Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হামিং বার্ড: গুনগুন গান গায় গুঞ্জন স্বরে

মনে করুন, আমাজনের গহীন অরণ্যে হাঁটছেন। লতা আর গাছের জঙ্গলের মাঝে এগুচ্ছেন ধীরে ধীরে। সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বনজুড়ে। সবুজ পাতায় সোনালি সূর্যরশ্মি দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। হঠাৎ জোরালো গুঞ্জন কানে এল। গুঞ্জনের উৎস লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল চোখ ঝলসানো এক স্বর্গীয় দৃশ্য। নানা রঙের ছোট ছোট পাখি ক্রমাগত উড়ে চলেছে বুনো অর্কিডের চারপাশে। তাদের গুনগুন শব্দ যেন বনের মাঝে তৈরি করছে অপূর্ব এক অপার্থিব জগত। এই ছোট্ট পাখিদের চেনেন সবাই, ‘হামিং বার্ড!’ হ্যাঁ, পাঠক, আজকের লেখাটি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম এই পাখিকে নিয়েই।

হামিং বার্ড; Source: Science NetLinks

হামিং বার্ড পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি হলেও, বৃহত্তম পক্ষীগোত্র ‘Trochiladae’ র অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে মরুভূমি, পর্বত, সমভূমি সব জায়গায় পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনে (Rain Forest)। আমাজনও একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট। এই খুদে পাখিরা ওড়ার সময় ঘন ঘন ডানা ঝাপটায়। অনেকগুলো পাখির সম্মিলিতভাবে ডানা ঝাপটানোর ফলে তীব্র গুঞ্জন (Hum) সৃষ্টি হয়। এজন্য এদেরকে ‘Humming Bird’ বলা হয়। পুরো পৃথিবীতে তিনশ’রও বেশি প্রজাতির হামিং বার্ড রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট হামিং বার্ড প্রজাতি হচ্ছে কিউবার ‘বি হামিং বার্ড’ এবং সবচেয়ে বড় প্রজাতি হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ‘দৈত্যাকার হামিং বার্ড’।

দৈতাকার হামিংবার্ড নাম বলেই যে খুব বড়, তা নয়। এদের ওজন মাত্র ১৮-২৪ গ্রাম। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ছোটগুলোর ওজন কত কম হবে! হামিং বার্ড সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত এদের উজ্জ্বল রঙের পালকের জন্য। বিশেষ করে এদের গলার কাছের পালকগুলোতে বিচিত্র রঙের নকশা দেখতে পাওয়া যায়।

বি হামিং বার্ড; Source: delwarenaturesociety.com

দৈত্যাকার হামিং বার্ড; Source: flickr.com

এদের গলার বিচিত্র রং কিন্তু পালকের সজ্জার কারণে হয় না; হয় আলোর পরিমাণ, আর্দ্রতা, কত ডিগ্রী কোণ থেকে দেখা হচ্ছে ইত্যাদির জন্য। হামিং বার্ডের পালকে রংধনুর সাতটি রঙই রয়েছে। এরা উড়ে যাওয়ার সময় আলোর কারসাজির কারণে এদের গলার পালকগুলোর রং বদলে যেতে পারে। এ কারণেই হামিং বার্ড নানা রকম নাম পেয়েছে। যেমন- সবুজ মুকুটওয়ালা ধুমকেতুর মতো গলার হামিং বার্ড, চুনিরঙা গলার হামিং বার্ড প্রভৃতি।

তবে বেশিরভাগ হামিং বার্ডের রংই সবুজ থেকে নীলের মধ্য হয়ে থাকে। পুরুষ হামিং বার্ড বেশি উজ্জ্বলরঙা হয়, নারী হামিং বার্ড কম। কারণ, তাদেরকে বাচ্চা ফুটানোর সময় আত্মরক্ষার জন্য আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিলিয়ে যেতে হয়।

বিস্ময়কর কিছু বৈশিষ্ট্য

১. অবিশ্বাস্য গতি

ওড়ার জন্য হামিং বার্ড বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে। এদের ওজন অস্বাভাবিক কম। যেমন- চুনিরঙা হামিং বার্ডের ওজন মাত্র তিন গ্রাম। অন্যান্য পাখির চেয়ে এদের পালকের সংখ্যাও অস্বাভাবিক কম, মাত্র ১,০০০-১,৫০০টি। আর এরা অবশ্যই আকারেও অনেক অনেক ছোট। সবচেয়ে ছোট বি হামিং বার্ড মাত্র ২.২৫ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। হামিং বার্ড হেলিকপ্টারের মতো ডান, বাম, উপর, নিচ সবদিকেই উড়তে পারে। ওড়ায় দারুণ দক্ষ এই পাখিরা আবার হাঁটতে পারে না। তাদের কি তবে পা নেই? আছে, তবে সেই পা হাঁটতে নয় বরং গা চুলকানোর মতো খুচরো কাজ করতেই ব্যবহৃত হয়। হামিং বার্ড ঘণ্টায় ত্রিশ মাইলের মতো উড়তে পারে। কখনো কখনো এর চেয়েও বেশি। এরা সেকেন্ডে প্রায় সত্তর বার ডানা ঝাপটাতে পারে!

২. অস্বাভাবিক বেশি হৃদস্পন্দন

মানুষের গড় হৃদস্পন্দন যেখানে ৬০-১০০ বিটস/মিনিট, সেখানে হামিং বার্ডের হৃদস্পন্দনের হার ১২০০ বিটস/মিনিট! মানুষের চেয়ে প্রায় ১০-২০ গুণ বেশি! প্রতি মিনিটে এরা ২৫০ বার শ্বাস নেয়, ওড়ার সময় তা আরও বেড়ে যায়।

মধু আহরণে ব্যস্ত হামিং বার্ড; Source: earth.com

৩. অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ

হামিংবার্ড আকারে ছোট হলে কী হবে, এদের খাদ্যগ্রহণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। তারা দিনে ৩.১৪ থেকে ৭.৬ ক্যালরি খাবার খায়। ভাবছেন, খুব বেশি আর কোথায়, তাই না? মানুষ প্রতিদিন ৩,৫০০ ক্যালরির বেশি খাবার খেতে পারে। কিন্তু যদি তাদের হামিং বার্ডের মতো বিপাকীয় ক্ষমতা থাকত, তাহলে তাদের খেতে হতো প্রতিদিন ১,৫৫,০০০ ক্যালরি! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। অর্থাৎ হামিং বার্ডের শরীরের তুলনায় বিপাকীয় ক্ষমতা অস্বাভাবিক বেশি। এদের অতিরিক্ত খেতে হয় কারণ, এদের হৃদস্পন্দনের হার শরীরের তুলনায় অনেক বেশি। তাই তাদের দ্রুত ক্ষুধা পায় এবং বারবার খায়। তাদের এমন কিছু খেতে হয়, যা থেকে দ্রুত শক্তি পাওয়া যাবে। তারা তাই তরল খাবারকে প্রাধান্য দেয়, ফুলের মধু প্রধানত। এ থেকে তারা প্রাকৃতিক সুক্রোজ পায়, যা ভেঙে দ্রুত গ্লুকোজে পরিণত হয় এবং শক্তি জোগায়। তবে তারা গাছের রস এবং ছোটখাটো পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে ।

আবাস

হামিং বার্ডের বসতির জন্য বিচিত্র সব জায়গা পছন্দ। কোনো কোনো প্রজাতি আন্দিজ পর্বতমালার সুউচ্চ কোনো চূড়ায় তুষারপাত আর কনকনে শীতের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। অতিরিক্ত শীতে সাধারণত তারা কোনো গুহায় আশ্রয় নেয়।

রুফাস হামিং বার্ড; Source: annenberge learner

আবার কোনো কোনো প্রজাতি শুকনো তৃণভূমি, নিম্মভূমি বা বনে বাস করে। কিছু প্রজাতি আবার পরিযায়ী। এরা প্রতি বছর নিয়ম করে অন্তত পাঁচশ’ মাইল পথ পাড়ি দেয়। রুফাস হামিং বার্ড প্রতি বছর ৩,০০০ মাইল উড়ে মেক্সিকো থেকে আলাস্কা যায়। সেখানকার গ্রীষ্মকাল তাদের প্রজননের জন্য ভাল। এরা তিন থেকে পাঁচ বছর বাঁচে।

প্রজনন

পুরুষ হামিং বার্ড তাদের আকর্ষণীয় রঙের পালক দ্বারা স্ত্রী হামিং বার্ডদের আকর্ষণ করে। কোনো কোনো প্রজাতি সুর করে গান গেয়েও স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করে। তারা মিলিত হলে স্ত্রী পাখি বাসা বানায় এবং ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা দেয়।

মা হামিং বার্ড; Source: audubon.org

স্ত্রী হামিং বার্ড বাচ্চাদের লালনপালন করে। হামিং বার্ডের ডিম একটা জেলি বিনের চেয়েও ছোট হয়। হামিং বার্ড তেমন সামাজিক নয়। এদের সাধারণত একসাথে দল বেঁধে উড়তে দেখা যায় না।

পরাগায়নের মাধ্যম

হামিং বার্ড হাজার হাজার প্রজাতির ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে। লাল বা কমলা পাপড়ির, লম্বা, নলাকার, নিচের দিকে ঝুলে থাকে-এমন ফুলের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি।

লাল ফুলে বামিং বার্ড; Source: birdeatcher’sdigest.com

তারা ফুল থেকে ফুলে মধু সংগ্রহ করে এবং এভাবে তাদের পরাগায়ন ঘটিয়ে থাকে। হামিং বার্ড ছোট বলে শত্রুর অভাব নেই। তবে এরা নানাভাবে শত্রুকে ফাঁকিও দিতে পারে। শত্রুকে ধোঁকা দিতে এরা কখনো কখনো ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়, কখনো বারবার আক্রমণ করে ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। বনের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচলেও তথাকথিত সভ্য মানুষ শত্রুদের হাত থেকে সবসময় বাঁচতে পারে না তারা। এদের সুন্দর পালকের জন্য কিছু মানুষ স্টাফ করে ঘরে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে। মানুষের শখের বলি হতে হয় নিরীহ এই পাখিদের। এই সুন্দর পৃথিবীর সুন্দরতম সৃষ্টিরা বেঁচে থাকুক, মুগ্ধ করে যাক সৌন্দর্যপিপাসুদের।

(শিরোনামের একাংশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা ভাষাশিক্ষার জন্য লেখা কবিতা থেকে নেওয়া)

ফিচার ইমেজ: Animals | HowStuffWorks

Related Articles