Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগৎ || বুদ্ধিমান অক্টোপাস

এই ধরণীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জীব-বৈচিত্র্যর বাহারি সমাহার। স্থলভাগের প্রাণী সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, জলভাগের প্রাণী সম্পর্কে জানাটা রয়ে গেছে ততটাই অন্তরালে। অথৈ জলরাশিতে এমন অনেক জীবের অস্তিত্ব বিদ্যমান, যার সম্পর্কে প্রতিদিন নতুন তথ্য উদঘাটন হচ্ছে আর বিজ্ঞান শুধু হতবাক হচ্ছে।

আর পরিচিত প্রাণীগুলোও যে কম বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে, এমনটাও নয়। তেমনি একটি হলো আট পায়ে সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানো মলাস্কা পর্বের এক পরিচিত জীব অক্টোপাস। শত্রুর চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ এই প্রাণী সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কোনো অন্ত নেই। প্রাণিজগতের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীসমূহের জানা-অজানা রহস্যময় দিক নিয়ে আলোচনার আজকের এই পর্ব সাজানো হয়েছে অক্টোপাসকে নিয়ে।

অক্টোপাস; Image Source: Shutterstock

হৃৎপিণ্ড 

মানুষ সহ অন্যান্য অনেক প্রাণীর হৃৎপিণ্ড শুধুমাত্র একটি থাকলেও, অক্টোপাসের হৃৎপিণ্ড তিনটি। দুইটি হৃৎপিণ্ড প্রাণীটির ফুলকায় রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে। আর তৃতীয়টি নিয়োজিত থাকে শরীরের বাকি অঙ্গগুলোতে রক্ত সঞ্চালনের কাজে। অক্টোপাসের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিবর্তে হিমোসায়ানিন উপস্থিত থাকে। তিনটি হৃৎপিণ্ড একটি হৃৎপিণ্ডের তুলনায় তিনগুণ রক্তচাপ তৈরি করতে সক্ষম। ফলে এগুলো রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে দেহে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখে। অক্টোপাসের তিনটি হৃৎপিণ্ড থাকলেও এগুলো যে সবসময় কাজে লাগে, ব্যাপারটা এরকম নয়। যখন সাঁতার কাটে, তখন যে হৃৎপিণ্ড পুরো শরীরে রক্ত সরবরাহ করছিল, তা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে কারণেই অক্টোপাস সাঁতার কাটার বদলে হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরাকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়।

রক্তের বর্ণ

মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের রঙ লাল হলেও, অক্টোপাসের রক্ত কিন্তু নীল। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য লোহিত রক্ত কণিকায় আয়রন যুক্ত হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি। এই হিমোগ্লোবিনের কারণেই মূলত রক্ত লাল হয়। অপরদিকে, অক্টোপাসের রক্তে হিমোগ্লোবিনের বদলে কপার যুক্ত হিমোসায়ানিন নামক রঞ্জক পদার্থ দ্রবীভূত থাকে। এই হিমোসায়ানিনের জন্যই অক্টোপাসের রক্তের রঙ নীল হয়। 

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অক্টোপাসের রক্তে হিমোসায়ানিনের পরিবর্তে হিমোগ্লোবিন থাকলে এমন কী সমস্যা হতো? সমস্যা একটা অবশ্যই আছে! অক্টোপাসকে সমুদ্রে উপরিভাগে তেমন ভেসে বেড়াতে দেখা যায় না, তাদের অষ্টপদী বিচরণ সর্বদা সমুদ্রের গহীন তলদেশে। গভীর সমুদ্রের ঠাণ্ডা পরিবেশে অক্সিজেনের ঘনত্ব থাকে অনেক কম। সে পরিবেশে হিমোগ্লোবিনের চেয়ে হিমোসায়ানিনই দক্ষতার সাথে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। হিমোসায়ানিনের কার্যকারিতা আবার পানির অম্লতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পানির অম্লতার পরিমাণ বেশি হলে শরীরে অক্সিজেন সংবহন করাটা অক্টোপাসের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানিতে অম্লত্বের পরিমাণ বেড়ে গেলে সামুদ্রিক প্রাণীদের কী হবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ উদ্বেগে আছেন।

হিমোসায়ানিনের গঠন; Image Source: Wikimedia Commons

অক্টোপাস সম্পর্কে এরিস্টটল

গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, অক্টোপাস হলো বোকা গোছের সহজ-সরল প্রাণী। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে তার বই হিস্ট্রি অভ অ্যানিমেলস-এ তিনি উল্লেখ করেছেন, অক্টোপাস হলো নিরেট স্থূল বুদ্ধিসম্পন্ন এক সৃষ্টি। সমুদ্রের উপরিভাগে উঠে আসলে এটা মানুষের হাতে অচিরেই মারা পড়বে। অথচ বাস্তবে অক্টোপাস খুবই বুদ্ধিদীপ্ত এক প্রাণী। মানুষের মতো অক্টোপাসও হাতিয়ার ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কোনো বোতলের মুখ বন্ধ করে অক্টোপাসকে সেটাতে রাখলে, কিছু সময় পর তা খুলে ফেলতে পারে। এমনকি নানা ধরনের ধাঁধা সমাধানেও অক্টোপাস দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

১৯১০ সালে এরিস্টটলের ‘হিস্ট্রি অভ অ্যানিমেলস’ বইয়ের অনুবাদকৃত অংশে অক্টোপাসের বর্ণনা; Image Source: Embrc

চোষকের সংবেদনশীলতা

একটি অক্টোপাসে বিদ্যমান মোট নিউরনের দুই-তৃতীয়াংশই এর বাহুগুলোতে অবস্থিত, মাথায় নয়। সেক্ষেত্রে অক্টোপাসটি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলেও, বাহুগুলো মস্তিষ্কের নির্দেশনা ছাড়াই নিজের মতো করে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারে। এদের দেহের প্রতিটি বাহুতে রয়েছে ২৪০টি করে চোষক। প্রতিটি চোষক ৩০ পাউন্ড পর্যন্ত ভার বহন করতে সক্ষম।

চোষকগুলো অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। ঠিক সে কারণেই বাহুকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরেও সেটা নড়াচড়া করতে পারে। এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা অক্টোপাসের শরীর থেকে আলাদা করে নেওয়া একটি বাহুকে সূচালো কিছু দ্বারা আঘাত করেছিলেন। আঘাত করার সাথে সাথেই হাতটা হুট করে অন্যত্র সরে যায়।

অক্টোপাস মারা যাওয়ার এক ঘণ্টা পরেও তাদের কর্ষিকা সক্রিয় থাকে এবং সেগুলো পারিপার্শ্বিক উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করতে পারে। অবাক করা বিষয় হলো, কর্ষিকার সেন্সরগুলো এত সংবেদনশীল যে, অক্টোপাস মারা যাবার পরেও সেগুলো খাবার পেলে তা মুখের দিকে এগিয়ে দেয়।

অক্টোপাসে অনেকগুলো চোষক বিদ্যমান; Image Source: Wallpaper Cave

শত্রু থেকে বাঁচার কৌশল

শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য অক্টোপাস শিকারের দিকে একপ্রকার কালি ছুড়ে দেয়। ছুড়ে দেয়া এই কালি শুধু তাকে শিকারের হাত থেকে লুকোতেই সাহায্য করে না, এটা শত্রুকে শারীরিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন করে। এই কালিতে টাইরোসিনেজ নামক একপ্রকার পদার্থ থাকে। মানুষের মধ্যে টাইরোসিনেজ প্রাকৃতিক রঞ্জক মেলালিন তৈরিতে সাহায্য করে। অক্টোপাস এই টাইরোসিনেজ তার শত্রুর দিকে ছুড়ে মারলে, শত্রু কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। এ কালির আরেকটি গুণ হচ্ছে এটি শত্রুর ঘ্রাণশক্তি এবং স্বাদ অনুভবের ক্ষমতা কিছুক্ষণের জন্য নষ্ট করে দেয়। মুহূর্তে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে নিজেকে শত্রুর সামনেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে ফেলার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে অক্টোপাসের।

অক্টোপাসের কালি ছুড়া; Image Source: Flickr

খাদ্য হিসেবে অক্টোপাস

অক্টোপাস সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায়। এছাড়াও পূর্ব এশিয়া, স্পেন, গ্রিস এবং আমেরিকাতেও খাদ্য হিসেবে অক্টোপাস জনপ্রিয়। জীবন্ত অক্টোপাস বা স্যান-ন্যাক-জি, দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা বিশ্বাস করে গ্রীষ্মকালে এটি শক্তি বর্ধক হিসেবে দারুণ কাজ করে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জীবন্ত অক্টোপাস খেলে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ সত্তর হাজার টন অক্টোপাস আমদানি করা হয়ে থাকে।

খাদ্য হিসেবে অক্টোপাস; Image Source: Shutterstock

ছদ্মবেশী অক্টোপাস

প্রাণিজগতে ছদ্মবেশ ধারণে অক্টোপাসের জুড়ি নেই। সেকেন্ডের দশ ভাগের তিন ভাগ সময়ে নিজের শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। বিপদের সম্মুখীন হলে বা শিকার ধরার প্রয়োজনে সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন শৈবাল কিংবা পাথরের মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে ওস্তাদ।

ঝিনুক ও নারকেলের মধ্যে অক্টোপাস; Image Source: Rock-Cafe

বুদ্ধিমত্তা

একটি অক্টোপাসের নিউরন সংখ্যা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন, যা একটি কুকুরের নিউরন সংখ্যার সমান। সিটেল একাডেমির প্রাণিবিদরা বিলি নামের এক অক্টোপাসের শক্তি ও বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য তাকে একটি বোতলের মধ্যে খাবার আটকে দেন। বিলি ৫ মিনিট সময় নেয় বোতলটি খোলার জন্য। তবে অক্টোপাসের মতো প্রাণীর জন্য এটা খুব বেশি অবাক করার বিষয় নয়। কারণ তারা ছুরির সাহায্য ছাড়াই শামুক, ঝিনুকের খোলস খুলে ফেলতে পারে।

জলের ভেতর তৈরি হওয়া বিভিন্ন গোলকধাঁধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা সহজেই সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। রসিকতায়ও কম যায় না এরা। অনেক সময় তারা দুষ্টুমির ছলে জেলেদের নৌকা আটকে দেয়। নারিকেল খোসা, ঝিনুক-শামুকের খোলসে বাসা বাধা সহ তারা কাঁকড়ার খোলস ছাড়ানোর পর তাদের মাংস খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে। জার খোলার ব্যবস্থাও এদের জানা আছে। বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকলে আমরা যেমন দাঁত দিয়ে নখ কাটি, অক্টোপাসও এমন অবস্থায় নিজেদের উপাঙ্গ কামড়ে খেয়ে বিষণ্ণতা কাটানোর চেষ্টা করে। অক্টোপাসের স্নায়ুতন্ত্র মানুষের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। মস্তিষ্কের আকারও বেশ বড়। অথচ তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে চিনতে পারা সহ অনেক বিস্ময়কর দক্ষতা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণও পেয়েছেন।

বোতল খোলার চেষ্টা করছে অক্টোপাস; Image Source: Madly Odd

স্বচ্ছ অক্টোপাসের বিরল ছবি

পৃথিবীতে যেসব প্রাণীর দেখা পাওয়া খুবই বিরল, তাদের মধ্যে গ্লাস অক্টোপাস অন্যতম। পুরো শরীর স্বচ্ছ কাচের মতো হওয়ায় তাদেরকে গ্লাস অক্টোপাস নাম দেয়া হয়েছে। এর শরীর এতটাই স্বচ্ছ যে, অক্টোপাসটির শরীর ভেদ করে অপর প্রান্তের জলও দেখা যায় অনায়াসে। তবে সমুদ্রের নীল জলরাশিতে তাদের দেখা পাওয়াটাই কঠিন। ১৯১৮ সালে একটি সামুদ্রিক শিকারি প্রাণীর পেটে গ্লাস অক্টোপাসের হদিস পাওয়ার পর এদের নিয়ে বিজ্ঞান-মহলে বিশেষ তোরজোড় সৃষ্টি হয়, গবেষণায় বাড়ে আগ্রহ। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের মতো অহরহ ছবি বা ফুটেজ বা নমুনা বিজ্ঞানীদের কাছে না থাকায়, তারা বেশি দূর এগোতে পারেননি। শুধু এর বেলনাকার চোখ, অপটিক নার্ভ, পরিপাকতন্ত্র ছাড়া দেহের বাকি অংশ কাঁচের মতো স্বচ্ছ। 

প্রাণীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্মিড্‌ট ওশান ইন্সটিটিউটের একটি গবেষক দল নামক একটি রোবট সমুদ্রের তলদেশে পাঠান। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে ৩০ হাজার বর্গমাইলের বেশি এলাকাজুড়ে ৩৪ দিন ধরে অভিযান চালিয়ে যান তারা। সেই রোবটের মধ্যে থাকা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে বিরল একটি গ্লাস অক্টোপাস।

গ্লাস অক্টোপাস; Image Source: Independent/Schmidt Ocean Institute

মাই অক্টোপাস টিচার

৯৩তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা প্রামাণ্যচিত্রের খেতাবে ভূষিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ‘মাই অক্টোপাস টিচার’। ডকুমেন্টারিটিতে চিত্রায়িত হয়েছে গভীর জলরাশির তলদেশে অক্টোপাসের বৈচিত্র্যময় জীবনকাহিনী। সমুদ্রের তলদেশে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে ডকুমেন্টারির প্রযোজক ক্রেইগ ফস্টারের নজর আটকে যায় একটি অক্টোপাসে। প্রথম দেখাতেই অক্টোপাসটির প্রেমে পড়ে যান তিনি। অক্টোপাসের সাথে কীভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেন। প্রায় এক বছর কঠোর প্রচেষ্টার পর প্রাণীটির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হন তিনি। অক্টোপাসরা কীভাবে খায়, ঘুমায়, বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে; সেগুলো খুব কাছ থেকে দেখতে থাকেন ক্রেইগ ফস্টার।

এই অক্টোপাসটি ক্রেইগের বিষণ্ণ এবং একঘেয়ে জীবনে নিয়ে আসে আমূল পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যামেরায় ভিডিও ধারণের মাধ্যমে জমা করেছেন অক্টোপাসের সাথে কাটানো অসংখ্য স্মৃতি। সেটাতেই ছুড়ি কাঁচি চালিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে ৮৫ মিনিটের এক প্রামাণ্যচিত্রে। যা ইতোমধ্যে জয় করে নিয়েছে দর্শকদের মন। সিরিজটি দেখা যাচ্ছে নেটফ্লিক্সে। 

মাই অক্টোপাস টিচার প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য; Image Source: Netflix

অক্টোপাসের স্বপ্ন

গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে একটি অক্টোপাস। ঘুমের মধ্যেই সে রং পাল্টাচ্ছে অনবরত। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রং পাল্টে কখনও হচ্ছে হলুদ, কখনও আবার হয়ে যাচ্ছে লালচে। আর এই রঙ পাল্টানোর অভিনব দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়লে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। গায়ের রং পরিবর্তন করা অবশ্য অক্টোপাসের জন্য নতুন কিছু কিছু নয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে এত দ্রুত রং পরিবর্তন জীববিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবিয়েছে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সেই অক্টোপাস ঘুমের মধ্যে সমুদ্রের নিচে কাঁকড়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। সেজন্য তার গায়ের রং বদলে বাদামি হচ্ছিল। এই প্রক্রিয়াকে বিমুগ্ধকর বলে উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

ডিমে তা দিচ্ছে মা অক্টোপাস; Image Source: Flickr

অক্টোপাসের যৌনমিলন

মিলনের সময় পুরুষ অক্টোপাস তার হেক্টোসোটাইলাস স্ত্রী অক্টোপাসের ম্যান্টল গহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে তাতে স্পার্মাটোফোর জমা করে। হেক্টোসোটাইলাস হলো পুরুষ অক্টোপাসের একটি রূপান্তরিত বাহু, যা দিয়ে সে স্ত্রী অক্টোপাসে শুক্রাণু স্থানান্তর করে। এই মিলন প্রক্রিয়া স্থায়ী হতে পারে প্রায় কয়েক ঘণ্টা। যৌন মিলনের দুই মাস পরেই মারা যায় পুরুষ অক্টোপাসটি। আর স্ত্রী অক্টোপাসকে মৃত্যুবরণ করতে হয় ডিম ফুটার কিছুদিন পর। স্ত্রী অক্টোপাসটি ডিমে তা দিতে ব্যয় করে সাধারণত আট থেকে দশ মাস। প্রজাতিগত ভিন্নতা বা তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য এর খানিকটা তারতম্যও ঘটতে পারে। এ সময় মা অক্টোপাস নাওয়া-খাওয়া সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ডিম রক্ষার কাজে মন দেয়।

অক্টোপাসে মিলনের একটি দৃশ্য; Image Source: Sky News

রং প্রদর্শনীতে পেশির ব্যবহার

অক্টোপাসের প্রতিটা ক্রোমাটোফোর কোষের মধ্যেই রঞ্জক সমেত একটি নমনীয় থলে বিদ্যমান, যেটাকে বলা হয় সাইটোইলাস্টিল স্যাক্কুলাস। রঞ্জক থলের আশেপাশের পেশিগুলোতে যদি টান পড়ে, তাহলে থলেগুলোতেও অধিক চাপ প্রবাহিত হয়। সেজন্যই অক্টোপাস আরও অধিক রং প্রদর্শন করে। আবার পেশির টান কমে গেলে, থলেগুলো চুপসে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। ফলে রঙিন ভাবটাও কমে যায়।

সবচেয়ে বিষাক্ত অক্টোপাস

শিকার ধরার সময় অক্টোপাস তার শিকারের উপর বিষাক্ত লালা ঢেলে দেয়। ফলে, প্রাণী হয় অবশ হয়ে যায় নয় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রায় সকল অক্টোপাসের মধ্যে বিষ নিহিত থাকলেও, তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। শুধু ব্লু-রিংড অক্টোপাসের বিষই মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্লু-রিংড অক্টোপাস বিষাক্ত সকল সামুদ্রিক প্রাণীর তালিকায় একদম উপরের দিকেই জায়গা করে নিয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে মারার জন্য এর একটি ছোট্ট কামড়ই যথেষ্ট। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এদের কামড় সম্পূর্ণ ব্যথাহীন। কামড় খাওয়ার পর কেউ তা টের পাবে না। কিন্তু সেই বিষ তার ক্রিয়া শুরু করে দিলে মানুষটি নিদারুণ যন্ত্রণায় আর টিকতে পারবে না।

ব্লু-রিংড অক্টোপাস; Image Source: Paper Hi

সবচেয়ে বড় অক্টোপাস

সবচেয়ে বড় প্রজাতির অক্টোপাস হলো জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস। একেকটা জায়ান্ট অক্টোপাসের গড় ওজন প্রায় ১৫ কেজির কাছাকাছি এবং তারা তাদের বাহু সর্বোচ্চ ১৪ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে। তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বৃহৎ যে জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস পাওয়া গিয়েছে, তার ওজন ছিল ৭১ কেজির কাছাকাছি। নর্থ প্যাসিফিকে এই আধিক্য বজায় আছে বলে একে অনেকসময় ‘নর্দার্ন প্যাসিফিক জায়ান্ট’ বলেও অভিহিত করা হয়। এছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন, ওয়াশিংটন, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, রাশিয়া, জাপানেও এর দেখা পাওয়া যায়।

জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস; Image Source: Rock-Cafe

পুনরুৎপাদন ক্ষমতা

অক্টোপাসের শরীরে কোনো হাড়ের অস্তিত্ব নেই। তাই তাদের বাহুগুলো যেকোনো আঘাতে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে এ নিয়ে অক্টোপাসকে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয় না। কারণ, অক্টোপাসের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা বেশ ভালো। এই ক্ষমতার দ্বারা তার কোনো বাহু বা বাহুর অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দ্রুত তা পুনরুৎপাদন হওয়া শুরু করে। এক্ষেত্রে নিডারিয়া পর্বের হাইড্রার সাথে অক্টোপাসের বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায়।

অক্টোপাসের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা; Image Source: Bio Geo Planet

সাগরের প্রাচীন এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই অবাক বনে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু বুদ্ধি কিংবা চাল চলনই নয়, প্রাণীটির মস্তিষ্ক আর জিন পরীক্ষা করেও গবেষকদের বিস্মিত হতে হয়েছে। মানুষের চাইতেও অক্টোপাসের জিনের সংখ্যা ১০ হাজার বেশি। এই জিনের বৈচিত্র্যের কারণেই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে সাগরের রহস্যপূর্ণ এই প্রাণীটি।

Featured Image: Independent/Schmidt Ocean Institute

Related Articles