গরু বা মহিষ আমাদের বহুল পরিচিত প্রাণী। এতই পরিচিত যে ওদের নিয়ে দু'দণ্ড ভাবার অবকাশ আমাদের নেই। কাব্যিক ধাঁচের মন হলে বড়জোর গরুর শান্ত চোখ নিয়ে দুয়েকটা কথা বলা হয়, কিন্তু বন্য গরু বা মহিষের প্রজাতিগুলো আমাদের কাছে প্রায় অপরিচিত।
অথচ খোদ বাংলাদেশের বনে এককালে ঘুরে বেড়াত বিরাটকায় গৌর, পৃথিবীর সবথেকে বড় বন্য গরু। আরও দেখা মিলত বানতেংয়ের, যারা এখন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও অদৃশ্য। সুন্দরবন আর বৃহত্তর ময়মনসিংহের জলায় গা ডুবিয়ে থাকতো বিশাল সব বন্য জল মহিষের পাল, যাদের শিং হতো প্রায় ছয় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এসব এখন অলীক শোনায়।
উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের বাইসন, এশিয়ার গৌর, ওয়াটার বাফেলো বা আফ্রিকার কেপ মহিষের সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু বন উজাড় আর শিকারীদের গুলি এড়িয়ে এশিয়ার এদিক-সেদিক এদের আরো কিছু বন্য আত্মীয় লোকচক্ষুর আড়ালে কোনোমতে টিকে আছে, আজ সেই স্বল্পপরিচিতদের নিয়েই আলাপ হবে।
সাওলা
১৯৯২ সালে ভিয়েতনামের একদল জীববিজ্ঞানী আনামাইট পর্বত আর ভু কুয়াং জাতীয় উদ্যানে জরিপ চালাতে গিয়ে স্থানীয় শিকারীদের কাছে সাওলার খুলি পান। এর আগে প্রাণীটি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। পরে, ১৯৯৯ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপে প্রথম সাওলার ছবি তোলা সম্ভব হয়। বিশ্বে আবিষ্কৃত হয় বড়সড় আকারের এক নতুন স্তন্যপায়ী প্রাণী।
সাওলাকে গরু আর মহিষের প্রজাতিভুক্ত ধরা হলেও এ নিয়ে গবেষণা চলমান। লম্বায় এরা ফুট পাঁচেক, উচ্চতা তিন ফুটের মতো। সোজা, সরল দুটো শিংয়ের এই প্রাণীর রং লালচে বাদামী। মূল খাদ্য গাছের পাতা। সাওলা নিজের দেহ থেকে কটুগন্ধী তরল নিঃসরণ করে।
সাওলা নিয়ে খুব অল্প তথ্যই পাওয়া গিয়েছে। এরা মূলত একা ঘুরে বেড়ায় আর অত্যন্ত নিঃশব্দচারী। ভিয়েতনামের যেসব অঞ্চলে এদের বাস, সেখানকার মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে শিকারী। ভীষণ বিরল প্রাণী এই সাওলা, তাই শিকারীদের কাছে বেশ কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে অবশ্য প্রাণীটিকে রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কৌপ্রে
প্রায় সাড়ে সাত ফুট লম্বা, উচ্চতায় ছয় ফুটের বেশি, ওজন পৌঁছায় প্রায় ৯০০ কেজিতে। কৌপ্রে সবদিক দিয়েই বিরাট। সরু পা আর লম্বাটে দেহের এই বন্য গরুদের আদি নিবাস কম্বোডিয়া।
কৌপ্রে নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ১৯৩৭ সালে পশ্চিমা বিশ্ব এদের সন্ধান পায়। ছোট দলে ভাগ হয়ে এরা বনের প্রান্তবর্তী তৃণভূমিতে চরে বেড়ায়। গায়ের রঙ কালো, ধূসর বা গাঢ় বাদামি।
মাংসের জন্য এদের নির্বিচারে নিধন করা হত। খুব সম্ভবত বিরাট এই প্রাণীটি পৃথিবীর বুক থেকে ইতোমধ্যেই লোপ পেয়েছে। ১৯৮৩ সালের পর বন্য পরিবেশে আর কৌপ্রেকে দেখা যায়নি। চিড়িয়াখানাতেও এদের কোনো নমুনা নেই। কম্বোডিয়ার বনাঞ্চলগুলোতে এখনো জরিপ চালানো হয় নিয়মিত, কিন্তু কৌপ্রের কোনো হদিস আর পাওয়া যায় না। কৌপ্রেকে কম্বোডিয়ার জাতীয় পশুর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
তামারাও
তামারাওয়ের দেখা মেলে ফিলিপাইনের মিন্দোরো দ্বীপে। ১৮৮৮ সালে বিশ্ব প্রথম এদের কথা জানতে পারে।
১৯০০ সালের আগপর্যন্ত মিন্দোরো দ্বীপে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল ভয়াবহ। যা-ই হোক, পরে ম্যালেরিয়ার ঔষধ আবিষ্কার হলে মানুষ বসতি স্থাপন করে, শুরু হয় শিকার আর বন উজাড়। একশো বছরের মধ্যে তামারাওয়ের সংখ্যা দু'শোয় নেমে আসে। বর্তমানে অবশ্য এদেরকে রক্ষার নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুটি মাত্র সংরক্ষিত অঞ্চলে আজ তামারাও নামের এই ছোট্ট মহিষগুলো টিকে আছে।
তামারাও লম্বায় প্রায় ছয় ফুট, উচ্চতা সাড়ে তিন ফুটের মতো। গায়ের রং ধূসর বাদামি। মোটা ছোট শিং আছে এদের। দুই থেকে তিনশো কেজি ওজনের হয়। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলের বন আর ঘাসে ঢাকা ঢালে চরে বেড়ায় এরা।
আকারে ছোট হলে কী হবে, ভীষণ বদমেজাজি বলে দুর্নাম আছে এদের। মানুষ কাছাকাছি এলেই শিং বাঁকিয়ে আক্রমণ করে। বন্য অবস্থায় চার থেকে পাঁচশো তামারাও টিকে আছে।
আনোয়া
আনোয়া বা বামন মহিষের দেখা মেলে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি আর বুটোন দ্বীপে। এরা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম বনগরু। সংখ্যায় মাত্র কয়েক হাজার টিকে আছে।
আনোয়া দুটি প্রজাতিতে বিভক্ত- নিম্নভূমির আনোয়া আর পার্বত্য আনোয়া। দুটি প্রজাতিই কালো, বাদামি বা ধূসর বর্ণের। গভীর বনে একা বা জোড় বেধে এরা ঘুরে বেড়ায়।
নিম্নভূমির আনোয়া উচ্চতায় বড়জোর তিন ফুট, পার্বত্য আনোয়া আরো ছোট। এদের শিং সোজা আর সরল, মাদীগুলোর শিং খুবই ছোট। লাজুক স্বভাবের এই প্রাণীটি শিকারীদের প্রিয়। বন উজাড় আর বেদম শিকারের ফলে, সেইসাথে যথেষ্ট সংরক্ষণ প্রচেষ্টার অভাবে আনোয়াদের সংখ্যা দ্রুত কমছে।
বানতেং
বহু আগে থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ বানতেংয়ের সাথে পরিচিত। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এদের পোষ মানানো হয়। তবে বন্য অবস্থাতেও বহু বানতেং টিকে আছে।
বানতেং বিরাটকায় বন গরু। লম্বায় ছয় ফুটের বেশি, উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফুট। পুরুষ বানতেংদের রং কালো বা গাঢ় বাদামি, স্ত্রীদের রং লালচে। গৌরের মতো এদেরও হাঁটুর নিচের অংশ সাদা। পায়ের পেছনদিকে বড়, সাদা ছোপ আছে। গভীর বনে এদের বাস। তৃণভূমিতে ছোট দলে ভাগ হয়ে চরে বেড়ায়।
এককালে উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ চীন, ভিয়েতনাম আর ইন্দোনেশিয়াতে বানতেং পাওয়া যেত। বর্তমানে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া আর কদাচিৎ মায়ানমারে দেখা মেলে। বোর্নিও দ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার জাভাতেও বন্য বানতেং আছে কিছু পরিমাণে।
শিকার, গৃহপালিত গরু থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগবালাইয়ের কারণে গভীর বনের এই বাসিন্দারা হুমকির মুখে। বানতেংয়ের মাংস সুস্বাদু হওয়ায় এদের বিপদ আরো বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীকে বানতেংয়ের মাথার প্রতিলিপি আছে।
বন্য চমরীগাই
সুবিশাল বন্য ইয়াকে চমরী গাইয়ের দেখা মেলে চীনের তিব্বত, কিংহাই, দক্ষিণ জিনজিয়াং আর ভারতের লাদাখে। নেপাল আর ভুটানে দলছুট একটা-দুটো মিললেও মিলতে পারে। বন্য আর গৃহপালিত চমরী গাই কিন্তু আলাদা প্রজাতি। বন্য চমরী গাই মালামাল বইতে পারে না এবং জোর করে পোষ মানাতে চাইলে বেশিদিন বাঁচে না।
চমরী গাই লম্বায় প্রায় আট ফুট, উচ্চতায় প্রায় সাত ফুট। ওজনে হাজার কেজি ছাড়িয়ে যায়। গোটা দেহে বিশাল ঝালরের মতো লোম থাকে, প্রবল শীতের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কালো বা কালচে-বাদামি এদের গায়ের রঙ। মাঝেমধ্যে সোনালি লোমের চমরী গাইয়ের দেখা মেলে, যদিও তারা খুবই বিরল। দশ হাজার ফুট উচ্চতার পার্বত্য তুন্দ্রা অঞ্চলে দলবল পাকিয়ে এরা ঘুরে বেড়ায়।
বর্তমানে হাজার দশেকের মতো বন্য চমরী গাই টিকে আছে। সংরক্ষিত হলেও সুস্বাদু মাংসের জন্য চোরা শিকারীরা এদেরকে হত্যা করে।
গৌর
আট থেকে দশ ফুট লম্বা, উচ্চতায় প্রায় সাত ফুট, ওজন ছাড়িয়ে যায় হাজার কেজি। গৌর বা ভারতীয় বাইসন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বনগরু। সংখ্যাগত দিক দিয়েও এরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। অবশ্য বাংলাদেশ আর শ্রীলংকা থেকে এরা লোপ পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতেই সর্বাধিক গৌরের দেখা মেলে। এছাড়া নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া আর দক্ষিণ চীনেও গৌর আছে।
গৌর বনচারী প্রাণী। দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। আকারে বিরাট হওয়ায় এদের প্রাকৃতিক শত্রু কম; বাঘ পর্যন্ত ভেবেচিন্তে আক্রমণ করে। যদিও মানুষের বন্দুক এদের নিষ্কৃতি দেয় না, তাই অনেক অঞ্চলেই গৌর লোপ পেয়েছে। এদের রং কালো, হাঁটুর নীচ থেকে পা সাদা। বিরাট কুঁজ আর বাঁকানো শিংওলা গৌর শান্ত মেজাজের প্রাণী। কিন্তু বাচ্চা সাথে থাকলে, বা কখনো স্রেফ খেয়ালের বশে এরা আক্রমণ করে বসতে পারে। ক্রুদ্ধ গৌরের সামনে খোদ বাঘকে পর্যন্ত হটে যেতে দেখা গিয়েছে।
গৃহপালিত গরু আর গৌরের মিলনে জন্ম নেয় গয়াল বা মিথুন নামক সংকর। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে গয়ালের দেখা মেলে। এরা অনেকটা আধা বন্য প্রাণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় টেকনাফে দেশের শেষ গৌরটিকে গুলি করে মারা হয়েছিল। অবশ্য সম্প্রতি বান্দরবানে ক্যামেরা ট্র্যাপে গৌরের দেখা মিলেছে।
This article is about wild cattle and buffalos that are still found in remote corners of Asian jungle.
References:
1. Forgotten species: the wild jungle cattle called banteng
2. The saola: rushing to save the most ‘spectacular zoological discovery’ of the 20th Century
3. Time is running out for Southeast Asia
4. The ambitious plan to recover and rewild the feisty, dwarf cow
5. গাজী এস এম আসমত, বাংলাদেশের বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী, ২০০১, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১০০০
Featured Image © Barney Long