Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেব্রার ডোরাকাটা দাগের রহস্য

সাদাকালো ডোরাকাটা দাগ বিশিষ্ট জেব্রা প্রাণীজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু একটা প্রশ্ন আপনার মনে জাগতেই পারে, জেব্রার শরীরের দাগগুলো কি আসলে সাদার উপরে কালো, নাকি কালোর উপরে সাদা?

অন্তত মধ্যযুগ থেকেই মানুষ বিশ্বাস করত, জেব্রা মূলত সাদা বর্ণের প্রাণী, যাদের ডোরাগুলো কালো বর্ণের। তাদের এ ধরনের বিশ্বাস অবশ্য কোনো গবেষণার ফলাফল ছিল না। জেব্রার পেটের নিচের দিকটা সাদা রংয়ের হওয়ার কারণেই এ ধরনের বিশ্বাস গড়ে ওঠে। তবে সম্প্রতি কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল থেকে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, জেব্রা মূলত কালো বর্ণের প্রাণী, আর সাদা রংটিই তাদের ডোরার রং।

জেব্রার পেটের নিচের দিকের রং সাদা; Source: scienceabc.com

বিজ্ঞানীদের মতে, ভ্রূণ অবস্থায় জেব্রার চামড়ার রং কালো থাকে। এরপর ধীরে ধীরে চামড়ার নিচে অবস্থিত কোষগুলো থেকে নিঃসৃত রঞ্জক পদার্থের প্রভাবে পশমগুলোর মধ্যে ডোরাবিশিষ্ট সাদা রংয়ের আবির্ভাব ঘটে। বিজ্ঞানীরা এখনও এই ডোরার প্যাটার্ন তৈরি হওয়ার গাণিতিক মডেল ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে তারা নিশ্চিত, ভ্রুণ অবস্থার শেষ পর্যায়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। পূর্ণবয়স্ক জেব্রারও পশমের নিচে যে মূল চামড়া, তার রং ডোরাকাটা নয়, বরং সম্পূর্ণ কালো।

দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন মাথা ঘামিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, জেব্রার শরীরে ডোরাকাটা দাগ থাকার উদ্দেশ্য কী? জীব জগতে প্রতিটি প্রাণীর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হয়ে আসার পেছনে কিছু না কিছু কারণ বা উপকারিতা থাকে। জেব্রার ক্ষেত্রে এই কারণগুলো কী? বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন, যদিও এর সবগুলোর পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ছদ্মবেশে শত্রুকে ধোঁকা দেওয়া

দল বেঁধে থাকা জেব্রা দৃষ্টিভ্রমের সৃষ্টি করে; Source: The Guardian

জেব্রার প্রধান শত্রু সিংহ এবং হায়েনা। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে সিংহ যেরকম দূর থেকেই একটি নির্দিষ্ট শিকারকে পছন্দ করে তাকে ধরার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালাতে পারে, জেব্রার অনন্য ডোরাকাটা বৈশিষ্ট্যের কারণে সিংহের পক্ষে তা সম্ভব হয়না। অনেক প্রাণীবিদই মনে করেন, শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবেই জেব্রার গায়ে ডোরাকাটা দাগের সৃষ্টি হয়েছে।

জেব্রা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে। এমনকি জুটিবদ্ধ নয়, এমন পুরুষ জেব্রাও দলবেধে একত্রে চলাফেরা করে। একদল ডোরাকাটা জেব্রা যখন কাছাকাছি অবস্থান করে, তখন সিংহের চোখে দৃষ্টিভ্রম তৈরি হয়। তারা জেব্রাগুলোকে পৃথকভাবে চিনতে পারে না। তাদেরকে কাছে জেব্রাগুলোকে চলমান বিশাল ডোরাকাটা বর্ণিল কোনো প্রাণী বলে ভ্রম হয়। ফলে তারা আক্রমণ করার সাহস পায় না।

বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন অবশ্য এই তত্ত্ব বিশ্বাস করতেন না। তার দ্য ডিসেন্ট ম্যান গ্রন্থে  তিনি এই তত্ত্বের বিপক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন। তবে বিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস তার ডারউইনিজম গ্রন্থে ডারউইনের সাথে দ্বিমত করে এই তত্ত্বের পক্ষে নিজের যুক্তি এবং মতামত তুলে ধরেন।

জেব্রাকে আক্রমণ করছে একটি সিংহী; Source: thingpic.com

কীটপতঙ্গ থেকে আত্মরক্ষা

মশা-মাছি সহ অন্যান্য কিছু কীটপতঙ্গ ডোরাকাটা দাগ পছন্দ করে না, এই ধারণাটি ১৯৩০ সাল থেকেই প্রচলিত। তখন থেকেই এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়েছে এবং দেখা গেছে, কীটপতঙ্গ সম্পূর্ণ সাদা বা সম্পূর্ণ কালো রং বেশি পছন্দ করে। এখান থেকেই ধারণা করা হয়, জেব্রার ডোরা কাটা দাগের পেছনেও কীটপতঙ্গের এই বৈশিষ্ট্যটির ভূমিকা আছে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী জেব্রার শরীর ডোরাকাটা হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে তাদেরকে এক জাতীয় রক্তপিপাসু মাছির হাত থেকে রক্ষার জন্য। হাঙ্গেরিয়ান সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে হাঙ্গেরির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদদের দ্বারা পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কীটপতঙ্গরা এক রং বিশিষ্ট পৃষ্ঠের উপর বসতে বেশি পছন্দ করে। জেব্রার মতো ডোরাকাটা পৃষ্ঠকে তারা এড়িয়ে চলে।

বিভিন্ন ধরনের জেব্রার ডোরা; Source: jeb.biologists.org

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম কারো এবং তার সহকর্মীরাও জেব্রার ডোরার উপর কীট-পতঙ্গের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেন। নেচার কমিউনিকেশান্স জার্নালে প্রকাশিত তাদের এ গবেষণাপত্র থেকে দেখা যায়, জেব্রার ডোরাকাটা দাগের ঘনত্ব এবং গাঢ়ত্ব কীটপতঙ্গের আক্রমণের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির জেব্রার উপর হবেষণার পরিবর্তে তারা বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির জেব্রা, ঘোড়া এবং গাধার উপর এ গবেষণা চালান। তারা লক্ষ্য করেন, বিশ্বের যেসব এলাকায় বিরক্তিকর মশা-মাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেশি, সেসব এলাকায় জেব্রার গায়ে গাঢ় এবং ঘন ঘন ডোরা কাটা দাগ লক্ষ্য করা যায়। তারা আরও লক্ষ্য করেন, যেসব এলাকায় সিটসি নামক এক প্রকার রক্তপিপাসু মাছির আক্রমণ বেশি, সেসব এলাকায় ঘোড়া এবং গাধার গায়ের রংও কিছুটা ডোরা বিশিষ্ট হয়ে থাকে।

সামাজিক পরিচয় এবং সঙ্গী নির্বাচন

সন্তানকে আদর করছে এক জেব্রা; Source: mldfoundation.org

কিছু কিছু প্রাণীবিদের ধারণা, ডোরাকাটা দাগ জেব্রাদেরকে একে অনের প্রতি আকৃষ্ট হতে সহায়তা করে। ময়ূর যেরকম পেখমের সৌন্দর্যের উপর ভিত্তি করে সঙ্গী বাছাই করে, জেব্রাও হয়তো সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ডোরার বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দেয় বলেও অনেকে ধারণা করেন। যদিও এটি শুধুই ধারণা, এখন পর্যন্ত এর পক্ষে তেমন জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তাছাড়াও এ তত্ত্ব সত্য হলে নারী জেব্রার চেয়ে পুরুষ জেব্রার ডোরা ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। অথবা কোনো অঞ্চলে জেব্রার বংশবৃদ্ধির হারের সাথে তাদের ডোরার বৈচিত্র্যের একটি সম্পর্ক লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানী চার্লস ডারাউইন এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। এছাড়াও ডোরাকাটা দাগগুলোকে অনেক বিজ্ঞানী বারকোডের সাথে তুলনা করেছেন, যার মাধ্যমে একটি জেব্রা অন্য একটি জেব্রাকে চিনতে পারে।

তাপ থেকে সুরক্ষা

তাপমাত্রা ভেদে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ডোরা বিশিষ্ট জেব্রা; Source: rsos.royalsocietypublishing.org

জেব্রার ডোরাকাটা দাগ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তারা যে এলাকায় বসবাস করে, সে এলাকার তাপমাত্রার উপর। লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ব্রেন্ডা ল্যারিসন এবং তার দল ন্যাশনার জিওগ্রাফিক সোসাইটি’জ কমিটি ফর রিসার্চ অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশনের অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রকল্পের আওতায় আফ্রিকার ১৬টি জেব্রাপ্রধান এলাকায় ভ্রমণ করেন এবং তাদের ডোরার বিভিন্ন ধরন নিয়ে গবেষণা করেন এবং লক্ষ্য করেন, অন্য সব কিছুর চেয়ে জেবরার ডোরা এলাকার তাপমাত্রার উপর বেশি নির্ভরশীল।

গবেষণা দলটি মোট ২৯টি বিষয় বিবেচনা করে। এর মধ্যে ছিল মাটির আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, রোগবহনকারী কীটপতঙ্গের উপস্থিতির পরিমাণ, সিংহ সহ শত্রু প্রাণীর উপস্থিতির পরিমাণ প্রভৃতি। এসব তথ্য কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করার পর তারা দেখতে পান, অন্য সবগুলো নির্দেশকের তুলনায় কোনো এলাকার গড় তাপমাত্রাই জেব্রার ডোরাকাটা দাগের নকশার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। গবেষণা দলটি এরপর তাদের লব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে তাদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না এরকম কিছু এলাকার তাপমাত্রার ইতিহাস থেকে সেই এলাকার জেব্রার ডোরাকাটা দাগ কীরকম ঘন এবং গাঢ় হবে, তা অনুমান করার চেষ্টা করেন। ল্যারিসনের মতে, তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন, তারা উল্লেখযোগ্য নির্ভুলতার সাথে জেব্রার ডোরা অনুমান করতে সক্ষম।

কালো রং তাপ বেশি শোষণ করার কারণে বেশি উত্তপ্ত হয়। সে কারণে উচ্চ তাপমাত্রা বিশিষ্ট এলাকায় জেব্রার শরীরে ঘন ডোরা দেখতে পাওয়া যায়। ল্যারিসনের বক্তব্য অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অন্যান্য এক রং বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে ঘন ডোরা বিশিষ্ট জেব্রার শরীরের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস কম থাকে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও উচ্চ তাপমাত্রা বিশিষ্ট এলাকায় মশা-মাছি সহ বিভিন্ন আক্রমণাত্মক কীটপতঙ্গ বেশি হয় বলে, তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যও সেসব এলাকায় ঘন ডোরা বিশিষ্ট জেব্রা বেশি দেখা যেতে পারে বলেও অনুমান করা হয়।

ফিচার ইমেজ- National Geographic

Related Articles