ভাবুন তো, পুরো একটা প্রজাতি প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি আমরা মানবজাতি, শুধু লোভে পড়ে! কেবল বাকি ছিল সাদা গণ্ডার প্রজাতির সর্বশেষ পুরুষ! সেই সবেধন নীলমণিও মৃত্যুশয্যায়। গণ্ডারটির বয়স হয়েছে, ফুরিয়ে আসছে আয়ু। মৃত্যুর আগে নানা অসুখ বাসা বেধেছে শরীরে। একমাস ধরে সে অসুস্থ। আর বাঁচবে না! এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর ‘উত্তরের সাদা গণ্ডার’ প্রজাতির শেষ পুরুষ সদস্যটি মারা যায় ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ, বিষণ্ন এক দিনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আড়ালে চলে যাচ্ছে সূর্য, এমনই সময়ে চোখ বোজে এই গণ্ডার। জীবনের শেষ এক বছরে পৃথিবীখ্যাত হয়ে উঠেছিল 'সুদান' নামের এই গণ্ডার।
জীবনের শেষ কয়েকবছর কেনিয়ার ওল পেজেতা নামে পুরাতন এক ক্যাটল ফার্মে তাকে রাখা হয়েছিল, যা ব্যবহৃত হচ্ছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অরণ্য হিসেব। বেশ কয়েকটি চিড়িয়াখানা ঘুরে শেষকালে ওল পেজেতায় আসে সে। গণ্ডারের এই প্রজাতিকে আফ্রিকার নানা দেশে দেখা গেলেও কখনোই কেনিয়ায় দেখা যায়নি। প্রজাতি সংরক্ষণের চেষ্টা হিসেবে নিরাপদ এই আবাসে তার জায়গা হয়েছিল। সুদানের জন্ম সুদানের এক চিড়িয়াখানায়। জন্মস্থানের নাম থেকে তার নাম দেয়া হয় 'সুদান'। তারপর চেক রিপাবলিকের এক চিড়িয়াখানায় বাস করত সে। সেখান থেকে তাকে কেনিয়ায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে এখানেই তার মৃত্যু হয়। এই প্রজাতির সদস্যরা বন্য পরিবেশে বাঁচে ৪০ বছর। সেই তুলনায় সুদান বেঁচেছে একটু বেশি— ৪৫ বছর।
গণ্ডার খুব শান্ত প্রাণী হিসেবে টিকে আছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে। কারণ, গণ্ডারকে শিকার করে, প্রকৃতিতে এমন কেউ নেই। কখনও ছিল না। আবার গণ্ডারও তেমন কাউকে শিকার করেনি। শান্ত হয়ে ঘাস জাতীয় লতাপাতা খেয়ে ৫০ কোটি বছর ধরে টিকে আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকলো কি?
সুদানের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির কেবল একটি মাত্র উদাহরণ। এরকম হাজার হাজার প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মানুষের রয়েছে সরাসরি ভূমিকা। সাদা গণ্ডারের বিলুপ্তি, প্রতিনিয়ত হারানো অন্য আর দশটি প্রজাতির মতো, প্রকৃতির নিয়মে বিলুপ্তির গল্প না। মানুষের তৈরি অস্ত্র, বিষ, ফাঁদে পড়ে, লোভের শিকার হয়ে হাজারো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন সাদা গণ্ডারকে শিকার করতে করতে বিলুপ্ত করে ফেলল?
পৃথিবীর বুকে ৫০ কোটি বছর টিকে থাকা স্তন্যপায়ী প্রাণী এই উত্তরের সাদা গণ্ডার। গণ্ডারের একটিমাত্র অঙ্গই একে মানুষের শিকারে পরিণত করার উপলক্ষ— শিং। মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার গণ্ডারের অবলুপ্তি ঘটিয়েছে। নানা লোকায়ত চিকিৎসা, বিভিন্ন সমাজে পদমর্যাদার প্রতীক হিসেবে সম্পদ, স্মারক হিসেবে এর শিং ব্যবহার করা হয়। শিঙের চাহিদার এই সুযোগ গ্রহণ করে শিকারীরা। যারা গণ্ডারকে গুলি করে, বা বিষ মাখানো তীর দিয়ে ধরাশায়ী করে। তারপর তার শিং কেটে নেয়। শিং কাটার পর অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে গণ্ডার। এমন আহত অবস্থায় একটি গণ্ডার বেঁচে থাকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত।
শিকারীরা গণ্ডার শিকার করতো প্রথমত শিকারের আনন্দ পেতে। বড় এক প্রাণী ধরাশায়ী করা একসময় সাহসের পরিচায়ক ছিল। বন্য থেকে 'সভ্য' পৃথিবী গড়ার প্রক্রিয়া হিসেবে একে দেখা হতো। এরপর শিকার করা শুরু হয় শিং সংগ্রহ করতে। যে শিং দিয়ে নানা কিছু বানানো যায়। এই শিং ব্যবহার হয়েছে ট্রফি হিসেবে। এছাড়া বিষ যাচাই করার জন্য, সন্তানের জন্ম সহজ করাতে, চীনের স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এর প্রচুর ব্যবহার হয়েছে। বলা হয়েছে, গণ্ডারের শিঙের গুঁড়ো রক্ত শীতল করে, জ্বর নামায়, মাথাব্যথা দূর করে। সাপের কামড় থেকে বাঁচায়, বমি থামায়। যদিও এর কোনোটাই সত্য না। এগুলো মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস।
গণ্ডারের অন্য প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। উত্তরের সাদা গণ্ডারের বাস ছিল উত্তর-পশ্চিম উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, মধ্য আফ্রিকার পূর্বাংশ, এবং কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাংশে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আফ্রিকাজুড়ে যুদ্ধে এদের জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করা ছিল অসম্ভব। নানা গোত্র ও অস্ত্রধারী দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৯৭০ সালে এই উপপ্রজাতি রক্ষার চেষ্টা করা হয়— কিছু সাদা গণ্ডারকে ধরে চিড়িয়াখানায় রাখার মাধ্যমে। সেই বছর উত্তরের সাদা গণ্ডারের এই প্রজাতির সংখ্যা হাজার থেকে নেমে আসে ৭০০-তে। ১৯৮০ সালে দেখা যায়, বনে এরা মাত্র ১৫টি টিকে আছে, যা ২০০৬ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৪-এ। দুঃখজনকভাবে, চিড়িয়াখানার গণ্ডারগুলো মারা যাচ্ছিল সন্তান জন্ম দেয়ার মতো বয়স হওয়ার আগেই। ২০০৯ সালে সুদান আর সুনি, নাজিন, এবং ফাতু নামের চার সাদা গণ্ডারকে আফ্রিকায় ফিরিয়ে আনা হয়। আশা ছিল, চারজন দিয়ে কিছু একটা মিরাকল ঘটবে। রক্ষা পাবে এই প্রজাতি। সেটি ঘটেনি। সুনি মারা গেছে। এরপর সুদান। বেঁচে আছে দুই নারী।
২০০৯ সালের শীতকালে সুদানের সঙ্গে পৃথিবীতে ছিল মাত্র সাতটি গণ্ডার। যেখানে, ১৯৮০ সালে তারা ছিল ১৯ হাজারের মতো। তারপর বিপর্যয় নামে শুধু এদের শিঙের কারণে। মানুষের নখ যেমন ক্যারাটিন দিয়ে তৈরি, গণ্ডারের শিংও একই পদার্থে তৈরি। তবুও ক্যারাটিন নির্মিত কোনো বিশেষত্ববিহীন শিঙেই মানুষ নানারকম বিশ্বাস আরোপ করে। অভাব হয় না ভোক্তার, অকাতরে নিহত হতে থাকে গণ্ডার।
২০০৯ সালে উত্তরের সাদা গণ্ডারের সবকটিই চিড়িয়াখানায় ছিল। বন্যদশায় ছিল না কোনোটিই। পরিস্থিতি গিয়ে দাঁড়াল— এই আটটি গণ্ডার মরে গেলে পৃথিবীতে উত্তরের সাদা গণ্ডার বলে আর কিছু থাকবে না। তাই কয়েকটি সংগঠন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে প্রজাতিটি রক্ষা করতে। শিকারীদের হাত থেকে রক্ষার উপায় হিসেবেও তাদেরকে চিড়িয়াখানায় রাখা হয়েছিল। তারপর তাদের প্রজাতি টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা হয়। 'সুদান' থাকত চেক প্রজাতন্ত্রে। পরিকল্পনা হয়, কেনিয়ার এক নিরাপদ গেম রিজার্ভে তাকে নেওয়া হবে। মোট চারটি গণ্ডার নেওয়া হবে। যারা মিলিত হয়ে রক্ষা করবে সাদা গণ্ডারের প্রজাতি। আশা ছিল তারা আবার প্রকৃতিতে ফিরে যাবে।
সাদা গণ্ডারের এই প্রজাতি রক্ষার পরিকল্পনা ছিল প্রজাতি রক্ষার শেষ চেষ্টা। দেভুর রালভে চিড়িয়াখানার থেকে গণ্ডারের এই চার সদস্যকে নেওয়া হয় কেনিয়ায়। প্রায় চার হাজার মাইল দূরে, তবে উপযুক্ত পরিবেশেই। সুদানকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল কীভাবে বক্সের মধ্যে গিয়ে ঢুকতে হয়। সুদান সুন্দরভাবে বাক্সে ঢুকে কেনিয়ায় এসেছিল। কারণ, চিড়িয়াখানার আদব কেতা শেখা গণ্ডার সে।
কেনিয়ায় সুদানদের বসবাসের জায়গা একটি ১০০ একর মাঠ। যার চারপাশে উঁচু ইলেক্ট্রিক তার দিয়ে ঘেরা। একপাশে রাস্তা। সেখান থেকে দর্শকেরা তাকে দেখতে পারত। ১৯৭৩ সালে জন্ম নিয়ে ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করা এই গণ্ডারের বার্ধক্য মানুষের সাথে তুলনা করলে ৯১ বছর বয়স্ক বৃদ্ধের মতো।
গণ্ডারের মাতৃভূমি আফ্রিকার আলো-বাতাসে তাদের নেওয়া হয়। শিকারীর হাত থেকে রক্ষার জন্য ২৪ ঘণ্টা পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়। দিকে দিকে সুদান ও তার তিন সঙ্গীর খবর ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ দেখতে আসে তাদের। তাদের সম্পর্কে জানতে পারে। কেউ প্রচুর ছবি তোলে। কেউ বিষ্ময়াভিভূত হয়। কেউ দুঃখে কাঁদে এই ভেবে, সুদানের প্রজাতিকে পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। তার জন্য সকলের মায়া পড়ে যায়। একসময় সুদান সেলিব্রেটি হয়ে ওঠে। তাদের দেখতে অনেকসময় রাস্তায় জ্যাম পড়ে যেত। এছাড়া পৃথিবীজুড়ে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসি, ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক টাইমস নিয়মিত খবর প্রচার করতে থাকে।
উত্তরের সাদা গণ্ডার আসলে নামেই সাদা। এদের নামকরণ ঔপনিবেশিক আমলের ভুল বোঝাবুঝি ও বোকামির ফল। ডাচ সেটেলাররা এদের ডাকত ওয়াইজড। যার মানে ওয়াইড, বা বিচক্ষণ। ইংলিশ সেটেলাররা ভেবেছে, ডাচেরা ডাকছে হোয়াইট, মানে সাদা। তাই তারা একে সাদা গণ্ডার বলা শুরু করল। অন্যগুলোকে ব্ল্যাক বা কালো গণ্ডার। আসলে বর্ণের দিক থেকে দুই দলের গণ্ডারই ধূসর।
কেউ বলতে পারেন, পৃথিবী মিউজিয়াম না। প্রকৃতি নিজের গতিতে চলে। শত শত প্রজাতি প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর একটা প্রজাতি বিলুপ্ত হলে কী আসে যায়? সাদা গণ্ডার শুধু একরকম গণ্ডারই না। এই গণ্ডার তার প্রতিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখে। বনে চলার পথ পরিষ্কার রাখে। নিয়মিত চলাচল করে ছোটখাট প্রাণীর জন্য রাস্তা তৈরি করে। বিপুল পরিমাণ ঘাস খেয়ে মাঠ পরিষ্কার রাখে। তাদের খাওয়া ঘাসের কারণে হরিণের (gazelle) উপযোগী খাদ্য যেসব ঘাস, সেগুলো জন্মানোর সুযোগ পায়। এর গোবরে বাস করে নানারকম কীট, যার উপর নির্ভরশীল নানা প্রজাতির পাখি। সব মিলিয়ে গণ্ডার বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাস্তুতন্ত্রকে স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে গণ্ডারকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
অনেকে মনে করে গণ্ডার এক আশ্চর্যকর প্রাণী, কিম্ভূতকিমাকার। এই ধারণা ছড়ানোর পেছনে দায় আছে ইউরোপীয়দের। গত এক হাজার বছরে ইউরোপে কোনো গণ্ডার দেখা যায়নি। কিন্তু ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা গণ্ডার সম্পর্কে গালগল্প ছড়িয়েছেন। মার্কো পোলো তার ভ্রমণ কাহিনী 'দ্য ট্রাভেল অব মার্কো পোলো' অনুযায়ী, গণ্ডার হলো অতি কদাকার ইউনিকর্ন, যারা তাদের ইউনিকর্ন দিয়ে শত্রুকে খুন করে না। তারা তাদের শিং হাঁটুর নিচে বিদ্ধ করে, স্পাইকি জিহবা দিয়ে নিজের মৃত্যু টেনে আনে। এমনকি আধুনিক সময়েও নানা গল্প চালু আছে। যার কোনোটিই সত্য না। অনেকে ভাবেন, গণ্ডার ডাইনোসরের সমান বয়সী। অথচ ঘোড়ার থেকে বেশি দিন ধরে তারা পৃথিবীতে টিকে ছিল না। আবার এদের শিংকে অনেকে বলেন ইউনিকর্ন। অনেকে শিঙের নানা বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। অথচ আমাদের চুল ও নখের উপাদান আর গণ্ডারের শিং একই— ক্যারাটিনে গড়া।
'সুদান' রেখে গেছে তার দুই বংশধরকে। তার মেয়ে নাজিন, নাতনী ফাতু। এমন এক অবস্থায় রেখে গেছে দুই নারী সদস্যকে, যাদের নিজেদের আর কোনো সদস্য জন্ম দেওয়ার সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। তাই একরকম এই প্রজাতিকে বিলুপ্তই ধরা যায়।
Language: Bangla
1. The Last Two Northern White Rhinos On Earth - The New York Times
2. Sudan, the world’s last male northern white rhino, has died - The Washington Post
3. Sudan, the Last Male Northern White Rhino, Dies in Kenya - The New York Times
2. Sudan, the world's last male northern white rhino, dies - The NBC News
Featured Image: Ami Vitale/National Geographic