Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশে প্রাপ্ত হরিণ প্রজাতির কথা

হরিণ একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা গরু ছাগলের মতো রোমন্থন করতে পারে। সাধারণত অন্যান্য রোমন্থক প্রাণীর মতো এদেরও পাকস্থলী ৪ প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট। এরা সাধারণত ঘাস, লতাপাতা, ফলমূল ইত্যাদি খায়। হরিণের উপরের পাটিতে কর্তন দন্তের পরিবর্তে শক্ত প্যালেট (তালুর সম্মুখ অংশ) থাকে। চীনের জলজ হরিণ প্রজাতি ছাড়া সকল পুরুষ হরিণের মাথায় শাখাযুক্ত শিং থাকে। হরিণের শিংকে অ্যান্টলার বলে। হরিণের প্রজননের সাথে অ্যান্টলারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। পুরুষ হরিণ অন্য হরিণের সাথে লড়াই করে স্ত্রী হরিণকে আকৃষ্ট করে। প্রতি বছরই প্রজনন মৌসুমের শেষের দিকে অ্যান্টলার খসে পড়ে।

হরিণ; Source: bladesofgreen.com

Artiodactyla বর্গের Cervidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হরিণকে প্রায় সারা বিশ্বে পাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত শীতল পরিবেশের কারণে এন্টার্কটিকা মহাদেশে কোনো হরিণ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মহাদেশে একাধিক প্রজাতি ও উপপ্রজাতির হরিণ পাওয়া গেলেও সমগ্র আফ্রিকায় শুধুমাত্র এক প্রজাতির হরিণের দেখা মেলে। সারাবিশ্বে প্রাপ্ত হরিণের প্রজাতিকে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এই শেণীতে ৬০টিরও অধিক উপপ্রজাতির হরিণ রয়েছে। বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির হরিণ পাওয়া যেত। এগুলো হচ্ছে সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, বারোশিঙা হরিণ ও পারা হরিণ। এদের মধ্যে শেষ দুটি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজকে জানাবো বাংলাদেশে প্রাপ্ত হরিণ প্রজাতিগুলো সম্পর্কে।

সাম্বার হরিণ

সাম্বার হরিণ এশিয়া মহাদেশ তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম হরিণ প্রজাতি। বাংলাদেশ ছাড়াও এটি ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। এই হরিণ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে বাস করে। Rusa unicolor হচ্ছে সাম্বার হরিণের বৈজ্ঞানিক নাম।

জলের কাছে সাম্বার হরিণ; Source: enacademic.com

সাম্বার হরিণের ৭টি উপপ্রজাতি রয়েছে। পুরুষ হরিণ আকারে স্ত্রী হরিণে চেয়ে বড় হয়। একটি পুরুষ হরিণ উচ্চতায় ৪০-৬৩ ইঞ্চি ও লম্বায় ৫.৩-৮.৯ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। একটি পরিণত বয়সের সাম্বার হরিণের ওজন ৫৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের শরীর হলদে বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী বর্ণের লোম দ্বারা আবৃত থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই লোম কালচে অথবা পুরোপুরি কালো বর্ণ ধারণ করতে পারে।

বয়স বাড়ায় শরীরের বর্ণ পরিবর্তন; Source: noer.gov.in

পানির উপর সাম্বার হরিণের নির্ভরতা অনেক বেশি। এজন্য এদের আবাসের পাশে জলাধারও থাকতে হয়। এরা ভাল সাঁতারও কাটতে পারে। নিয়মিত পানিতে গোসল করে। গোসলের সময় শুধুমাত্র অ্যান্টলার এবং মুখ কিছুটা ভেসে থাকে। এই হরিণ সারা বছর ধরে প্রজনন করলেও সেপ্টেম্বর-জানুয়ারি মাস হচ্ছে তাদের অধিকতর পছন্দণীয় সময়। প্রজননকালীন একটি পুরুষ ৬টির অধিক স্ত্রী হরিণের সাথে মিলিত হতে পারে। সাম্বার হরিণের গর্ভকাল ৮-৯ মাস। এরা সাধারণত একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে অনেক সময় দুটি বাচ্চাও প্রসব করতে পারে।

সন্ধ্যা ও রাতে বিচরণশীল এই হরিণকে সাধারণত মাংস ও অ্যান্টলারের জন্য চোরাকারবারীরা শিকার করে থাকে। হরিণের মাংসকে বলা হয় ভেনিসন। এছাড়াও চিতাবাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ডোল কর্তৃক শিকারে পরিণত হয়। ফলে এই হরিণের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ডোল হচ্ছে এশিয়ার একধরনের বন্য কুকুর।

মায়া হরিণ

মায়া হরিণ বাংলাদেশে প্রাপ্ত হরিণ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে ছোট। হরিণটি ভীত স্বভাবের ও মায়াবী দৃষ্টির অধিকারী। এই হরিণ বাংলাদেশের সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, কম্বোডিয়া, চীন, হংকং, ভারত, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম সহ প্রভৃতি দেশেও দেখা যায়। হরিণটির দুটি প্রজাতির নাম জানা যায়। একটি হচ্ছে লাল মুন্তজাক এবং অপরটি হচ্ছে ফায়া’স মুন্তজাক। হরিণটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Muntiacus muntjak curvostylis

মায়া হরিণ © Thomas 2008

বিপদে পড়লে মায়া হরিণ উচ্চ ও তীক্ষ্ণ স্বরে ঘেউ ঘেউ করে ডাকে। এই শব্দ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এজন্য মায়া হরিণকে বার্কিং ডিয়ার বা ঘেউ ঘেউ করা হরিণও বলা হয়। সংকেত প্রেরণের জন্য এই হরিণ লেজও নাড়ায়।

মায়া হরিণের শরীর ছোট সোনালী আভাযুক্ত লোমে আবৃত থাকে। সাধারণত শীতল পরিবেশে থাকলে এদের শরীরের লোম ঘন হয়। কিন্তু উষ্ণ পরিবেশে থাকলে শরীরের লোম পাতলা হয়। পুরুষ হরিণের ছোট অ্যান্টলার থাকে। এই হরিণ ৩৫-৫৩ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা ও ১৫-২৫ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। অন্যান্য হরিণগুলো ঘাস, লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করলেও এরা সর্বভুক। এরা পাখির ডিমও খায়।

মায়া হরিণের লম্বা ছেদন দাঁত © Thomas 2008

মায়া হরিণের ওজন ৩৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই হরিণের উপরের পাটি থেকে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা ছেদন দাঁত বের হয়। এই দাঁত আত্মরক্ষা ও প্রজননের জন্য স্ত্রী হরিণকে আকড়ে ধরতে ব্যবহার করে। মায়া হরিণ এক বছর বয়সেই প্রজননক্ষম হয়। এরা ৭ মাস বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে একটি বাচ্চা প্রসব করে।

চিত্রা হরিণ

চিত্রা হরিণকে গভীর জঙ্গল ও তৃণাচ্ছাদিত ভূমিতে বিচরণ করতে দেখা যায়। এই হরিণ জন্মগতভাবে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রাণী। এই হরিণের শরীর লালচে বাদামী বর্ণের লোম দ্বারা আবৃত থাকে। এছাড়াও সাদা বর্ণের ডোরাকাটা দাগ থাকায় এদের ডোরাকাটা হরিণও বলা হয়। Cervus axis অথবা Axis axis হচ্ছে হরিণটির বৈজ্ঞানিক নাম।

চিত্রা হরিণ; Source: indwildventures.co.in

এই হরিণ ৩৫-৩৭ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। পুরুষ হরিণের শাখাযুক্ত অ্যান্টলার থাকে যা ৩৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা ঘাস, লতাপাতা ও ফলমূল খায়। এছাড়াও দিনে অন্তত একবার পানি পান করে। হনুমান ও বানর জাতীয় প্রাণীদের সাথে এদের বন্ধুত্ব রয়েছে। এসকল প্রাণীর ফেলে দেয়া পাতা ও ফলমূলের জন্য দলবেঁধে এই হরিণ গাছতলায় আসে। এছাড়াও কোনো বিপদের সম্ভাবনা বুঝতে পারলে প্রাণীগুলো উঁচু গাছ থেকে হরিণদের পালিয়ে যেতে সংকেত দেয়।

বন্ধুত্ব (মেলাকা চিড়িয়াখানা, মালয়েশিয়া); Source: nydailynews.com

চিত্রা হরিণ প্রায় সারাবছরই প্রজননের জন্য প্রস্তুত থাকে। এদের গর্ভধারণকাল ২২৫-২৩৫ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা সচরাচর একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে কালেভদ্রে দুটি বাচ্চাও প্রসব করে। সংখ্যায় হ্রাস পেতে থাকলেও এখনও এই হরিণ প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে এই হরিণ পারিবারিকভাবে পালন করার অনুমতি রয়েছে।

বারোশিঙা হরিণ

একসময় বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে প্রায় ৪ ফুট উঁচু বাদামী হরিণ দেখা যেত। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে হরিণটি বিলুপ্ত হয়েছে। ভারতে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করার ফলে ৬৭টি জীবিত হরিণ থেকে জন্মানো ৩৫০-৪০০টি হরিণ টিকে আছে বলে জানা যায়। এছাড়া নেপালেও এই প্রজাতির কিছু হরিণ রয়েছে।

দেশের বিলুপ্ত বারোশিঙা হরিণের বিশেষ অ্যান্টলার; Source: diana-hunting.com

অ্যান্টলারে থাকা চোখা মাথাগুলোর সংখ্যার হিসাব থেকে হরিণটির নামকরণ করা হয়েছে বারোশিঙা। কিন্তু বারোশিঙা বলা হলেও অ্যান্টলারে ১০-১৬টি চোখা প্রান্ত থাকে। হরিণটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Cervus duvauceli

পারা হরিণ

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া আরেকটি হরিণ হচ্ছে পারা হরিণ। হরিণটি ঝোপের ভিতর দিয়ে শূকরের মতো মাথা নিচু করে দৌঁড়ায়। তাই এদের হগ ডিয়ারও বলা হয়।

বাংলাদেশের বিলুপ্ত হরিণ পারা; Source: woodclix.com

Axis porcinus বৈজ্ঞানিক নামের হরিণটি ২৪-২৯ ইঞ্চি উঁচু ও ৩৬-৪৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা তেমন দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে না। ঘাস, লতাপাতা খেলেও ক্ষেতের শস্য খাওয়ার লোভ ছিল বেশি। আবার রাতের চেয়ে দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করার কারণেই কৃষকরা এদের হত্যা করতো। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারতের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম মায়ানমার হরিণটির জন্মগত আবাস ভূমি ছিল। পরবর্তীতে এসব দেশ, বিশেষত ভারত, থেকে বিভিন্ন দেশে হরিণটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ফিচার ইমেজ – cntraveller.in

Related Articles