Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভাব প্রকাশে ভ্রু এবং মোনালিসা রহস্য

মানুষ পৃথিবীর সুন্দরতম সৃষ্টির একটি। মানুষের এত সুন্দর চেহারার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের ভ্রু। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের সুস্পষ্ট ভ্রু আছে। ভ্রুকে সরু করে আরও সুন্দরী আর লাস্যময়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে ভ্রু প্ল্যাক করে থাকেন নারীরা। সৌন্দর্য সৃষ্টিতে অবদান রাখা ছাড়াও মনের ভাব প্রকাশেও রয়েছে ভ্রুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই ভ্রু নাচিয়ে, কুচকে বা বাঁকিয়ে মানুষ কোনো কথা না বলেও তার মনের অবস্থাকে প্রকাশ করতে পারে। প্রত্যেকটি মানুষের ভ্রুই অনন্য। তাই ভ্রু দেখে মানুষকে চিনতেও পারা যায়।

ভ্রুর কারণে মানুষকে সুন্দর লাগে; source: licdn.com

চোখের উপরে সুসজ্জিত, ঈষৎ বাঁকানো একগুচ্ছ ঘন চুল নিয়ে গঠিত ভ্রু মূলত কপাল থেকে গড়িয়ে আসা ঘাম বা ক্ষতিকর কোনো পদার্থকে চোখে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং চোখকে সুরক্ষিত রাখে। চোখের রক্ষীর দায়িত্ব পালন ছাড়াও মানুষের নানা আবেগকে চেহারায় সুচারুভাবে ফুটিয়ে ভাবের আদানপ্রদান ও যোগাযোগেও ভূমিকা রাখে ভ্রু।

রাগাক্রান্ত মানুষকে দেখেছেন? রেগে গিয়ে ক্ষিপ্তস্বরে কথা বলা শুরু করার আগেই রেগে যাওয়া ব্যাক্তির চেহারা দেখেই কিন্তু বোঝা যায় যে সে রেগে যাচ্ছে বা রেগে গেছে। ঠিক কীভাবে বোঝা যায় এটা বলতে পারেন?

রেগে গেলে ভ্রু নিচে নেমে আসে; source: preachrblog.blogspot.com

অন্যান্য অভিব্যক্তির সাথে ভ্রু দেখেও বোঝা যায় কেউ রেগে যাচ্ছেন। রেগে গেলে কুচকে বাঁকা হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে ভ্রু। কাঁদলে ভ্রু সংকুচিত হয়, হাসলে প্রসারিত হয়। এরকম ভ্রুর নানা ভঙ্গী নানা আবেগীয় অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক ভ্রুর কোন অবস্থা কোন আবেগকে প্রকাশ করে।

ভ্রু যখন উত্তোলিত

মানুষ যখন চমকে যায়, আশ্চর্য হয় তখন দেখবেন ভ্রু উপরে উঠে যায়। কোনো কারণে মানুষ বিস্মিত হলে চোখ বড় বড় করে আরও স্পষ্টভাবে বিস্ময়ের কারণকে বোঝার চেষ্টা করে। বিস্ময়কে বিশ্বাসযোগ্য করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভ্রুগুলো তখন উপরে উঠে যায়।

বিস্মিত হলে ভ্রু উপরে উঠে যায়; source: rebelcircus.com

মানুষ যত বিস্মিত হবে, তার ভ্রুও বিস্ময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তত উপরে উঠবো। ভ্রু উঁচানো অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টার প্রকাশও হতে পারে। যদি কেউ আপনাকে কোনো প্রশ্ন করার পর ভ্রু উঁচু করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বুঝতে হবে তিনি আপনার থেকে উত্তরটা জানতে চাচ্ছেন।

ভ্রু যখন আনত

ভ্রু নিচু করে ফেললে চোখ অনেকটাই আড়াল হয়ে যায়। তখন চোখের ভাষা পড়তে পারা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। লজ্জা পেলে মানুষ ভ্রু নিচু করে নিজেকে আড়াল করতে চায়।

লজ্জিত অবস্থায় ভ্রু; source: wordpress.com

ভ্রু নিচু করের ফেলার অর্থ বিরক্তি প্রকাশও হতে পারে। যেন আপনার উপর বিরক্ত কেউ আপনাকে বলতে চাচ্ছেন, ‘আমি তোমার উপর এতটাই বিরক্ত যে তোমার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চাই না। বিদেয় হও আমার সামনে থেকে!

ভ্রু যখন সামান্য উত্তোলিত

ভ্রু সামান্য উঁচু করা ‘হাফ ছেড়ে বাঁচলাম‘ কথাটিই যেন বলতে চায়। শুধু দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তিই নয়, আপনি যে চিন্তিত, সামান্য উঠিয়ে ফেলা ভ্রু সেটিও প্রকাশ করে।

দুশ্চিন্তা ভ্রু কুচকে দেয়; source: wordpress

ভ্রু যখন সামান্য আনত

একটু নত ভ্রু থেকে বোঝা যায় আপনি হতাশ! অতিরিক্ত মনোযোগও ভ্রুকে সামান্য নিচু করে ফেলে।

দুটি ভ্রু যখন একই উচ্চতায়

দুটি ভ্রু একইসাথে উপরে উঠানোর অর্থ হচ্ছে আপনি দ্বিধায় ভুগছেন অথবা কোনোকিছু ভালভাবে বুঝতে চাইছেন। মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নবোধক চিহ্নটি দূর করতে চাইছেন।

বিষণ্ণতায় ভ্রুর ভাঁজ; source: publicdomainpictures.net

আপনি বিষণ্ণ থাকলে আপনার নত ভ্রুর মাঝখানে অশ্বক্ষুরাকৃতির একটা ভাঁজ তৈরি হবে। একে ‘ডারউইনের শোক পেশী’ বলা হয়।

ভ্রুর উঠা-নামা

আমরা যখন পরিচিত কাউকে দেখি, তখন দ্রুত একবার ভ্রুকে একটু উপরে উঠিয়ে সাথে সাথেই আবার নামিয়ে ফেলি। ভ্রুর এই নাচন প্রকাশ করে, ‘হ্যা,আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।’

অভ্যর্থনা জানানোর সময় ভ্রু; source: youtube.com

অভ্যর্থনা বা স্বাগত জানাতেও এই ভ্রু-নৃত্য ব্যবহৃত হয়। বানর, গরিলা সহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রেই এভাবে ভ্রু নাচানো একটি বহুল ব্যবহৃত সংকেত। ঘন ঘন ভ্রু নাচানোর অর্থ এটাও হতে পারে যে, আপনার পরিচিত ব্যক্তিটি জানতে চাচ্ছেন, ‘এরপর কি হলো?’, ‘তারপর’?

ভ্রুর ভঙ্গি থেকে আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার জানা যায়। সেটি কী, জানেন? মিথ্যা বলা! হ্যাঁ,মানুষ মিথ্যা বলার সময় তার মুখের ভাবকে পুরোপুরি গোপন করতে পারে না। মিথ্যা বলার সময় মানুষ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। তখন সে দুর্দশায় আছে কিছুটা এরকম ভাব প্রকাশ পায়। এ সময় ভ্রু কিছুটা উপরে উঠে যায়। দ্রুত চোখ মিটিমিটি করা এবং ঈষৎ হাসি থেকেও বোঝা যায় যে লোকটি মিথ্যা বলছে।

শুধু বাস্তব জীবনে নয়, ভ্রুর অমোঘ প্রভাবে রয়েছে শিল্পেও। বিশেষ করে আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে ভ্রুকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। ভাল কার্টুন আঁকতে হলে আপনাকে নানারকম ভ্রু আঁকার কৌশল শিখতে হবে। কারণ ভ্রুই প্রকাশ করতে পারে কার্টুনটি কী বলতে চাচ্ছে। কার্টুনেই যদি ভ্রুর এত গুরুত্ব থাকে, তাহলে আরও জটিল চিত্রকর্মে এর গুরুত্ব কতটা হবে বুঝতেই পারছেন।

মোনালিসার ভ্রু রহস্য

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বাধিক আলোচিত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র অনেকগুলো রহস্যের একটি হচ্ছে তার হাসি রহস্য। সে কি আসলেই হাসছে? নাকি বিষণ্ণ? মোনালিসা হাসছে নাকি কাঁদছে এটি সঠিক বোঝা যায় না, কারণ, একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, মোনালিসার ভ্রু নেই। তবে কি দ্য ভিঞ্চি মোনালিসার ভ্রু আঁকতে ভুলে গিয়েছিলেন? ভিঞ্চির মতো এত দক্ষ আঁকিয়ে এই ভুল করবেন, এটা নিশ্চয়ই এত সহজে মানা যায় না।

মোনালিসা; source: Wikipedia Commons

তাহলে? মোনালিসার ভ্রু নেই কেন? গত কয়েকশ বছর ধরে এই প্রশ্নগুলো চিত্রশিল্পী ও ইতিহাসবিদদের ভাবিয়েছে। ২০০৭ সালে এই মোনালিসার ভ্রু রহস্যের ইতি ঘটে। ফরাসী প্রকৌশলী প্যাসকোল কোটে আল্ট্রা হাই রেজুলিউশান ক্যামেরা ব্যবহার করে নানাদিক থেকে খালিচোখে দৃশ্য-অদৃশ্য ১৩ রকম আলো ব্যবহার করে ২৪০ মিলিয়ন পিক্সেলের বেশকিছু ছবি ওঠান। এত উচ্চ রেজল্যুশনের ছবি মানে তাতে ছবির বিষয়টির অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোও বিস্তারিতভাবে জানা যায়। এগুলো থেকে তিনি দুটি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।

অনুসিদ্ধান্ত ১: ভিঞ্চির আঁকা মূল ছবিতে মোনালিসার ভ্রু ছিল। তবে সেটি ছিল খুবই হালকা। এখনকার মতোই পনের শতকের রেঁনেসার যুগে ভ্রু উঠিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিকন করে ফেলা স্টাইলের অংশ ছিল। তাই ভিঞ্চি সেভাবেই এঁকেছিলেন। কোটে তার উঠানো ছবিগুলো থেকে মোনালিসার বাম চোখের উপরের ভ্রুর জায়গায় একটিমাত্র চুল দেখতে পান। এখান থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে, মোনালিসার ভ্রু এতটাই সরু ছিল যে তা এত বছরে মিলিয়ে গেছে!

অনুসিদ্ধান্ত ২: মোনালিসার ভ্রু মূল ছবিতে ছিল। পরে মিউজিয়ামের কোনো এক কিউরেটর মুছে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে ভ্রুগুলোও মুছে ফেলেন!

তবে এটা সত্য যে, পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব না মোনালিসার ভ্রুর আসল রহস্য কী। বলা হয়ে থাকে যে, মোনালিসা আঁকতে তিন বছর সময় লাগলেও ভিঞ্চি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মোনালিসা সাথে রেখেছিলেন। গুজব আছে, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত মোনালিসা নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি নাকি কখনোই ছবিটি আঁকা শেষ করেননি কারণ, ভ্রু, চোখের পাতা এগুলো কখনোই ঠিকঠাক পাচ্ছিলেন না, পছন্দ হচ্ছিল না তার। আবার এ-ও হতে পারে, গত ৫০০ বছরে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে ছবিটির। এটা সবসময়ই রহস্য হয়ে থাকবে; কারণ ভিঞ্চিই বলেছিলেন, “শিল্প কখনো শেষ হয় না, শুধু বর্জিত হয়।

ফিচার ইমেজ- Pluralsight

Related Articles