সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা অসীম। একইসাথে সৃষ্টি ও ধ্বংসে মানুষের চেয়ে পারদর্শী আর কেউ নেই। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই মানুষের হাতে বন-প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে কত শত প্রাণী, তারও হিসাব নেই। যুগে যুগে বাইসন, ম্যামথ, তাসমানিয়ান টাইগার, সিন্ধুঘোটক, ডোডো কিংবা প্যাসেঞ্জার পিজিয়নের মতো অসংখ্য প্রাণী পৃথিবী থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যার পেছনে সরাসরি অবদান মানুষের। সৃষ্টির বিলুপ্তিতে এই অবদান চিরকালই রেখে এসেছে মানবজাতি, এখনো রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে- তা হলফ করেই বলা চলে। প্রত্যক্ষভাবে নিজের স্বার্থে প্রয়োজন, এমন প্রাণী ছাড়া বাকি সবাইকেই হয়তো একদিন বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেবে মানবজাতি। সেই 'একদিন' আপাতত কিছু উভচর প্রজাতির দরজায় কড়া নাড়ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই জীববিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলে অস্বাভাবিক হারে ব্যাঙ এবং স্যালামান্ডারের মৃত্যু লক্ষ করছিলেন। বৈশ্বিকভাবে ৪১ জন জীববিজ্ঞানীর একটি দল এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেন দুঃখজনক এক তথ্য। তারা দেখতে পান যে মানুষের দ্বারা বিশ্বব্যাপী একটি ভয়ানক ক্ষতিকর প্যাথোজেন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, যা হত্যা করে চলেছে নানা প্রজাতির ব্যাঙ আর সামুদ্রিক স্যালামান্ডার সহ উভচর প্রাণী। এই প্যাথোজেন দ্বারা গত কয়েক বছরে ব্যাঙ ও স্যালামান্ডার সহ উভচর প্রাণীদের অন্তত ৫০১টি প্রজাতি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কিংবা বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে আরো অনেক প্রজাতি। ভয়ানক এই প্যাথোজেন এমন রোগ সৃষ্টি করে, যা এই প্রাণীগুলোর দেহত্বক খেয়ে ফেলে এবং প্রাণীটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণিজগতে কোনো একক রোগের দ্বারা এতগুলো প্রজাতির বিলুপ্তির পর্যায়ে চলে যাওয়া কিংবা বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
সম্প্রতি ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনে উভচর প্রাণীর এই বিপর্যয়ের খবর প্রকাশ করা হয়। সেখানে জানানো হয়, ৫০১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মাঝে ৯০টিরই বিলুপ্তি ঘটে গেছে, যা ইতোমধ্যে ব্যাপক আকারের ক্ষতি। এর মাঝে আরো ১২৪টি প্রজাতির অন্তত ৯০ ভাগ সদস্য মরে গেছে। ফলে সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটতে বেশি দেরি নেই। আর এই ক্ষতি ঘটানোর পেছনে খলনায়কের ভূমিকা পালন করেছে দু'টি কাইট্রিড ছত্রাক, বাট্রাকোকাইট্রিয়াম ডেনড্রোবেটিডিস বা বিডি এবং ব্যাট্রাকোকাইট্রিয়াম স্যালামান্ডিভরানস বা বিস্যাল। এই দুটি ছত্রাকের প্রথমোক্তটিই অধিক ক্ষতিকর এবং চামড়া খসে যাওয়া রোগে ঘটা ৯৫ ভাগ উভচর প্রাণীর মৃত্যুর জন্যই এটিই দায়ী।
“এখানে আগে রাতের বেলায় প্রতি পদক্ষেপে ভাবতে হতো, কোনো ব্যাঙ পায়ে চাপা পড়লো কিনা। অথচ এখন এ প্রাণীটি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠেছে!”- পরিবেশবিজ্ঞানী বেন শিল
অত্যন্ত দুঃখের সাথে এ কথাগুলো বলেছেন ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র পরিবেশবিদ বেন শিল। তিনি দীর্ঘদিন যাবন কাইট্রিড ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। অস্ট্রেলিয়ার যে অঞ্চলে তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন, সেখানে ‘অ্যাল্পাইন ট্রি ফ্রগ’ নামক এক প্রজাতির ব্যাঙের অভয়ারণ্য ছিল। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেখানে এখন এই ব্যাঙ বিরল হয়ে উঠেছে। আর এখানকার এই গণহত্যা পুরোটাই ঘটেছে বিডি ছত্রাকটির দ্বারা। বিজ্ঞান এই ছত্রাকটিকে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বহু আগেই। কিন্তু এটি যে এত বেশি ক্ষতিকর, তার উপলব্ধি হয়েছে সম্প্রতি। শিল তাই আফসোস করেছিলেন, এই উপলব্ধিটা বড্ড দেরিতে এসেছে।
কাইট্রিড ছত্রাকের আক্রমণে উভচর প্রাণীদের ব্যাপক হারে মৃত্যুর ঘটনা প্রথম ঘটতে শুরু করে ১৯৮০’র দশকে। এশিয়া বাদে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলে এ রোগের ছোট আকারের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় সে সময়। ধীরে ধীরে তা কমে এলেও, ২০০০ সালে আবার হঠাৎ বেড়ে যায়। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের বেশ কিছু দেশে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরে উভচর প্রাণীদের মাঝে। এসবের মাঝে এশিয়া ছিল ভিন্ন, যেখানে কাইট্রিডের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও উভচর প্রাণীদের জন্য সেগুলো তেমন হুমকি হয়ে ওঠেনি। তবে অধিক ভয় ধরানো তথ্য হলো, এই তথ্যগুলোর কোনোটিই সম্পূর্ণ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে ৫০১ প্রজাতির অপূরণীয় ক্ষতির তথ্য আমরা জানি, সেটি অর্ধেক সংখ্যক কিংবা সামান্য বেশি হতে পারে! অর্থাৎ, প্রায় সমসংখ্যক শনাক্ত হয়নি, এরকম উভচর প্রাণীরও বিলুপ্তি ঘটিয়েছে কিংবা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এনেছে এই ছত্রাক! অন্যদিকে, ১৯৮০’র দশকে প্রথম এরূপ মৃত্যুর ঘটনা আবিষ্কৃত হলেও তা আরো আগে থেকেই যে ঘটতো না, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন।
প্রকৃতিতে শতাধিক প্রজাতির কাইট্রিড ছত্রাক আছে। সেগুলোর সিংহভাগই ক্ষতিকর তো নয়ই, বরং উপকারী। প্রকৃতিতে সকল ধরনের জৈবদেহে পচন ধরানোই সেগুলোর কাজ। কিন্তু, বিডি ছত্রাকটি তার জাতভাইদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন স্বভাবের। পচন-গলনে তার মন নেই, বরং খাই খাই করাই তার স্বভাব। কী খেতে হবে? উভচর প্রাণীর ত্বকের প্রোটিন! এই প্রোটিনের টানে উভচর প্রাণীদের ত্বকে বাসা বাঁধে এই দুষ্টু ছত্রাক, সৃষ্টি করে মরণঘাতী রোগের। অবশ্য এই ছত্রাকের চরিত্রে একটি ভালো দিকও আছে। সেটি হলো অযথা নতুন পরিবেশে অনাহূতের মতো হামলে না পড়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০ শতকের শুরুর দিকেও এই ছত্রাক পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি অঞ্চলে সীমিত আকারে অস্তিত্ববান ছিল। এরপর ব্যাপক আকারে বৈশ্বিক শিল্পায়ন এবং দু'টি মহাযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষই এই ঘরকুনো ছত্রাকটিকে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
বিডি ছত্রাকটির সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো এই যে, এটি কেবল ক্ষতিকরই না, এটি অত্যন্ত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। উপরন্তু, এটি এর শিকারকে দ্রুত মেরে ফেলে না। শিকারের ত্বকে এই ছত্রাক বাসা বাঁধলে শিকার তা দীর্ঘ সময়ে বয়ে বেড়ায় এবং ছত্রাকটি চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ নিজের অজান্তেই করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘আমেরিকান বুলফ্রগ’ নামক ব্যাঙ এই ছত্রাকের আক্রমণে মরে যায় না, কিন্তু এই ব্যাঙটি নানা কারণে এই ছত্রাকের সবচেয়ে ভালো বসবাসের জায়গা এবং ছত্রাকটি ছড়িয়ে দিতেও এই ব্যাঙের অবদান অন্যদের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে, অধিকাংশ ছত্রাকই যেখানে খুব কম সংখ্যক প্রাণীকে নিজেদের শিকারে রূপান্তরিত করে, সেখানে সকল কাজের কাজী বিডি ছত্রাকটি কম করে হলেও ৬৯৫টি প্রাণীর দেহে বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম। আরো তো আরো, এই ছত্রাকটির স্পোরের আছে কই মাছের প্রাণ। একে তো তারা স্পর্শ কিংবা পানির মাধ্যমে সহজে ছড়িয়ে যেতে পারে, উপরন্তু এক পোষক দেহ থেকে আরেক পোষক দেহে (দূরত্ব কম হলে) সাঁতরে চলে যেতে পারে! এখানেই শেষ নয়, কোনো কারণে পোষক দেহের বাইরে চলে এলে প্রতিকূল পরিস্থিতি পেড়িয়ে মাসাধিককাল, কখনোবা ১ বছরও বেঁচে থাকতে পারে এরা।
বিডি ছত্রাকটি যা ক্ষতি করার, তা তো করেই ফেলেছে। এই ক্ষতি পূরণ হবার কোনো উপায় নেই, ফিরিয়ে আনা সম্ভব না বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীগুলোকেও। কিছু ছত্রাকনিরোধী রাসায়নিক আছে, যা স্প্রে করলে বিডি ছত্রাকটি মরে যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক ছিটানোর আকাশকুসুম কল্পনা বিজ্ঞানীরাও করছেন না। কিন্তু বাস্তবসম্মত সমাধান তো অবশ্যই রয়েছে। আর সেটি হলো এর বিস্তার রোধ করা। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পোষা প্রাণী, মাংস এবং বিভিন্ন উভচর প্রাণীর আমদানি-রপ্তানিই বিডি ছত্রাকটির বৈশ্বিক বিস্তারের প্রধান নিয়ামক। রাতারাতি এসব বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া না গেলেও যা করা যেতে পারে তা হলো, এগুলোর পণ্যায়ন জীবণুমুক্ত করার জন্য অধিক সতর্ক হওয়া।
এদিকে ‘ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিম্যাল হেলথ’ কে সাথে নিয়ে এই মহামারী রোগ এবং উভচর প্রাণীজগতের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে কাজ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বেশি, সেখানে নানারকম প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ পাঠিয়েছে। তাছাড়া, বাণিজ্যের মাধ্যমে যেন এই ছত্রাকটি ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, খসড়া তৈরি করা হয়েছে একটি চুক্তিরও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের দ্বারা ইতোমধ্যে পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, প্রাণীকূলের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে ক্ষতিপূরণ দেয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে বিডি ছত্রাকের এই ভয়াবহতা যেন সেই ক্ষতিপূরণের ডাক দিয়ে গেলো মানবজাতিকে।
This article is written in Bangla language. It's about the apocalypse that happend in amphibian animal world caused by a destructive pathogen.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: naturewallpaperfree.com