Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাঞ্চিনিল বৃক্ষ: সুমিষ্ট ফলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত মৃত্যুদূত

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের টোবাগো দ্বীপের শ্রান্ত সৈকতের বালির উপর শত শত শামুকের খোলস জমে আছে। মধ্য দুপুরের কড়া রোদে চিক চিক করে উঠা বালির উপর খোলসগুলো এক অদ্ভুত তৈলচিত্রের জন্ম দিয়েছে। এই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পর্যটকরা শামুক সংগ্রহের যজ্ঞ খুলে বসেছে। দ্বীপের পূর্ব সীমান্তের সৈকতেও শামুক সংগ্রহ চলছে।

একদম শুরুর দিকে লম্বা গড়নের যে তরুণীকে দেখা যাচ্ছে, তার নাম নিকোলা স্ট্রিকল্যাণ্ড। পেশায় একজন রেডিওলোজিস্ট নিকোলা কর্মব্যস্ততার গ্রাস থেকে সামান্য অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে বেছে নিয়েছেন এই দ্বীপকে। পোর্সেলিনের তৈরি একটি বাটিতে তিনি বেশ কিছু শামুক এবং কোরাল সংগ্রহ শেষে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপের গভীরে প্রবেশ করলেন। সৈকতের শোভাবর্ধক নারিকেল গাছের সারি দ্বীপের গভীরেও বিস্তৃত হয়েছে। নারিকেল ছাড়াও বেশ কিছু মুখরোচক ফল গাছের বাগান রয়েছে দ্বীপের মাঝে। গাছে ঝুলতে থাকা ফলের মিষ্টি গন্ধে যে কারো জিভে জল এসে পড়তে বাধ্য।

নিকোলা আর তার বন্ধুদের হঠাৎ ফল খাওয়ার লোভ জেগে উঠলো। অনেকেই হাতের নাগালে থাকা বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতে থাকলো। তাহলে নিকোলা বাদ যাবেন কেন? তিনিও বেছে বেছে সবুজ রঙের একটি ফল বের করে মুখে পুরলেন। মুখে দেওয়ামাত্র হঠাৎ নিকোলা ছটফট করতে থাকলেন। তার হাত-পা অবশ হয়ে গেলো। গলায় এবং জিহ্বায় প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে থাকলো। বন্ধুরা ভয় পেয়ে গেলো। কী হলো হঠাৎ নিকোলার? ঠিক তখন নিকোলার হাত থেকে সবুজ সেই ফলটি বালিতে পড়ে গেলো। 

সাবধান! স্পর্শ করবেন না; Source: Scott Hughes

১৯৯৯ সালে সেদিন নিকোলা স্ট্রিকল্যাণ্ড এক বিষাক্ত ফলে কামড় বসিয়েছিলেন। মাঞ্চিনিল নামক এক গাছের সেই ফলগুলোকে স্থানীয়রা Beach Apple নামে ডাকে। কিন্তু এর বাইরেও এর আরেকটি নাম রয়েছে। আর তা হচ্ছে- Poison Guava বা বিষাক্ত পেয়ারা।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক বৃক্ষের নাম ‘মাঞ্চিনিল ট্রি’। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hippomane mancinella। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থিওফ্রাস্টাস এই গাছগুলোর নাম দেন Hippomane হিসেবে। ‘Hippo’ অর্থ ঘোড়া, আর ‘Mane’ অর্থ পাগল। তাহলে এই গাছের নামের গ্রিক অনুবাদ দাঁড়ায় পাগলা ঘোড়া। থিওফ্রাস্টাস এই ফল সেবনের পর এক ঘোড়ার পাগল হয়ে যাওয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই নামকরণ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক নামকরণের জনক ক্যারোলাস লিনিয়াস পরবর্তীতে এই ফলের পূর্ণ নামকরণ করেন। 

উদ্ভিদবিদ্যার জনক দার্শনিক থিওফ্রাস্টাস; Source: Fine Art America

মেক্সিকো উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে এই গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। বাহ্যিকভাবে দেখতে বেশ সুন্দর এই ফলগুলো মাঝে মাঝে জোড়ায় জোড়ায় জন্ম নেয়। দেখতে অনেকটা আপেল এবং পেয়ারার সাথে সদৃশ। উচ্চতায় মাঞ্চিনিল গাছ প্রায় ৪০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এই গাছ এতই বিষাক্ত যে, এর বাকল আগুনে দগ্ধ হয়ে মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাসের উদ্রেক করে, যার প্রভাবে চোখে জ্বালা পোড়াসহ মুখের চামড়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্থানীয়রা এই গাছের বিষের সাহায্যে বন্য প্রাণী শিকার করে থাকে। তারা এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই গাছের সাহায্যে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করে থাকে। 

মাঞ্চিনিল গাছ; Source: Yinan Chen

সৌভাগ্যক্রমে সেবারের মতো রক্ষা পান নিকোলা এবং তার বন্ধুরা। খুব অল্প পরিমাণ ফল খাওয়ার ফলে বিষক্রিয়া তেমন প্রকট হয়নি। নিকোলা পরের বছর ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’ বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং এই বিষাক্ত ফলের কথা তুলে ধরেন। প্রায় ৮ ঘণ্টার অমানুষিক যন্ত্রণায় ভোগার পর ধীরে ধীরে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। তবে এই ফলের সবচেয়ে বিখ্যাত শিকার ছিলেন এক পরিব্রাজক। হুয়ান পন্স ডি লিওন নামক এই পরিব্রাজক ইউরোপীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম ফ্লোরিডা অভিযান করেন। ১৫১৩ সালে সেই অভিযানে তিনি সদলবলে স্থানীয় কালুসা যোদ্ধাদের কবলে পড়েন। সেবার তিনি পালিয়ে গেলেও ৮ বছর পর পুনরায় ফিরে আসেন। কিন্তু এবার তার আরো মর্মান্তিক পরিণতি হয়। এক স্থানীয় যোদ্ধার তীর তার বাম পায়ে এসে বিঁধে। সেই তীরের মুখে মাঞ্চিনিল গাছের বিষ মাখানো ছিল। ফলশ্রুতিতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। 

এই গাছের ফল এবং নির্যাসে Hippomanin A এবং B নামক বিষ রয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েকটি বিষের সন্ধান পাওয়া যায়, যার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও অবগত নন। বিজ্ঞানী ডেভিড নেলিসের মতে, কিছু কিছু বিষ সেবনের সাথে সাথে আক্রমণ করলেও বেশ কয়েকটি বিষ কিছুটা সময় নিয়ে রোগীকে আক্রান্ত করে। ফলে প্রাথমিক বিষক্রিয়া উপশম হলেও পরবর্তীতে রোগী পুনরায় অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।

যদি কেউ এই গাছের নির্যাস দ্বারা আক্রান্ত হন, সেক্ষেত্রে তার চামড়ায় এর প্রভাব দেখা যাবে। এর সাথে রোগী প্রচণ্ড মাথাব্যথা অনুভব করবেন। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার কথাও জানা যায়। এর কারণে, অনেক দ্বীপে এই গাছের কাণ্ড কিংবা বাকল স্পর্শ করাও নিষেধ করা হয়েছে। আর ফল সেবনের ক্ষেত্রে তলপেটে ব্যথা, বমি, রক্তপাতসহ আরো কয়েকটি লক্ষণ দেখা দেয়। যদিও এর মাধ্যমে মৃত্যু ঘটতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৃত্যুর ঝুঁকি সামান্য। কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও মাঞ্চিনিল গাছের আরেকটি ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। এই গাছের বিষ রোগীর দেহে টিউমারের জন্ম দিতে পারে, যার মাধ্যমে রোগীর প্রাণনাশের সম্ভাবনা প্রকট। 

মাঞ্চিনিল গাছের বিষাক্ত ফল; Source: Hans Hillewaert/CC BY-SA 3.0

তবে মাঞ্চিনিলের বিষাক্ততা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকেই হতবাক। সাধারণত কোনো গাছ তার নিজের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে তার কিছু অংশে বিষ উৎপন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে মাঞ্চিনিলের নির্যাসের বিষাক্ততাকে যৌক্তিক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আসল সমস্যা বাঁধে ফলের ক্ষেত্রে। কারণ, প্রতিটি গাছ তার নিজের বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে ফলের মাধ্যমে নিজের বীজ ছড়িয়ে থাকে। প্রাণীকূল গাছের ফল ভক্ষণ করে এবং মলত্যাগের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বীজ ছড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে জন্ম নেয় নতুন গাছ। কিন্তু মাঞ্চিনিলের ফলও বিষাক্ত। এর নামের অনুবাদ থেকে বোঝা যায়, এই ফল শুধু মানুষ নয়, ঘোড়ার মতো অন্যান্য প্রাণীর দেহেও বিষক্রিয়া করে থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে এর বেশ কিছু ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। নারিকেল গাছের ন্যায় মাঞ্চিনিল গাছও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে জন্ম নেয়। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই গাছের ফল সাগর জলে ভেসে বিভিন্ন দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে পরবর্তীতে ফলের মাংসল অংশ নষ্ট হয়ে গেলে বীজ উপযুক্ত উপাদানের সংস্পর্শে এসে বংশবিস্তার করে। 

মাঞ্চিনিল গাছে ইগুয়ানা; Source: Pixabay

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। দক্ষিণ ফ্লোরিডা অঞ্চলের স্থানীয় ইগুয়ানারা এই গাছের ফল নিশ্চিন্তে সেবন করতে পারে। কারণ, এদের দেহে এই বিষ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া টাম্পা বাঁদররাও এই ফল ভক্ষণ করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানী রজার হ্যামারের মতে, মাঞ্চিনিল গাছ প্রধানত সাগর জলের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। ইগুয়ানা এবং বাঁদর এর গৌণ বংশবিস্তার মাধ্যম। 

এতক্ষণ ধরে মাঞ্চিনিলের সকল ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে কথা বললেও, এই গাছের কিন্তু অনেক উপকারী দিক রয়েছে। সমুদ্র বিধৌত দ্বীপগুলো প্রায়ই জলোচ্ছ্বাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিভিন্ন ঝড়ের প্রকোপে ভূমি থেকে মূল্যবান মাটি ক্ষয় হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রক্ষাকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মাঞ্চিনিল গাছ। উদ্ভিদবিদগণের মতে, এক সারিতে মাঞ্চিনিল গাছ রোপণ করলে তা মাটির ক্ষয়রোধ করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয়দের শিকারের প্রধান অস্ত্র তীরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয় মাঞ্চিনিলের বিষ। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে কাঠমিস্ত্রীরা এই গাছ ব্যবহার করে আসবাবপত্র তৈরি করে থাকেন। গাছের নির্যাসের বিষ ধ্বংস করার জন্য তারা বেশ সতর্কতার সাথে গাছের কাঠ কেটে তা দীর্ঘদিন ধরে রোদে শুকাতে দেন। মাঞ্চিনিলের শুষ্ক ফলকে স্থানীয় কবিরাজরা মূত্রবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

সৈকতের বালিতে মাঞ্চিনিল ফলের একাকীঅবসর; Source: Mary Wiztig

মাঞ্চিনিল ফলের অতিমাত্রায় বিষাক্ততার ফলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, অন্যান্য বিখ্যাত বিষাক্ত গাছের তুলনায় এদের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কম। সামুদ্রিক ঝড়ের উত্তাল গতির সাথে পাঞ্জা লড়ে এরা টিকে আছে বছরের পর বছর ধরে। শুধু বিষের মাধ্যমে প্রাণিজগতের ক্ষতিসাধন করাই এর উদ্দেশ্য নয়। এর বিষ ব্যবহার করে চিকিৎসাশাস্ত্রে বহু উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। বিশেষ করে, নিরাপদ কীটনাশক উৎপাদন কিংবা ব্যথানাশক ঔষধ গবেষণায় এর অবদান রয়েছে। তবে যদি কখনও মাঞ্চিনিলের দেখা পেয়ে যান, তাহলে উল্টোপথে হাঁটতে একদম ভুলবেন না যেন।

ফিচার ইমেজ: Swordfish Island

Related Articles