Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নেইত্রন হ্রদ: প্রাণীরা যেখানে পাথুরে মূর্তি হয়ে যায়!

রাজা মাইডাসের গল্প মনে আছে? সেই মাইডাস, যিনি একটি পরীর কাছ থেকে সবকিছু সোনায় পরিণত করা শিখেছিলেন। ফলে যা কিছু স্পর্শ করতেন সবই সোনায় পরিণত হত। ঘটনাক্রমে তার মেয়ে ম্যারিগোল্ডও সোনায় পরিণত হয়ে যায়। যা-ই হোক, বাস্তবে এভাবে কোনোকিছু স্পর্শ করা মাত্রই সোনায় পরিণত হওয়া অসম্ভব হলেও পাথরে পরিণত হওয়ার কথা কিন্তু অসম্ভব নয়! বলছি তানজানিয়ার নেইত্রন হ্রদের কথা, যেখানে কোনো প্রাণী ও পাখি বসলে সাথে সাথে পাথরের মতো শক্ত বা পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয় বলে দাবী করা হয়।

পশ্চিম আফ্রিকার উত্তর তানজানিয়ায় দুটি লবণাক্ত ও সোডাসমৃদ্ধ হ্রদের খোঁজ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে নেইত্রন হ্রদ এবং অপরটি হলো বাহি হ্রদ। দুটি হ্রদই রিফ্ট উপত্যকার পশ্চিম পাশে কেনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। নেইত্রন হ্রদে প্রধাণত সোডিয়াম কার্বোনেট ডেকাহাইড্রেট বা সোডা অ্যাশ এবং সোডিয়াম বাইকার্বোনেট বা খাবার সোডা পাওয়া যায়। নেইত্রন হ্রদের পানি প্রবাহিত হয় না। শুধুমাত্র বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় পানির পরিমাণ কমে যায়।

নেইত্রন হ্রদের লাল বর্ণ; Source: tanzaniasafariprivatetours.com

দুটি হ্রদের মধ্যে নেইত্রন হ্রদটিই বৃহৎ। এটি ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত। অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য এই হ্রদ মোটেও অনুকূল নয়। এই হ্রদের তাপমাত্রা ৬০˚ সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর পানি অত্যন্ত ক্ষারীয়, যার পিএইচ এর মাত্রা ১০.৫! হ্রদটি দেখতে কমলা-লাল এবং গোলাপী বর্ণের। তবে শুষ্ক মৌসুমে তা নীল রংয়ের হয়। এই অদ্ভুত বর্ণ সেখানে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবকণার দ্বারা তৈরি হয়েছে। হ্রদটি দেখতে খুবই স্বচ্ছ, সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন।

লক্ষ লক্ষ ফ্লেমিংগো পাখির মিলনমেলা; Source: safari-adventures.com

নেইত্রন হ্রদের তীরে লক্ষ লক্ষ ফ্লেমিংগো পাখি প্রজননের উদ্দেশ্যে আসে। এখানেই বিশ্বের শতকরা ৭৫ ভাগ ফ্লেমিংগো পাখির জন্ম হয়। পাখিগুলো হ্রদের তীরে বাসা বাঁধে এবং লাল শৈবাল খেয়ে জীবন বাঁচায়। কিন্তু হ্রদের জলে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই! দুভার্গক্রমে পড়ে গেলে পাথুরে চুনের মতো শক্ত হয়ে যায়। তথাপি নেইত্রন হ্রদকে পাখিদের নিরাপদ প্রজনন আবাস বলা হয়। কারণ সেখানকার বৈরী পরিবেশের জন্য অন্য কোনো শিকারী পশুপাখি খাবার সংগ্রহের জন্য যায় না।

পায়ের ত্বক শক্ত হওয়ায় অবাধ বিচরণক্ষম ফ্লেমিংগো; ‍Source: mnn.com

গবেষকদের মতে, ফ্লেমিংগোর পায়ের ত্বক খুবই শক্ত হওয়ায় এই হ্রদের লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তবে এই হ্রদের পানিতে মানুষও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পা রাখলে মারা যেতে পারে! বিপজ্জ্বনক হলেও এই হ্রদে Alcolapia latilabris এবং Alcolapia ndalalani নামক তেলাপিয়া মাছের প্রজাতির খোঁজ পাওয়া যায়। যারা এই হ্রদে অভিযোজিত হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় নেইত্রন হ্রদটি সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু অদ্ভুত এ হ্রদটি ২০১৩ সালে আলোচনায় উঠে আসে, যখন ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডট হ্রদটির কিছু ভূতুড়ে দৃশ্যের ছবি প্রকাশ করেন। তিনি ছবিতে দেখান কিছু পাখি ও বাদুড় মূর্তির ন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু কেউই জানতেন না প্রাণীগুলো কীভাবে মারা গেছে। ব্রান্ডট ধারণা করেন, প্রাণীগুলো হয়তো হ্রদের জলে আলোক প্রতিফলনের কারণে ভুলক্রমে পড়ে যায় ও পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। তবে কেউ কেউ মনে করেন, শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে মৃত প্রাণীই এই পানিতে পড়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। পাথরের মতো শক্ত হওয়াকে কিন্তু ক্যালসিফিকেশন বলে। ক্যালসিফিকেশন হচ্ছে শরীরের কোথাও ক্যালসিয়াম জমা হওয়া। আমাদের শক্ত দাঁত, হাড় ইত্যাদি হচ্ছে এই ক্যালসিফিকেশনেরই ফল। ব্রান্ডট দেখেন, তার কোডাক ছবির বাক্সের কালিও সেখানকার অতিরিক্ত সোডা ও লবণের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তার মতে, প্রাণীগুলোতে ক্যালসিফিকেশন ঘটে ও শুকিয়ে পাথুরে মূর্তির ন্যায় হয়। নেইত্রন হ্রদে প্রাপ্ত ছবিগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে ব্রান্ডট ‘Across the Ravaged Land’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। এখন ব্রান্ডটের তোলা ছবিগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে।

ফিস ঈগল

ব্রান্ডট অপ্রত্যাশিতভাবে নেইত্রন হ্রদে একটি ফিস ঈগল খুঁজে পান যেটি পানিতে মূর্তির মতো পড়ে ছিল। সেটি শক্ত হয়ে যায়। প্রাকৃতিকভাবে অনেকটা মিশরের মমি তৈরির মতো ঘটনা ঘটে।

মূর্তির ন্যায় দাঁড়ানো ফিস ঈগল; Source: huffingtonpost.com © Nick Brandt.

অতিরিক্ত সোডা ও লবণের কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া পাখিটিকে তুলে একটি শুকনো ডালের উপর বসিয়ে দেন তিনি। তারপর মৃত্যুর পূর্বে যে অবস্থায় বসে থাকার কথা, সেই অবস্থায় ছবি তুলে নেন। ব্রান্ডট কিন্তু কোনো প্রাণীকে পানিতে পড়ার পর মারা যেতে দেখেননি। তাই অনেকেই পানি স্পর্শ করলেই শক্ত পাথর হয় কিংবা মৃত্যু ঘটে- এই কথাকে বিশ্বাস করতে চান না।

বাদুড়

ব্রান্ডট একটি বাদুড়েরও ছবি তোলেন। বাদুড়টি পানির অতিরিক্ত তাপমাত্রা, উচ্চমাত্রার ক্ষার ও ক্যালসিয়ামের উপস্থিতির কারণে শক্ত হয়েছে বলে জানান।

ভূতুড়ে মূর্তির ন্যায় বাদুড়; Source: © Nick Brandt.

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের তথ্যমতে, বাদুড় সহ অন্যান্য প্রাণী প্রাকৃতিকভাবেই মারা যায়। পরে অতিরিক্ত লবণ সেগুলোকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। জিয়ামী বাটলারের মতে, নেইত্রন হ্রদের জলেও জীবিত প্রাণীকে স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করতে দেখা যায়।

ভাসমান ফ্লেমিংগো

২০১০ সালে ব্রান্ডট নেইত্রন হ্রদ থেকে একটি মূর্তির ন্যায় ভাসমান ফ্লেমিংগো পাখির ছবি তোলেন। ঈগল, বাদুড়ের ন্যায় একই কারণে ফ্লেমিংগোটিও শক্ত মূর্তির ন্যায় রূপ ধারণ করেছিল।

পানিতে ভাসমান মূর্তির মতো ফ্লেমিংগো; Source: © Nick Brandt

পর্যাপ্ত খাবার, শিকারী প্রাণী ও মানুষের উৎপাত না থাকায় ফ্লেমিংগো পাখির প্রজনন ও বাচ্চা উৎপাদনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই নেইত্রন হ্রদ। এই হ্রদেই প্রতি বছর ২৫ লক্ষ ফ্লেমিংগো পাখির জন্ম হয়।

গায়ক পাখি

অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও ক্ষারের জন্য অল্প কিছু জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নেইত্রন হ্রদে। তবে অনেক হতভাগা পাখির ত্বক ও চোখ পুড়ে যায় বলে মনে করেন ব্রান্ডট।

পাথুরে গায়ক পাখি; Source: © Nick Brandt

ব্রান্ডট বলেন, ঐ এলাকার অনেকেই জীবিত পাখিকে হ্রদের পানিতে পড়ার পর মারা যেতে দেখেছেন। হয়তো এই ক্ষুদ্র গায়ক পাখিটিরও ভাগ্যে তেমনই কিছু ঘটেছিল।

পাথুরে সোয়ালো পাখি

নিক ব্রান্ডট ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে নেইত্রন হ্রদ থেকে পাথুরে প্রাণী ও পাখির যে ছবিগুলো তোলেন সেগুলোর মাঝে দু’টি ছিল সোয়ালো পাখি। অন্যান্যগুলোর মতো সেগুলোর শরীরও শক্ত হয় বলে দাবী করেন ব্রান্ডট।

পাথরের উপর দাঁড়ানো পাথুরে সোয়ালো পাখি; Source: © Nick Brandt

ব্রান্ডটের দাবীর সাথে একমত নন অনেকেই। উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থুরে চারলিংয়ের মতে, পাখিগুলো প্রাকৃতিকভাবে মারা যায়। পরে সেগুলোর শরীরের উপর সোডিয়াম কার্বোনেট অথবা সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের আস্তরণ পড়ে। তাছাড়াও হ্রদের পানির রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা যায়, সেখানে ক্যালসিয়ামের প্রাচুর্যতা তেমন নেই।

নীরব ঘুঘু

ব্রান্ডট ২০১০ সালে নেইত্রন হ্রদ থেকে তোলা একটি ঘুঘুকে পাখা ভাঁজ করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমায় প্রদর্শন করেন। তবে সাদাকালো ছবিতে নেইত্রন হ্রদের লাল পানির কোনো প্রমাণ না মেলায় এই ছবির সত্যতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

এ যেন পাথরে নির্মিত ঘুঘু; Source: © Nick Brandt

আজকাল যাযাবর লোকদের এই নেইত্রন হ্রদের তীরে গরু চড়াতে দেখা যায়। কিন্তু কাউকে সেখানে বসবাস করতে দেখা যায় না। বর্তমানে হ্রদের পানি অনেকটাই বিষাক্ত ও পানের অযোগ্য হলেও প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার বছর পূর্বে হ্রদের প্রচুর বিশুদ্ধ পানি ছিল।

নেইত্রন হ্রদের কাছে প্রাপ্ত আফ্রিকার আদি মানবের খুলি; Source: boneclones.com

১৯৫৯ সালে Australopithecus boisei নামক মানবজাতির ১.৭৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো চোয়াল ও দাঁতের সন্ধান পাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু সেই চোয়াল ও দাঁতে ব্রান্ডটের তোলা ছবির মতো ক্যালসিয়াম জমাট বাঁধা ছিল না।

ব্রান্ডটের তোলা ছবির প্রাণীগুলো মারা যাওয়ার পর পানিতে পড়ে পাথুরে মূর্তির রূপ ধারণ করেছে, নাকি পানি স্পর্শ করার কারণে মৃত্যু হয়েছে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। তারপরেও সকলেই একমত যে, নেইত্রন হ্রদে কোনো মৃত প্রাণী পড়ে থাকলে তা মমির মতো শক্ত হয়ে যায়।

ফিচার ইমেজ – thousandwonders.net

Related Articles