সিনেমার স্পাইডারম্যানের মতো মাকড়সার কামড় খেয়ে মাকড়সা-মানব বনে যাওয়ার উদ্ভট স্বপ্ন হয়তো শৈশবে আমরা সবাই কমবেশি দেখেছি। কিন্তু বাস্তবজীবনে মাকড়সা ভালো লাগে, এমন মানুষ কমই পাওয়া যায়।
ক্ষুদ্র আর নিরীহ এই আটপেয়ে প্রাণী কারো কোনোরূপ ক্ষতি করা দূরে থাক, মানুষের আগমন টের পেলেই পালিয়ে বেড়ায়। এই ঘটনার কোনো ব্যত্যয় ঘটে না পিকক স্পাইডারের ক্ষেত্রেও।
পিকক স্পাইডারও মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রম এই যে, এক্ষেত্রে মানুষই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একে ধরতে চাইবে, এর অদ্ভুত সৌন্দর্যের জন্য।
পিকক স্পাইডারের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ময়ূর মাকড়সা। আদতে এই মাকড়সা আসলেও দেখতে খানিকটা ময়ূরের মতোই। এই ক্ষুদে প্রাণীটির সাথে হয়তো আপনার পরিচয় নেই। কিন্তু পরিচয় হবার পর যে এর প্রতি আকৃষ্ট হবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
ঘন কালো চোখের উপর দোলায়মান রঙিন ভ্রু, সমান্তরাল নাক আর মুখ, দেখে মনে হবে যেন এর আসমানি রঙের চেহারার মাঝে শিশুর খেলনা পুতুলের মুখাবয়বের মতো করে কেউ এঁকে দিয়েছে।
মাথাভর্তি চুল সদৃশ সোনালি লোম আর দেহের পেছন দিকটা কালো, কুচকুচে কালো। না, কুচকুচে কালোর চেয়েও বেশি কালো, কৃষ্ণগহ্বরের কালোর কথা ভাবতে পারেন!
ভারী সুন্দর একটি চেহারা ছাড়াও আরো নানা কারণে এই খুদে প্রাণীটি আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। যেমন- এর নিঞ্জা স্টাইলের চালচলন, প্রখর বুদ্ধিমত্তা কিংবা বিপরীত লিঙ্গের মাকড়সার মন-জয়ে প্রেমিক পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, সবই কৌতূহল বাড়াবে।
তবে যৌন মিলনের জন্য এর ক্রিয়াকলাপ হয়তো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। প্রাণীজগতে, যৌন মিলনের জন্য কোনো প্রাণী গান গায়, নানারূপ উদ্ভট শব্দ করে, নৃত্য করে। কিন্তু, দেহত্বকের মাধ্যমে আলোক বিভ্রম তৈরী করে, এরূপ শুনেছেন কখনো? এই অদ্ভুত কাজটিই করে পুরুষ পিকক স্পাইডার।
পিকক স্পাইডারের বৈজ্ঞানিক নাম ম্যারাটাস ভোলানস। এই বিশেষ প্রজাতির মাকড়সাটি ছাড়াও ম্যারাটাস গণের অন্তর্ভুক্ত সকল প্রজাতিই কম-বেশি বিষাক্ত। তাদের মধ্যে ম্যারাটাস ভোলানস সবচেয়ে এগিয়ে। তথাপি মানুষের জন্য এটি কোনো হুমকি নয়।
এই মাকড়সার সবচেয়ে বড় এবং সুঠামদেহীরাও সর্বোচ্চ ০.৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে। ফলে খুদে এই প্রাণীর চোয়াল এতটা নরম এবং ছোট হয় যে, এটি মানুষের ত্বকে কামড়ই বসাতে পারে না!
পুরুষ ময়ূর মাকড়সাগুলো সাধারণত এদের লাল, নীল, কমলা, সোনালি ইত্যাদি বর্ণের জাঁকালো পশ্চাদ্দেশ দুলিয়ে দুলিয়ে নারী মাকড়সাকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু সম্প্রতি এই মাকড়সাটি আলোচনায় উঠে এসেছে এক গবেষণায় উঠে আসা বিস্ময় জাগানিয়া একটি তথ্য থেকে।
এই মাকড়সাগুলো তাদের নারী সঙ্গীদের যৌন মিলনে আকৃষ্ট করতে কেবল যে বাহারি রং ব্যবহার করে তা নয়, এরা এক প্রকার আলোক বিভ্রমও (অপটিক্যাল ইলিউশন) তৈরি করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী ডাকোটা ম্যাককয় তার ‘প্রোসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ম্যারাটাস গণের ভোলানস প্রজাতির এই মাকড়সাগুলোর পিঠের রঙিন ত্বকে যে কালো ছাপগুলো রয়েছে, সেগুলো কোনো সাধারণ কালো নয়। সেগুলোর তুলনা হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে কালো বস্তুর সাথে। আর এই কালো ছাপগুলোর কারণে এর গায়ের অন্যান্য রঙগুলো অধিক আকর্ষণীয় দেখায়, তৈরি হয় তীব্র আলোক বিভ্রম।
কিছুদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে একটি কথা ব্যাপক ভাইরাল হয়, “সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস”। এই ভাইরাল বাক্যটির সারমর্ম হলো এই যে, অত্যন্ত সাদামাটা, কিন্তু সুন্দর।
এই পিকক স্পাইডারগুলোর নিকষকালো রঙের রঙিন আলোক বিভ্রমকে ব্যাখ্যা করতে গবেষকরা ঠিক এ কথাই বলছেন, সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস! সাধারণ সময়ে এর রঙিন দেহত্বক, বিশেষ করে পিঠের, খুব বেশি চাকচিক্যময় মনে না হলেও আলোক বিভ্রমের সময় সেগুলো বিস্ময়করভাবে জাঁকালো হয়ে ওঠে।
এই মাকড়সার পিঠে পতিত আলোর ০.৫ শতাংশেরও কম প্রতিফলিত হতে পারে। ফলে, এর উপর যত উজ্জ্বল আলোই পতিত হোক না কেন, সেটি শোষিত হয়ে এমন এক আলোক-শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যা এর নিকটবর্তী সামান্যতম কোনো রঙের মাত্রাও চড়িয়ে দেয় বহুগুণে।
এক্ষেত্রে পিকক স্পাইডারের একমাত্র প্রাকৃতিক তুলনা হলো ‘বার্ডস অব প্যারাডাইজ’ নামক এক প্রজাতির পাখি। আলোক শোষণক্ষমতায় এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
বার্ডস অব প্যারাডাইজের পালকে এমন একপ্রকার আণুবীক্ষণিক কাঠামো রয়েছে, যা এর উপর পতিত আলোর সিংহভাগ ধরে রাখে। এই পাখির অস্বাভাবিক আলোক শোষণক্ষমতার উপর করা এক গবেষণায় সম্প্রতি এই তথ্য উঠে এসেছে।
মজার ব্যাপার হলো, টিপসইয়ের চেয়েও ছোট আকৃতির পিকক স্পাইডারগুলোর দেহত্বক পর্যবেক্ষণ করেও বিজ্ঞানীরা বার্ডস অব প্যারাডাইজের দেহের আণুবীক্ষণিক গঠন সদৃশ কিছু একটা পেয়েছেন।
যদি শেষতক এটি প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে ভাবুন একবার, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বর্গের, ভিন্ন গোত্রের, ভিন্ন গণের প্রজাতির মাঝে একইরকম দক্ষতা অভিযোজিত হয়েছে, দারুণ না ব্যাপারটা?
অদ্ভুত এ সামঞ্জস্য প্রমাণের আশায় ম্যাককয় এবং তার সহযোগীরা ম্যারাটাস গণের দুটি ময়ূর মাকড়সা প্রজাতি স্পেসিয়াস ও ক্যারি বেশকিছুদিন পর্যবেক্ষণ করেন। এ পর্যবেক্ষণে তারা দেখতে পান যে, উভয়ের কিউটিকলে, অর্থাৎ বহিত্বকে মেলানিন নামক একপ্রকার কালো রঞ্জক পদার্থ রয়েছে।
আর দেহের সেই ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক গঠনগুলো একপ্রকার মাইক্রোলেন্সের মতো কাজ করে এবং এর উপর পতিত আলোকে মেলানিন রঞ্জকে কেন্দ্রীভূত করে। মেলানিন সে আলোকে আর প্রতিফলিত হতে দেয় না। এর ফলে, উজ্জ্বল আলোকে এর দেহের কালো ছাপগুলো আরো উজ্জ্বল দেখায়।
এছাড়াও, এর ত্বকে আছে পাখির দেহের বারবিউলের মতো একপ্রকার আঁশ। সব মিলিয়ে যেন আলোক বিভ্রম তৈরির নিখুঁত যান্ত্রিক কলাকৌশল এর দেহ।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, যদি কোনোভাবে এ মাকড়সাগুলোর পিঠের অতি কালো ছাপগুলো ঢেকে এর উপর তীব্র আলো প্রয়োগ করা হয়, এর ত্বকের অন্যান্য রংগুলো তখন ততটা উজ্জ্বল মনে হয় না।
অথচ, সম-তীব্রতার আলোকে কালো ছাপগুলো উন্মুক্ত থাকলে ত্বকের অন্যান্য রংগুলো অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং অস্বাভাবিক রকম সুন্দর দেখায়। এর কারণ হলো- আলোক বিভ্রম, যা কালো ছাপগুলোর কল্যাণে ঘটে।
অতি কালো বর্ণ ধারণের এ ঘটনা প্রাণিজগতের বেশকিছু প্রাণীর মাঝেই দেখা যায়। গভীর সমুদ্রে কিছু মাছ শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এরূপ অতি কালো বর্ণ ধারণ করে, প্রজাপতি শিকারকে সুযোগমতো ধরবার জন্যও এরূপ বর্ণ ধারণ করে।
তবে, বার্ডস অব প্যারাডাইজ কিংবা পিকক স্পাইডারগুলো এই প্রাকৃতিক বিস্ময় ব্যবহার করে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীকে আকৃষ্ট করবার জন্য, যা প্রাণিজগতে বিরল। গবেষকরা আশা করছেন, পিকক স্পাইডারের অতি কালো বর্ণ বিভ্রমের রহস্য পুরোপুরি উন্মোচন হলে প্রাণিজগতে যৌন মিলনে আকৃষ্ট করতে রঙের ব্যবহারের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত গবেষণার পথ উন্মোচিত হবে।
এদিকে, পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ আলোক শোষণক্ষমতার অধিকারী বস্তুটির নাম হলো ‘ভেন্টাব্ল্যাক’। কার্বন ন্যানোটিউবে তৈরি করা মানবসৃষ্ট এ পদার্থটি এর উপর পতিত আলোর ৯৯.৯৬৫ শতাংশ আলো শোষণ করে নিতে সক্ষম।
কিন্তু, প্রকৃতিতে কোনো প্রাণীর দেহত্বক ০.৫ শতাংশ শোষণ করে নিতে পারে, সেটা একটা বিস্ময়ই বটে। কেননা, প্রাণীদেহের ত্বক সাধারণত এত বেশি পরিমাণ আলো শোষণক্ষম হয় না এর অসম গঠনের কারণে।
অথচ পিকক স্পাইডারের ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। এই মাকড়সার ত্বকের উঁচুনিচু গঠন বরং এর উপর পতিত আলো এর মাইক্রোলেন্সে আবদ্ধ করতে সহায়তা করে। আর মাইক্রোলেন্স আলোকে মেলানিন রঞ্জকে ফোকাস করলে সেটি আর প্রতিফলিত হতে পারে না।
যে সামান্য অংশ প্রতিফলিত হয়, তা-ও সেই উঁচুনিচু গঠনের কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আর সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অতি কালো আলোক বিভ্রম, যা অন্যান্য রংগুলোকে করে তোলে আরো মায়াবী।
মজার ব্যাপার হলো, নারী সঙ্গীকে আকৃষ্ট করবার জন্য পিকক স্পাইডারের দেহের এই প্রাকৃতিক কৌশলও যথেষ্ট নয়। প্রাণিজগতের অন্য অনেক প্রাণীর মতই এই মাকড়সাও এর আটটি পা নেড়েচেড়ে উপর্যুপরি নৃত্য করে।
নৃত্যের নানা পর্যায়ে যখন দুটি পা আকাশপানে বাড়িয়ে দিয়ে ক্রমাগত নাড়াতে থাকে, তখন মনে হয় যেন সে তার নারী সঙ্গীর প্রতি দু হাত তুলে অনুযোগ জানাচ্ছে।
মেলানিন রঞ্জক, ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক গঠন, মাইক্রোলেন্স, দেহত্বকের অসমান গঠন, এতসব ব্যবস্থা থাকার পরও আলোক বিভ্রম যথেষ্ট তীব্রতা পায় না এর নাচ ব্যতীত। হাত-পা নাড়ানো কিংবা পশ্চাদ্দেদেশের অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি, সবকিছুই আলোক বিভ্রমকে পূর্ণতা দেয়।
নাচের বিভিন্ন ধাপে আলোক বিভ্রমের তীব্রতা ওঠানামা করে এবং এর দেহের রঙিন বর্ণগুলোর রঙও যেন পরিবর্তিত হতে থাকে। আর সব মিলিয়ে যে মায়া তৈরি হয়, সে মায়া কাটানো নারী মাকড়সাগুলোর জন্য দুঃসাধ্যই বটে!
মাকড়সা সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি
This article is written in Bangla language.
It's about a spider that has unique feature of creating optical illusion.
Necessary References are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Youtube.com