Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গহীন অরণ্যের ৮টি বিচিত্র প্রাণীর গল্প

প্রাণী জগতে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। যদিও সাধারণভাবে কয়েকটি পরিচিত প্রাণী ব্যতীত অন্যদের খবর আমরা বিশেষ রাখি না। অথচ এই পৃথিবীতে এমন অজস্র প্রাণী আছে যারা বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। গহীন বনে থাকার কারণে, আবার কেউবা স্রেফ মানুষের কৌতুহলের আড়ালে চলে যাওয়ার কারণে হয়তো তারা খুব বেশি মনোযোগ কাড়তে পারেনি। আজ এমনই কয়েকটি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাবিরুসা

ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে গহীন বনে ঢাকা অসংখ্য দ্বীপ। আর এই বনের মধ্যে সন্তপর্ণে ঘুরে বেড়ায় বাবিরুসা নামের এই বিচিত্র প্রাণীটি। দূর থেকে দেখলে হঠাৎ মনে হবে প্রাগৈতিহাসিক কোনো প্রাণী বুঝি চড়ে বেড়াচ্ছে সামনে। এমন মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে বাবিরুসার সামনের দু’পাটি দাঁত। শূকর গোত্রীয় এই প্রাণীগুলোর সামনের দাতঁ দুটি আর দশটা শূকরের মতোই অনেক লম্বা। তবে বাবিরুসার বিশেষত্ব হচ্ছে- এদের সামনের এই খড়গ ছাড়াও আরো দুটি দাঁত বড় হতে হতে মুখের ওপরের অংশের মাংস চামড়া ভেদ করে বাইরে চলে আসে। এই মস্ত বাকানোঁ বাড়তি খড়গের কারণেই এদের চেহারা দেখতে এমন।

বাবিরুসা; ছবিসূত্র: naturephoto-cz.com

ইন্দোনেশিয়ার সুলু, বুরা আর সুলাওয়েসী দ্বীপের জঙ্গলে বাবিরুসাদের দেখা মেলে। এছাড়া হাজার হাজার বছরের পুরানো বহু গুহাচিত্রে বাবিরুসার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ক্রমাগত জঙ্গল আর বাসভূমি ধ্বংসের কারণে এই প্রাণীগুলো বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে।

ওকাপি

ধরা যাক, আপনি কঙ্গোর গহীন জঙ্গলে ঘুরতে গেলেন। আপনার ভাগ্য খুব ভালো থাকলে দেখা পেয়ে যাবেন ওকাপির। ওকাপি কী? একটি জেব্রা আর জিরাফের মিশ্রণ ঘটলে যে কিম্ভুত প্রাণীটি সৃষ্টি হতে পারে, সেটাই ওকাপি। এরা দূর থেকে দেখতে ঘোড়ার মতো। পাগুলোতে আবার জেব্রার মতো সাদা-কালো ডোরাকাটা। আর দেহের বাকি অংশের রঙ চকলেট বাদামী। জেব্রা বা ঘোড়ার মতো দেখতে হলেও প্রজাতিগতভাবে ওকাপি কিন্তু জিরাফের সমগোত্রীয় প্রাণী। এদের দেহের উচ্চতা হয় প্রায় পাচঁ ফুটের মতো।

ওকাপি; ছবিসূত্র: Wildlife conservation network

২০ শতকের আগে ওকাপির কথা কেউ জানতো না। বিখ্যাত অভিযাত্রী হেনরী মর্টন স্ট্যানলী সহ অনেকেই এই জেব্রাসদৃশ প্রাণীর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নিভৃতচারী এই প্রাণীটির দর্শন পাওয়া সহজ কথা নয় বলেই হয়তবা গবেষকেরা ওকাপিকে ‘একধরনের বনের জেব্রা’ বলেই সন্তুষ্টি লাভ করেছেন। পরে উগান্ডার গভর্নর স্যার হ্যারি জনস্টন ওকাপির চামড়া সংগ্রহে সক্ষম হন। ১৯০১ সালে ওকাপির অস্তিত্ব পশ্চিমা বিশ্ব স্বীকার করে নেয়।

তৃণভোজী এই প্রাণীগুলো দিনে চড়ে বেড়ায়। পুরুষ ওকাপিদের নিজস্ব এলাকা থাকে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত কঙ্গোতে ওকাপিরা খুব একটা ভাল নেই। চোরাশিকারী আর বন কাটার ফলে সুন্দর এই প্রাণীগুলোর সংখ্যা দ্রুত কমে চলেছে।

সাইগা অ্যান্টিলোপ

সাইগা অ্যান্টিলোপের আবাস হলো সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়ার কিছু অঞ্চল, কাজাখস্থান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের ঊষর ভূমিতে। দল বেঁধে চরে বেড়ানো এই তৃণভোজী প্রাণীগুলোর সবচেয়ে বিচিত্র অংশ হচ্ছে এদের নাক। দূর থেকে দেখলে চমকে যেতে হবে, কারণ নাক দুটি যেন ছোট্ট একটা শুঁড়।

নাক তো নয়, যেন শুঁড়; ছবিসূত্র: i.imgur.com

তিন ফুটের মতো উঁচু এই প্রাণীগুলোর মধ্যে শুধু পুরুষদের শক্ত, মোটা শিং গজায়। ১৮৫০ সাল থেকে শিংয়ের লোভে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয় সাইগা অ্যান্টিলোপদেরকে। সোভিয়েত আমলে এদের সংখ্যা ২০ লক্ষে পৌঁছালেও বর্তমানে তা আবার কমে ৫০ হাজারে এসে ঠেকেছে। কয়েকটি বিধ্বংসী মড়কের কারণে এই অবস্থা।

ফোসা

বেড়াল আর কুকুরের মাঝামাঝি দেখতে এই প্রাণীটির ৬ ফুট লম্বা শরীরের অর্ধেকটাই লেজ। লালচে বাদামী প্রাণীটি থাকে আফ্রিকার দ্বীপ মাদাগাস্কারে। এদের নিজস্ব সীমানা থাকে। প্রজননকালে স্ত্রী ফোয়া একটা নির্দিষ্ট গাছে চড়ে বসে। গাছের নীচে এলাকার সমস্ত পুরুষ ফোসা জড় হলে তখন সে একজন সঙ্গী পছন্দ করে নেয়। ভয় পেলে এদের গ্ল্যান্ড থেকে একধরনের গন্ধযুক্ত তরল নিঃসৃত হয়।

মাদাগাস্কারের খলনায়ক এই ফোসা; ছবিসূত্র: zoo atlanta

নিশাচর এই প্রাণীগুলো দেখতে খুব সুন্দর হলে কী হবে, লেমুর এবং অন্যান্য ছোটখাটো প্রাণীদের জন্য এটি সাক্ষাত যম। মাদাগাস্কারের সবচেয়ে বড় শিকারী প্রাণী ফোসাদেরকে স্থানীয়রা খুব একটা সুনজরে দেখে না। প্রবাদ আছে, ফোসারা নাকি কাউকে চেটে দিলে সে অবশ হয়ে যায়। তখন ফোসা এই অবশ মানুষটিকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলে। এসব কুসংস্কার ছাড়াও ফোসারা হাসঁ মুরগী তুলে নেয়, এই অভিযোগে হরদম শিকার করা হয় এই প্রাণীটিকে।

অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র মাদাগাস্কারে কিং জুলিয়ান এবং তার লেমুরের দল জনৈক ফোসার ভয়ে তটস্থ থাকতে দেখা যায়। মাদাগাস্কারের গল্প-উপকথায় ফোসার উপস্থিতি লক্ষণীয়।

পাপুয়া নিউ গিনির বিশালকায় ইদুঁর

পাপুয়া নিউ গিনি রাষ্ট্রটি ঢাকা গহীন বনে পূর্ণ মস্ত মস্ত সব পাহাড়-পর্বতে। বৈজ্ঞানিকদের ক্ষুরধার দৃষ্টি এখনো এই অজানা অঞ্চল এর সব রহস্য ভেদ করতে পারেনি, প্রতি বছরই এই জঙ্গুলে দেশটি থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতির প্রাণী।

এমনই একটি অজানা অঞ্চল হচ্ছে মাউন্ট বোসাভি। আদতে এটি একটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। এখানেই ২০০৯ সালে বিবিসি আর বৈজ্ঞানিকদের দল খুঁজে পান প্রকান্ড এই ইঁদুরটিকে। প্রায় তিন ফুট লম্বা আর দেড় কেজি ওজনের দশাসই এই ইদুঁর অবশ্য মানুষের প্রতি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তাকে দিব্যি কোলে-পিঠে নেওয়া যায়। এহেন নিরীহ দশা হওয়ার পেছনে কারণটাও অদ্ভুত। মাউন্ট বোসাভির জ্বালামুখখানা ঘিরে রেখেছে প্রায় আধা মাইল লম্বা খাড়া প্রাকৃতিক দেওয়াল। ঘের দেওয়া এই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত প্রাণীজগত যাদের সদস্যরা মানুষ ভয় পায় না। কারণ জীবদ্দশায় তাদের অনেকেই মানুষের টিকিটিও দেখেনি।

মাউন্ট বোসাভির বিশালকায় ইদুঁর; ছবিসূত্র : insider.si.edu

ধুসর রঙের লোমশ এই ইদুঁরটি ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপের বিশালকায় ইদুঁরের সমগোত্রীয়। শার্লক হোমসের লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এই প্রজাতির ইদুঁর আর শার্লক হোমসকে জড়িয়ে একটি গল্প লেখার পরিকল্পনা করলেও শেষমেষ তা আর লেখেননি।

আয় আয়

না, কাউকে আসতে বলা হচ্ছে না। আয় আয় হচ্ছে লেমুর গোত্রীয় প্রাণী। সোজা বাংলায় একপ্রকার বানর। তবে এরা আর দশটা বানরের প্রজাতির থেকে আলাদা।

নিশাচর এই প্রাণীগুলো গাছে থাকে। কাঠঠোকরার মতোই এরা গাছের ফাঁপা কান্ড থেকে পোকামাকড় বের করে আনে। আয় আয়দের সামনের পায়ে সরু একটি আঙ্গুল থাকে, এ দিয়েই তারা পোকামাকড় টেনে বের করে। মাদাগাস্কার দ্বীপে এই ধূসর, সাদা, কালো আর বাদামী রঙের মিশ্রণের প্রাণীগুলোকে দেখা যায়। লম্বায় এরা ৪০ সেন্টিমিটারের মতো হয়।

গভীর রাতে জঙ্গলে টহল দেয় আয় আয়রা; ছবিসূত্র: lemur.duke.edu

১৯৩৩ সাল নাগাদ আয় আয়কে বিলুপ্ত ধরা হয়েছিলো, যদিও পরে ১৯৫৭ সালে এরা নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। মাদাগাস্কারের মানুষেরা আয় আয়কে অশুভ শক্তির বাহক মনে করে। লোকজ বিশ্বাস, আয় আয় তার হাতের সরু আঙ্গুলটি কারো দিকে নির্দেশ করলে সে মারা যাবে। এছাড়াও আয় আয়রা নাকি গভীর রাতে ঘরে ঢুকে আঙ্গুল দিয়ে মানুষের গলা ফুটো করে দেয়। এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ব্যাপক হত্যা চালানোর ফলে বর্তমানে আয় আয়দের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে।

এশীয় চিতা

আফ্রিকার চিতাদের কথা আমরা সবাই জানি। এই চিতারই আরেকটি প্রজাতি এখনো এশিয়া মহাদেশে টিকে আছে। একটা সময় ভারত, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া, আরব অঞ্চলে হয়ে সুদূর তুরস্ক পর্যন্ত এদের দেখা মিলতো। তবে সুন্দর চামড়ার জন্য দেদার শিকার আর যুদ্ধের ফেরে পড়ে এরা সত্তরের দশকে তুরস্ক থেকে, আশির দশকে মধ্য এশিয়া আর সেই পঞ্চাশের দশকেই ভারত থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এশীয় চিতা, সাকুল্যে পঞ্চাশটিও আর টিকে আছে কিনা সন্দেহ; ছবিসূত্র: Tehran Times

বর্তমানে এদের দেখা মেলে কেবল ইরানের মধ্যভাগের বিস্তীর্ণ ঊষর অঞ্চলে। বন্য অবস্থায় এদের সংখ্যা বর্তমানে পঞ্চাশটিরও কম। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে এদের সংখ্যা সেখানেও দ্রুত কমছে। ইরান সরকার অবশ্য এদেরকে রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। স্বভাব চরিত্রে এরা আফ্রিকার চিতাদের মতোই। অনেকে বলেন মোঘল সম্রাট আকবরের নাকি এক হাজারের বেশি পোষা শিকারী চিতা ছিল। ব্রিটিশ আমলে ভারতে এই চিতাদের নিয়ে শিকারে যাওয়ার প্রথা খুবই জনপ্রিয় ছিল। ব্রিটিশরা এদেরকে ‘হান্টিং লেপার্ড’ বলতো।

কেশরওয়ালা নেকড়ে

সিংহের কেশর থাকে। কিন্তু একটি নেকড়ে যদি কেশর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে তাহলে সেটা দেখতে বড্ড অদ্ভুত লাগবে বৈকি।

দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতের পাদদেশ ব্রাজিল আর পেরুর দক্ষিণাঞ্চল, আর্জেন্টিনার উত্তর ভাগ আর বলিভিয়ায় এই অদ্ভুত প্রাণীটি ঘুরে বেড়ায়। নামের সাথে মানানসই একটি কালো কেশর থাকে ঘাড়ের ওপরে। লম্বায় প্রায় তিন ফুট উচ্চতার এই প্রাণীগুলো একাকী শিকার করে। মানুষ দেখলেই দৌড়ে পালায়। এককালে কেশরের লোভে এদেরকে গুলি করে মারা হত।

নামে নেকড়ে হলেও স্বভাবে অতিশয় লাজুক এই প্রাণীগুলো; ছবিসূত্র: nationalzoo.si.edu

নাম কেশরওয়ালা নেকড়ে হলেও আদতে এরা কিন্তু নেকড়ে বা শেয়াল নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজাতি। ছোটখাটো তৃণভোজী প্রাণী এদের খাদ্য। আবাস ধ্বংসের কারণে এদের সংখ্যা দ্রুত কমছে। উচ্চতায় এরা তিন ফুটের মতো হয়, আর লম্বায় পাঁচ ফুট। ১৫ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে এরা।

ফিচার ইমেজ: rainforesttrust.org

Related Articles