Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পেঁচা: লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা নিঃসঙ্গ নিশাচর পাখি

পেঁচা নামটির সাথে আমরা কম বেশি সকলেই পরিচিত। পেঁচার কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় পড়া সুকুমার রায়ের ছড়াটি

 প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি,

খাসা তোর চ্যাঁচানি !

  শুনে শুনে আন্‌মন

নাচে মোর প্রাণমন !

(পেঁচা ও পেঁচানি কবিতার অংশবিশেষ)

সুকুমার রায়; Source: halfsamosa.in

কুসংস্কারময় একটি পাখির নাম হলো পেঁচা। পেঁচাকে নিয়ে পৃথিবী জুড়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। অনেক দেশ এবং ধর্মে পেঁচাকে একটি অশুভ পাখি হিসেবে দেখা হয়।। আবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী লক্ষ্মীর বাহন লক্ষ্মীপেঁচা। তাই ঘরের কোথাও লক্ষ্মীপেঁচা দেখা গেলে গৃহস্থ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে পাখিটা যাতে উড়ে চলে না যায়।

গাছের ডালে বসে লক্ষ্মীপেঁচা; Source: youtube.com

পৃথিবীজুড়ে এই পাখিটি নিয়ে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মধ্যযুগে ইউরোপে পেঁচাকে একটি অশুভ পাখি হিসেবে দেখা হতো। তাই এই পাখি দেখার সাথে সাথে পুড়িয়ে মারার প্রথা ছিল। কেনিয়ার একটি উপজাতি গোষ্ঠী রয়েছে যাদের কাছে এই পাখি চরম বিভীষিকা। তবে বর্তমানে পরিবেশবিদদের মতে, পেঁচা একটি পরিবেশবান্ধব পাখি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে এই পাখির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

গাছের একটি মোটা ডালে বসে থাকা একটি পেঁচা; Source: incepnow.com

পেঁচাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ভয় কাজ করার অন্যতম কারণ হলো এই পাখির দেখা খুব সহজে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে দিনের আলোতে পেঁচার দেখা পাওয়া এককথায় অসম্ভব। আর পেঁচা দেখতে অন্য যেকোনো পাখির চাইতে অনেকটাই ভিন্ন।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পেঁচা; Source: australiangeographic.com.au

নিশাচর পাখি পেঁচা অনেকটা নিঃসঙ্গও বটে। খুব একটা লোকসমুক্ষে তাদের বিচরণ নেই। নির্জন পরিবেশে থাকতেই পেঁচা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গাছের উঁচু মগডাল, ঘনপাতার আড়াল, পরিত্যক্ত বাড়ি, গাছের কোটর, অপেক্ষাকৃত অন্ধকার স্থানে পেঁচা বসবাস করে। মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে গুটিরে রাখার জন্যেই পেঁচার এই ব্যবস্থা।

পুরনো বাড়ির ফাঁকা কোটর থেকে উঁকি দেয়া একটি লক্ষ্মীপেঁচা; Source: hutumpechabolsi.blogspot.com

পেঁচা দেখতে অন্য যেকোনো পাখির চাইতে অনেকটাই আলাদা। পেঁচার মুখ অন্যান্য পাখির তুলনায় অনেক বড়, সামনের দিকের মুখটা অনেকটাই চ্যাপ্টা, আর দু’পাশের পাখনা অনেকটাই চওড়া। এদের অক্ষিগোলক অনেকটাই সামনের দিকে অগ্রসর থাকে যার কারণে এদেরকে দ্বিনেত্র বা ইংরেজিতে ‘বাইনোকুলার’ দৃষ্টির অধিকারী ধরা হয়। এদের চোখ দিনের আলোর উজ্জ্বলতা সহ্য করতে পারে না বলে দিনের আলোতে এরা বাইরে বের হয় না।

জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকা পেঁচা; Source: onuvromon.com

তবে পেঁচার শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। এই কারণে শিকারের জন্যে পেঁচা রাতের আঁধারকেই বেছে নেয়। শুধুমাত্র শব্দের উৎসের উপর ভিত্তি করেই এরা নিকশ অন্ধকারেও শিকার ধরতে সক্ষম। সামান্য মাথা ঘুরিয়েও এরা অনেক সময় অনেক সূক্ষ্ম শব্দ শনাক্ত করতে পারে। পেঁচার চোখের চারপাশে বৃত্তাকার কিছু পালক সাজানো থাকে। একে ইংরেজিতে ‘ফেসিয়াল ডিস্ক’ বলা হয়, যার কারণে এদের দুই কানে সামান্য আগে ও পরে শব্দ পৌঁছায়।

পেঁচার চোখের চারপাশে ফেসিয়াল ডিস্কের অবস্থান; Source: owls-perch.blogspot.com

আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, পেঁচা নিজের মাথাকে দুই দিকে মিলে ২৭০ ডিগ্রী পর্যন্ত ঘোরাতে পারে, যার ফলে নিজের কাঁধের উপর দিয়ে পেছনের দিকে অনেকটাই দেখতে পারে। তাই যেকোনো শিকার ধরতে বা কোনো বিপদের আভাস পেলে পেঁচা অনেক আগেই সতর্ক হয়ে যেতে পারে।

সাধারণত ছোট ছোট প্রাণী, যেমন- ইঁদুর, টিকটিকি, উড়ন্ত পাখি এবং বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার। কিছু প্রজাতির পেঁচা আবার উড়ে গিয়ে পানিতে ভাসমান মাছও শিকার করে খায়। এদের বাঁকানো ঠোঁট এবং নখের সাহায্যে এরা শিকার করে থাকে।

পেঁচার শিকার হওয়া একটি ইঁদুর; Source: audubon.org

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই পেঁচার দেখা পাওয়া যায়। তবে কুমেরু, গ্রীনল্যান্ড এবং এধরনের কিছু নিঃসঙ্গ দ্বীপে এদের উপস্থিতি চোখে পড়ে না।

পরিবেশবিদদের মতে, পৃথিবীজুড়ে ১৭০ এর অধিক প্রজাতির পেঁচা লক্ষ্য করা গেলেও বাংলাদেশে মোট ১৭ প্রজাতির পেঁচা রয়েছে যার মধ্যে ১৫ প্রজাতি স্থায়ীভাবে আমাদের দেশে অবস্থান করে। বাকি দুটি প্রজাতি পরিযায়ী, যার অর্থ হলো এরা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করে না। বিভিন্ন সময়ে পরিবেশের কারণে অথবা খাবারের উৎসের কারণে বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে।

একটি উড়ন্ত পেঁচা; Source: audubon.org

লক্ষ্মীপেঁচা,  খুড়ুলে পেঁচা, হুতুম পেঁচা, ভুতুম পেঁচা, কুপোখ এবং নিমপোখ পেঁচা অধিক দেখা যায়। প্রজাতি হিসেবে পেঁচার ডাকেরও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশে যেসকল পেঁচার দেখা পাওয়া যায় তাদেরকে দুটি গোত্রে ভাগ করা যায়। একটিকে বলা হয় সাধারণ পেঁচা যা স্ট্রিগিডি বংশের অন্তর্গত, আরেকটি হলো লক্ষ্মীপেঁচা যা টাইটোনিডি বংশের অন্তর্গত।

লক্ষ্মীপেঁচা; Source: redbubble.com

পেঁচা সাধারণত এপ্রিল থেকে নভেম্বর মসের দিকে প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। একটি স্ত্রী পেঁচা সংখ্যায় ২-৫টি ডিম দিয়ে থাকে। টানা ১২-১৪ দিনের মতো ডিমে তা দেয়ার পর ধীরে ধীরে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। ৩০ দিনের মাথায় বাচ্চাগুলোর গায়ে পালক গজায়। আর পরবর্তী এক মাসের মধ্যে এরা উড়তে শেখা শুরু করে।

পেঁচার ডিম ও একটি ফুটন্ত পেঁচা; Source: chrisowlcam.net

পেঁচা দেখতে স্বাভাবিক যেকোনো পাখির চাইতে  আকার-আকৃতিতে বড়। এদের বড় বড় দুটি গোলাকার চোখের কারণে এদেরকে অনেক সময় বিদঘুটে লাগে। রাতের আঁধারে এদের চোখগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে। ফলে রাতের বেলা পেঁচা দেখলে অনেকে ভয় পায়। তবে পেঁচা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। বরং ফসলের মাঠের পোকামাকড় খেয়ে শস্য রক্ষা করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পেঁচা; Source: miamidiscounttours.com

একটা সময় বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে প্রচুর পেঁচার ডাক শুনতে পাওয়া যেত। তবে মানুষের বৃদ্ধি, বাসযোগ্য স্থানের অপ্রতুলতা, খাদ্যসঙ্কটসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে দিনকে দিন কমে আসছে পেঁচার সংখ্যা। পেঁচা টিকিয়ে রাখার জন্যে পেঁচার বাসোপযোগী পরিবেশ তৈরি করা একান্ত কাম্য।

বাংলা সাহিত্যে পেঁচার এক অনন্য ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন লেখক নিজের লেখা গল্পে ও কবিতায় পেঁচাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্নভাবে। কালীপ্রসন্ন মজুমদার তার অসামান্য কীর্তি ‘হুতোম পেঁচার নকশা’র জন্যে বাংলা সাহিত্যে অমর ও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। এটি মূলত সমাজের বিভিন্ন অসংগতির উপর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক জাতীয় রচনা।

’হুতোম পেঁচার নকশা’র লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ; Source: sabjanta.inf

তবে গ্রামবাংলার সৌন্দর্যে বিমোহিত কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই পাখিটি ধরা পড়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রুপে। জীবনানন্দ দাশ এই পাখিটির সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে বিভিন্ন কবিতায় পেঁচার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। কবি তার ‘পেঁচা (মাঠের গল্প)’ কবিতার একাংশে উল্লেখ করেছেন-

আজ মনে পড়ে

সেদিনো এমনি গেছে ঘরে

প্রথম ফসল;-

মাঠে- মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,-

কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!-

হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে

 শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে ,

পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে ,

ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,

মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে

জাগে একা অঘ্রানের রাতে

এই পাখি!

ফিচার ইমেজ- hutumpechabolsi.blogspot.com

Related Articles