এই তরল মূলত গিরগিটির শরীরের রক্ত। এই রক্তে কিছু রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা শত্রুকে বধ করতে সহায়তা করে। তবে ছুঁড়ে মারা রক্তের পরিমাণ শরীরের এক-তৃতীয়াংশ, যা মোট ওজনের দুই শতাংশ কমিয়ে দেয়।
তবে বর্তমানে প্রাণীটির স্বাভাবিক অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে দিন দিন। কারণ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে শহর ও নগরায়ণের কারণে তারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
৪. অপোসাম
স্তন্যপায়ী প্রাণীটি সাধারণত আমেরিকায় পাওয়া যায় এবং গাছে বসবাস করে। অন্য প্রাণীদের মতো এই প্রাণীটি কখনো আক্রমণ করে না। আত্মরক্ষার জন্যই তাদের যত কৌশল এবং তা বেশ মজার। কখনো যদি শত্রুর উপস্থিতি টের পায় তারা, তবে সাথে সাথে শুয়ে পড়ে এবং মৃত প্রাণীর অভিনয় করে। এই কাজে তারা এতটাই দক্ষ যে, আক্রমণ করতে আসা প্রাণীটি ধরেই নেয় সে মৃত! মৃত প্রাণী কে-ই বা খেতে চাইবে? যখন অপোসাম বুঝতে পারে সে এখন নিরাপদ, তখন আবার উঠে পড়ে; যেন কিছুই হয়নি!
৫. বৈদ্যুতিক ঈল মাছ
মূলত দক্ষিণ আমেরিকার পানিতে এই মাছ পাওয়া যায়, যেটা সত্যিকার অর্থেই ভয়ানক একটি প্রাণী শত্রুর জন্য। শিকার করা কিংবা শত্রুর মোকাবেলা, উভয় ক্ষেত্রেই তারা শরীর থেকে ভয়ানক মাত্রার বৈদ্যুতিক শক তৈরি করে। এই শকের পরিমাণ হয় ৬০০ ভোল্টের কাছাকাছি। তাদের পুরো শরীরজুড়ে প্রায় ৬,০০০ এর মতো কোষ রয়েছে, যেগুলো একেকটি ব্যাটারির মতো কাজ করে। ঈল মাছ চোখে দেখতে পায় কম। তাই পথ চিনতে তারা ১০ ভোল্ট বিভব পার্থক্যেরপ কাছাকাছি বিদ্যুৎ নির্গত করে। মানুষ সাধারণত এই মাছ দ্বারা আক্রান্ত হয় না। যদিও হয়, তবে তাদের আক্রমণ মানু্ষের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করতে পারে কিছু সময়ের জন্য।
This article is in bangla language. This is about defence system exist in animal kingdom.
References: necessary sources are hyperlinked in the article.
Featured Image: animals.sandiegozoo.org