এই পৃথিবীর প্রাণীজগত কতই না বৈচিত্র্যময়! বিচিত্র স্বভাবের হাজারো প্রাণী ছড়িয়ে রয়েছে এই পৃথিবীজুড়ে। প্রকৃতির খেয়ালেই অনেক প্রজাতির প্রাণী তার নিকটাত্মীয়দের চেয়ে আলাদা। আকৃতি এবং আচার-আচরণে নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তারা দিব্যি বেঁচে রয়েছে এই পৃথিবীতে। আর এই অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণীরা মানুষকে অবাক করেছে সবচেয়ে বেশি। কোনো বানরের গোঁফ দেখতে প্রাচীনকালের কোনো সম্রাটের মতো, আবার কোনো মাছ দেখতে জলজ গাছের মতো, কোনোটা সাপের মতো, আবার কোনো প্রাণী যেন সাক্ষাৎ ‘শয়তানের দূত’! এমনই কিছু প্রাণীর সন্ধানে আজকের আয়োজন।
এম্পারর ট্যামারিন
বানর প্রজাতির এই প্রাণীটি তার গোঁফের জন্য বিখ্যাত। এদের গোঁফজোড়া দেখতে অনেকটা সম্রাটদের মতো হওয়ায় সম্রাটের নামেই এর নাম রাখা হয় ‘এম্পারর ট্যামারিন’। আমাজন অববাহিকা, পেরু, বলিভিয়া, ব্রাজিলের বেশ কিছু জায়গা এদের প্রকৃত আবাসভূমি। এদের গায়ের রং ধূসর আর বুকে একধরনের হলুদ ব্যান্ড থাকে। সাদা গোঁফজোড়া দুদিকে মেলে রাখলে দু’কাঁধ ছাড়িয়ে যায়।
পিঙ্ক ফেয়ারি আর্মাডিলো
প্রাণীটি আর্জেন্টিনায় দেখতে পাওয়া যায়। মধ্য আর্জেন্টিনার বিস্তৃত সমতল ভূমি এবং তার আশপাশের ঘাসজমি এর বিচরণক্ষেত্র। এদের পিঠে শক্ত বর্মের মতো আবরণ থাকে। এরা বিশেষ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী। বৈজ্ঞানিক নাম Chlamyphorus truncates। আর্মাডিলোরই ক্ষুদ্রতম প্রজাতিই হচ্ছে পিঙ্ক ফেয়ারি আর্মাডিলো।
এরা বালির মধ্যে খুব দ্রুত চলাচল করতে পারে, অনেকটা সাঁতার কাটার মতো। কোনো বিপদ দেখলে কিংবা ভয় পেলে বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে এদের মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। পিঁপড়ের লার্ভা এদের প্রিয় খাদ্য। আর তাই পিঁপড়ের বাসার আশপাশে গর্ত খুঁড়ে এদের বাস করতে দেখা যায়।
সান বেয়ার
সান বেয়ার পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাতির ভালুক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনভূমিতে দেখতে পাওয়া যায় এদেরকে।এদের বৈজ্ঞানিক নাম Helarctos malayanus। একেকটি সান বেয়ারের গড় দৈর্ঘ্য চার ফুট, দেহের ওজন প্রায় ৬৫ কেজির মতো। এদের লোম ছোট এবং রেশমি। এই প্রজাতির ভালুকদের বুক, নাক ও চোখের পাশে কমলা-হলুদ রঙের ঘোড়ার খুরের মতো একটি ছাপ থাকে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্য প্রজাতির ভালুকদের থেকে এদের আলাদা করে চেনা যায়। এই দাগের জন্যই হয়তো এদের এমন নাম। ২০০৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার সান বেয়ারকে লুপ্তপ্রায় প্রাণী বলে ঘোষণা করেছে।
লিফি সি-ড্রাগন
অস্ট্রেলিয়ার শান্ত সমুদ্রের জলে একধরনের জলজ প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। অনেকটা জলজ আগাছার মতো ভাসতে দেখা য়ায় প্রাণীটিকে। এর নাম লিফি সি-ড্রাগন। অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রে বেশি দেখা যায় বলে এদের আরেক নাম ‘অস্ট্রেলিয়ান সি হর্স’। এরা মেরুদণ্ডী, মাছজাতীয় প্রাণী। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Phycodurus eques। দেখলে মনে হয় আগাছার ডালপালা ও পাতায় পানিভর্তি। সারা শরীর জুড়ে সবুজ আর হালকা কমলা রঙের সাথে হালকা সোনালি আভা।
স্ত্রী লিফি সি-ড্রাগন উজ্জ্বল গোলাপি রঙের হয়। স্ত্রী মাছ প্রায় ২৫০টির মতো ডিম পাড়ে। আর এই ডিম তারা পুরুষ প্রাণীর লেজে স্থানান্তরিত করে দেয়। পুরুষ প্রাণী প্রায় ৯ সপ্তাহ ধরে তার দেহে ডিমগুলোকে লালনপালন করে। এরপর ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো একে-একে পুরুষ প্রাণীর লেজ থেকে বেরিয়ে আসে। ১৯৮২ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া সরকার এই প্রাণীটি শিকার করা বা ধরা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছেন।
টারসিয়ার
স্তন্যপায়ী প্রাণী টারসিয়ার সকলের নজর কাড়ে তাদের অদ্ভুত চেহারার জন্য। টারসিয়ার আছে বড়-বড় কাঁচের মার্বেলের মতো উজ্জ্বল চোখ। এদের পায়ের পাতার টারসাস হাড়টি বেশ বড় বলেই এদের এমন নাম। একসময় এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাসহ আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলে প্রাণীটির দেখা পাওয়া যেতো। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং মালয়েশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে এই প্রাণীটির দেখা পাওয়া যায়। এরা বেশ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটতে পারে। এরা শিকারেও বেশ দক্ষ। গাছ থেকে গাছে ঘুরে বেড়ানোর সময় এরা খুবই সুচতুরভাবে ছুটে চলা সাপ বা উড়ন্ত পাখি শিকার করতে পারে। এরা খুবই হিংস্র স্বভাবের। কোনো বদ্ধ ঘরে একসাথে অনেক টারসিয়ারকে রাখলে এরা নিজেরা পরস্পরকে আঘাত করে, এমনকি খুন-জখমও করে বসে।
আলপাকা
প্রাণীটিকে দেখলেই মনে হয় উটের কোনো প্রাজাতি। এই প্রাণীটিকে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, চিলির কিছু অংশে দেখতে পাওয়া যায়। এদেরকে ‘আমেরিকান ক্যামেলিড’ও বলা হয়ে থাকে। এদের সারা গায়ে ভেড়ার মতো লোম। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Vicugna pacos। আলপাকার দুটি প্রজাতি আছে সুরি আলপাকা এবং হুয়াছায়া আলপাকা। এরা প্রায় ৫৫ থেকে ৬৫ কেজিরও বেশি ওজনের হয়ে থাকে।
আলপাকা প্রাণীটি বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। তবে সাদা, কালো এবং মিশ্র রঙেরই বেশি হয়ে থাকে। এরা বেশ শান্ত প্রকৃতির। এদের লোম থেকে যে তন্তু উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে কম্বল, সোয়েটার, টুপি, মোজা, গ্লাভস, স্কার্ফ ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকাতে বিভিন্ন রকমের টেক্সটাইল সামগ্রী তৈরি করা হয়।
হ্যাগফিশ
হ্যাগফিশ আদৌ মাছ কিনা তা নিয়ে প্রাণীবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। দেখতে অনেকটা সাপের মতো। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Myxine glutinosa। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এরা কখনো সাপের মতো শরীরে প্যাঁচ বা গিঁট দিয়ে পালিয়ে যায়। আবার কখনো এরা আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রচুর পরিমাণ আঠালো জেলির মতো ঘন মিউকাস বা লালা নিঃসরণ করে। এদের ধরা বেশ কঠিন কাজ। তাই প্রাণীবিজ্ঞানীরা এই প্রাণীকে সমুদ্রের সবচেয়ে ‘বিরক্তকর’ প্রাণী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পিগমি মারমোসেট
বানরকুলের সবচেয়ে ছোট প্রাণী পিগমি মারমোসেট। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর এবং পেরুর কিছু অংশে এই প্রাণীটি পাওয়া যায়। এই প্রজাতির প্রাণী উচ্চতায় ১৪ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার। তবে এর লেজটা অনেক ক্ষেত্রে তার উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যায়। শুধু লেজটাই প্রায় ১৫-২০ সেন্টিমিটার। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Cebuella Pygmaea। গাছ বেয়ে ওঠার জন্য এদের পায়ে নখ রয়েছে, যা অন্য বানরদের নেই। এদের দাঁত বেশ তীক্ষ্ণ। দাঁত দিয়ে গাছের ছাল খুঁটে তার থেকে আঠালো রস বের করে খেতে পছন্দ করে পিগমি মারমোসেট। পোকামাকড় থেকে শুরু করে ফল, পাতা সবই এদের খাদ্য। এরা খুব দ্রুত চলতে পারে। দ্রুতগামী ও খুবই ছটফটে স্বভাবের হওয়ায় এদের এক জায়গায় বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
অ্যাক্সোলোটল লার্ভা
এই প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম Ambystoma mexicanum। এরা মেরুদণ্ডী উভচর প্রাণী। বাসস্থান মূলত মেক্সিকো অঞ্চলে। অন্য উভচর প্রাণীরা যেমন পরিণত ও বংশবিস্তারের উপযোগী হলেই জল থেকে ডাঙায় উঠে আসে এবং তখন ফুলকা লুপ্ত হয়ে ফুসফুসে রূপান্তরিত হয়, এদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না।
এরা জলজ পরিবেশে বংশবিস্তার করে। এই সময়ে দেহের ফুলকা লুপ্ত হয় না। এদের এমন আচরণে পেছনে বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, মেক্সিকোর জলাশয়গুলোয় পর্যাপ্ত আয়োডিন না থাকায় এই প্রাণীদের বৃদ্ধি বা পরিণত হওয়ার হরমোন (থাইরক্সিন) যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। আর এ কারণে মেরুদণ্ডী উভচরদের মধ্যে এক বিস্ময়কর প্রাণী হিসেবে অভিহিত করা হয় অ্যাক্সোলোটল লার্ভা।
আয়ে-আয়ে
মাদাগাস্কার অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে এই প্রাণীটি সাক্ষাৎ শয়তানের দূত। এখানকার স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করেন, প্রাণীটি হাতের বড় আঙুলটা তুলে যদি কারো দিকে নির্দেশ করে, তবে তার মৃত্যু অনিবার্য। এটি পুরোপুরি একটি ভ্রান্ত ধারণা। প্রাণীটি বেশ নিরীহ প্রজাতির। আয়ে-আয়ে বানর জাতীয় স্তন্যপায়ীদের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম নিশাচর। আকারেও ছোটখাটো।
এদের হাতের অনামিকা একটু বড়, মোটা ও শক্তিশালী। এছাড়া এদের চোখ সবুজ রঙের, বেশ উজ্জ্বল এবং হিংস্র। তাদের হাতের বড় আঙুল আর হিংস্র চোখ দুটো দেখে সাধারণ মানুষ বেশ ভয় পায়। বড় আঙুলটির সাহায্যে প্রাণীটি গাছে গর্ত করে পোকামাকড় ধরে। লোকালয় থেকে ফল, ফুল, ডিম চুরি করে খায়। মানুষের অন্ধবিশ্বাসই প্রাণীটিকে ক্রমশ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দিচ্ছে। প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Daubentonia madagascariensis।
This article is a bengali article. This is about 25 weirdest animals on earth. All the sources are hyperlinked into the article.
Feature Image Source: greenglobaltravel.com