Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্র্যাকেন: রূপকথার জলদানব নাকি বাস্তব প্রাণী?

দূর সমুদ্রে ভেসে চলেছে বিশাল পালতোলা জাহাজ। নির্মেঘ তারাভরা আকাশের নিচে ছোট ছোট ঢেউ। মাঝি-মাল্লাদের কেউ গান ধরেছে, কেউবা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ দুলে উঠল জাহাজ। জাহাজ আষ্টেপৃষ্টে ধরল দানবীয় কতগুলো কালো কালো শুঁড়, কিছু বোঝার আগেই টেনে নিয়ে গেল পানির গভীরে। এমনই সব গল্প যুগের পর যুগ ধরে মাঝিমাল্লাদের থেকে সৃষ্টি হয়ে ঘুরেছে মানুষের মুখে মুখে। অতিকায় এই জলদানবের নাম ‘ক্র্যাকেন’। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত জলদানবের উপকথা সৃষ্টি হয়েছে, সম্ভবত ক্র্যাকেন তাদের ভেতর সবচাইতে ভয়ংকর।

ধারণা করা হয় দ্বাদশ শতাব্দীর নরওয়ের জেলেরা এই গল্পের স্রষ্টা। উপকথায় প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী ক্রাকেনের শুঁড় এত লম্বা হয় যে জাহাজের সবচেয়ে উঁচু মাস্তুলটি পর্যন্ত ধরতে পারে। জাহাজের মাঝি মাল্লাদের হয় ডুবিয়ে মারে নাহয় খেয়ে ফেলে। কিন্তু ক্র্যাকেনের বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল এটির বর্ণনা অনেকটাই মিলে যায় একটি সত্যিকারের প্রাণীর সাথে।

দানবীয় শুঁড় ধ্বংস করে জাহাজ; source: Coinfox

দেশ জাতি ভেদে গভীর সমুদ্রে বিশাল আর একাধিক মাথা, শুঁড় আর শিং ওয়ালা দৈত্যদের গল্প রূপকথার এক অনন্য অংশ ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গ্রিসের ছয় মাথা বিশিষ্ট পৌরাণিক প্রাণী স্কাইলার কথা। হোমারের ওডিসিতে ওডিসাসকে বাধ্য হয়ে স্কাইলার কাছ দিয়ে জাহাজ চালাতে হয়েছিল, যার ফলে তার ছয়জন লোক স্কাইলার পেটে যায়। এদের অনেকেই জায়গা পেয়েছিল লিখিত নথিপত্রে, কারণ ছিল তৎকালীন প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জানার সু্যোগের সীমাবদ্ধতা। যেমন ক্রাকেনকে প্রথম লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায় ক্যারোলাস লিনিয়াসের বিখ্যাত ‘সিস্টেমা নেচারে’-তে।

ক্র্যাকেনকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর বর্ণনায় ক্র্যাকেনকে মাঝ সাগরে ভাসতে থাকা দ্বীপ বা দ্বীপগুচ্ছ ভেবে ভ্রম হয়। এমনকি ১৭৫২ সালেও বিশপ এরিক পন্টোপিডান তার লেখা ‘নরওয়ের প্রাকৃতিক ইতিহাস’-এ ক্র্যাকেনকে বর্ণনা করেছেন “অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে বিশ্বের বৃহত্তম জলদানব, যে কিনা চওড়ায় দেড় মাইল”। পন্টোপিডান আরো বলেছিলেন, তারামাছের মত এর শরীরে স্ফীত অংশ থাকে। প্রচলিত গল্পানুসারে ক্র্যাকেনকে এগিয়ে আসতে আপনি দেখতে পাবেন না। এরা বিশাল কালো শুঁড় নিয়ে আপনার জাহাজের তলদেশেই ওঁত পেতে অপেক্ষা করবে। কিন্তু হঠাৎ যদি অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণ মাছ উঠতে শুরু করে বুঝে নিতে হবে গড়বড় আছে কিছু! রূপকথা অনুযায়ী মাছেরা ক্রাকেন দ্বারা আকৃষ্ট হয়। আবার অনেকে বলেন ক্র্যাকেন মাছেদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে আনে জাহাজের দিকে যাতে জাহাজের মাল্লারা ঐদিকে আকৃষ্ট হয়। এটাকে ক্র্যাকেনের টোপ বলা যেতে পারে। আবার অনেক গল্পে ক্র্যাকেন আকারে এতই বড় যে সে যখন পানির উপর মাথা তুলে আবার ডুব দেয় তার ডুবে যাওয়ার জায়গাটিতে পানির বিরাট ঘূর্ণন তৈরি হয়, তখন আশেপাশের সবকিছুর সাথে জাহাজটাও ডুবে যায়। নরওয়ের উপকথার বীর জেলেরা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ক্র্যাকেনের উপর থেকেই মাছ ধরে।

বীর জেলেরা ক্র্যাকেনের ভয়কে জয় করে মাছ ধরে ; source: Movieshrink.com

প্রথম দিকে ক্র্যাকেনের বর্ণনাগুলো ছিল বিশাল কাঁকড়ার মত, পরে সেগুলো স্কুইডের মত হতে থাকে। এমনকি জুলভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’-এও এমন এক ভয়াল স্কুইডের দেখা মেলে যার বর্ণনা ও ভয়াবহতা অনেকটা ক্র্যাকেনের মত। তবে কি ক্র্যাকেন আসলে স্কুইডই?

১৮৫৭ সালে ক্র্যাকেনের বাস্তবতা প্রমাণ হতে থাকে। ডেনমার্কের প্রকৃতিবিদ স্টিনস্ট্রাপ সমুদ্রের তীরে ভেসে আসা কোনো এক প্রাণীর অঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। এটি ছিল স্কুইডের ঠোঁট, লম্বায় ৮ সে.মি। ঠোঁট দেখেই স্টিনস্ট্রাপ এর পুরো শরীরের আকৃতির বিশালতা ধারণা করে নিয়েছিলেন। এর পরপরই বাহামা থেকে আরোও কিছু প্রমাণ পান। স্টিনস্ট্রাপ নিজের প্রকাশিত লেখায় ক্র্যাকেনের অস্তিত্ব বাস্তব বলে দাবি করেন, আর পৃথিবীকে জানান ক্র্যাকেন আর কিছুই নয়, বরং বিশাল প্রজাতির স্কুইড। তিনি এই প্রজাতির নাম দিয়েছিলেন ‘শাসক স্কুইড’।

স্টিনস্ট্রাপের দাবির পর আরো ২১ প্রজাতির দানবাকার স্কুইড থাকার দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের পরীক্ষিত প্রাণীগুলোর একটিও কিন্তু জীবিত ছিল না। দেহের অংশ, কদাচিত পুরো শরীর সমুদ্রতটে পাওয়া গিয়েছিল। কর্ষিকাসহ দানব স্কুইড ১৩ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কেউ কেউ ১৮ মিটার পর্যন্ত হতে পারে দাবি করলেও বেশিরভাগ গবেষকই এই ধারণা অমূলক বলেন। কারণ স্কুইডের টিস্যু দুপুরের রোদে রাবারের মত আচরণ করতে পারে। সমুদ্রতটে এসে পৌঁছানোর পর গরমে অতিরিক্ত লম্বা হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সত্যি বলতে মানুষ এখনো পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না একটা দানব স্কুইড আসলে কতখানি লম্বা হতে পারে। এর কারণ এদের দুষ্প্রাপ্যতা। এদের অস্তিত্বের প্রমাণ শুধু মৃত শরীর। ধারণা করা হয় আগ্রাসী তিমির হাত থেকে বাঁচতে পানির ৪০০-১,০০০ মিটার পর্যন্ত গভীরে এদের বাস।

মানুষের কল্পনার দানবীয় ক্র্যাকেন; source: YouTube

স্কুইডগুলোর সুবিধা হল এদের চোখ। থালার মত বড় বড় চোখ নিয়ে দূর থেকে তিমির অবস্থান দেখতে পায় ও নিজেকে রক্ষা করে। এর পেট থেকে পাওয়া খাবার পরীক্ষা করে দেখা গেছে এরা মাছ ও ছোট স্কুইড খায়। এমনকি অন্য একটি দানবীয় স্কুইডের অংশবিশেষ ও পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, এরা মাঝে মাঝে স্বজাতিভূক হয়ে ওঠে। কেন, কী কারণে হয় সেটা অজানাই থেকে গেছে।

তাহলে কি একটা দানবাকৃতির স্কুইডই রূপকথার ভয়ংকর জলদানব ক্র্যাকেন?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে তাদের আক্রমণ করার স্পৃহা খুঁজে পেতে হতো। কিন্তু বিরল এই প্রাণীটির দেখা মেলাই তো ভার। এই কাজটি সহজ করে দিল জাপানের জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরের গবেষকরা। তিমি গবেষক কিয়োচি মোরিকে নিয়ে তৈরি করা সেই দল পৃথিবীর সামনে জীবন্ত ভিডিও দেখাল দানবীয় স্কুইডের। টোপ দিয়ে আকর্ষণ করে ছবি তোলা হয়েছিল এর। আট বছর পর মোরি আরো ভালো ভিডিওর সরঞ্জাম নিয়ে এখানে পৌঁছান ও অনেক কষ্টে এর ভিডিও করেন। বিশাল দুই কর্ষিকা দিয়ে এরা শিকারকে আকঁড়ে ধরে। সাথে থাকে আরো কিছু বাহু। বাহুগুলোতে শোষক কাপ থাকে। প্রতিটি কাপে আছে ধারালো দাঁত। অর্থাৎ দানব স্কুইডের কবলে পড়ে আপনার বেঁচে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এরা শুধু নিজেদের প্রধান শিকারের দিকেই লক্ষ্যস্থির রাখে। আর খায় খুবই আস্তে আস্তে, টিয়া পাখির ঠোঁটের মত ঠোঁট ব্যবহার করে ছোট কামড় দিয়ে। মানুষের দিকে কোনো রুচিই দেখায়নি সে। জাহাজ টেনে নেওয়া তো অনেক দূরের কথা। দানব স্কুইড বিশাল হলেও নিতান্ত গোবেচারা প্রাণী।

প্রথম পাওয়া দানব স্কুইডের ছবি; source: Linkedin.com

তাহলে স্কুইড ছাড়া কি অন্য কোনো প্রাণী হতে পারে ক্র্যাকেন? এক্ষেত্রে স্কুইডের নিকটতম প্রতিযোগী দানব অক্টোপাস। এই অক্টোপাসগুলোও কত বড় হতে পারে তা মানুষের ধারণার বাইরে। অল্পবয়স্ক একটি দানব অক্টোপাস একবার ধরা পড়েছিল, সে তখনই ছিল ৮ মিটার। এছাড়া এই অক্টোপাসও তুলনামূলকভাবে নিরীহ। আর এদের বাসস্থান শুধুমাত্র এন্টার্কটিকার সাগর। স্ক্যানডিনেভিয়ার ক্র্যাকেনের গল্পগুলো তাই অক্টোপাসের গল্প নয়।

এসব প্রমাণ দেখে আপাতভাবে মনে হয়, ক্র্যাকেন নেহাতই দানবীয় জীবের সাথে গল্পের ডালপালা জুড়ে বানানো রূপকথার চরিত্র। কিন্তু এরপরই পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক কালের স্কুইডের ফসিল, যেখানে স্কুইডের ভেতর থেকে বড় বড় উভচর প্রাণীর দেহাবশেষ মেলে।

source: livescience.com

এই স্কুইডগুলো ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারত বলে ধারণা করা হয়। ১৯৩০ সালে অন্তত তিনবার দানব স্কুইডের জাহাজ আক্রমণের ঘটনা ঘটে। তাদের আক্রমণে জাহাজের প্রপেলারে চিড় ধরে। তাদের আক্রমণের ধরন দেখে মনে হয়েছিল, তারা জাহাজটিকে বিশাল তিমি ভাবছে। সুতরাং এটা সম্ভব যে আগেকার দিনের অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট জলযানকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী তিমি ভেবে ডুবিয়ে দিয়েছে। সাগরতলের জগত এতই বিশাল যে ক্র্যাকেনের মত বিধ্বংসী দানব মানুষের জ্ঞানের সীমার আড়ালে থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

ফিচার ইমেজ: Wallpaper Cave

Related Articles