Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা নিয়ে অরুণ জেটলি ২০১৮-তে ঠিক কাকে খোঁটা দিলেন?

প্রতি বছর, ২৫ জুন ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বিশেষ দিন হিসেবে পরিগণিত হয়। তেতাল্লিশ বছর আগে, এই দিনটিতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন নিজেকে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ‘সমস্যামুক্ত’ করতে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে কলুষিত অধ্যায় হিসেবে ধরা হয় একুশ মাসের সেই জরুরি অবস্থাকে, যখন ইন্দিরা এবং তার কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতির জলাঞ্জলি দিয়ে গা-জোয়ারি শাসনে শামিল হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।

তেতাল্লিশ বছরে পরে ভারতের রাজনীতিতে এখন অন্য দিশায় হাওয়া বইছে। ইন্দিরা-সঞ্জয়ের বংশধর রাহুল গান্ধী আজকের ভারতে বলা চলে প্রায় ব্রাত্য, তার জাতীয় কংগ্রেসের পিদিমও প্রায় নিভু নিভু; অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আজ রমরমা অবস্থা; কেন্দ্রে দাপটের সঙ্গে শাসন করা ছাড়াও একের পর এক রাজ্য দখল করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গেরুয়াবাহিনীকেই বলা চলে এই নতুন যুগের কংগ্রেস। আর বিজেপি প্রতি বছরই ২৫ জুন দিনটিকে ঘিরে একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু করে; জনমানসে কংগ্রেসের ভাবমূর্তিটিকে আরও খর্ব করার জন্যে। কংগ্রেসও পাল্টা মনে করে শ্রীমতি গান্ধীর ভূমিকার কথা; তার লৌহ নেতৃত্বের কথা।

ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি; Source: Twitter handle of Arun Jaitley @arunjaitley

তবে, এই চিরকালীন রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টির মধ্যে ২০১৮ সালের ২৫ জুন দিনটিতে একটি অভিনবত্ব  চোখে পড়ল। খালি চোখে যদিও ব্যাপারটিকে অভিনব বলে মনে হবে না, কারণ আপাতদৃষ্টিতে সব প্রত্যাশিতই ঠেকবে; কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখলে এবং ভাবলে বোঝা যাবে যে ব্যাপারটি হয়তো অতটা সরল নয় যতটা দেখতে লাগছে।

অরুণ জেটলির ব্লগটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ

এবারের ২৫ জুনে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, যিনি সম্প্রতি কিডনিজনিত অস্ত্রোপচারের পরে আপাতত বিশ্রামে রয়েছেন, তার ফেসবুক ব্লগে তিনটি ধারাবাহিকে লেখেন ঠিক কী পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার জরুরি অবস্থার ডাক দিয়েছিল এবং তার প্রভাব ভারতের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে কীরূপ পড়েছিল। তিনি তার নিজের জেলদর্শনের কথাও লেখেন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে নীতির থেকে স্লোগানের উপরে জোর দেওয়ার জন্যে ইন্দিরা সরকারের নিন্দা করেন।

এ সমস্ত তো ঠিকই আছে। অতীতের অপেক্ষাকৃত বলবান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে কোনো রাজনৈতিক শক্তিই ছেড়ে কথা বলবে না, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু জেটলি সাহেবের এই ব্লগগুলি তোলে কিছু অন্য প্রশ্ন।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Author: Narendra Modi’s Twitter handle @narendramodi

হয় অরুণ জেটলি বিজেপির অনুগত সৈনিকের কাজ করেছেন নয়তো…

প্রথমত, আজ নরেন্দ্র মোদী সরকার চার বছর অতিক্রান্ত করার পর হঠাৎ তেতাল্লিশ বছর আগেকার সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নতুন করে বিশ্লেষণ কেন করতে উদ্যোগী হলেন অর্থমন্ত্রী? পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের যেখানে আর এক বছরও বাকি নেই এবং নানা দিক থেকে আসা নানা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চাপের মুখে শাসক বিজেপির বেশ কিছুটা জেরবার অবস্থা, তখন জেটলির এই ধারাবাহিক ব্লগ বেশ কিছু ইঙ্গিত বয়ে আনে।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী; Source: Author: Dutch National Archives, The Hague, Fotocollectie Algemeen Nederlands Persbureau (ANEFO), 1945-1989; Wikimedia Commons

প্রথমত, জেটলি কি এটা ভালোই বুঝেছেন যে, মোদী যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৪ সালে আসীন হয়েছিলেন, সেগুলোর অনেকই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এবং তার ফল হাতেনাতে মিলতে পারে ২০১৯-এ? তাই, মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এবং মন পেতে ফের খাড়া করছেন সেই কংগ্রেস-ধোলাইয়ের চিরাচরিত ফর্মুলা? সেক্ষেত্রে, বলা চলে যে একজন নিষ্ঠাবান অনুগত সৈনিকের মতোই জেটলি তার অসুস্থতা সত্ত্বেও দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার তাগিদে প্রতিপক্ষের চার দশকেরও পুরোনো অপকর্মটিকে প্রকাশ্যে ফের নির্মাণ করে মানুষকে বোঝাতে তৎপর যে, এই মুহূর্তে ভারতে মোদীর চেয়ে ভালো আর কোনো নেতৃত্ব নেই; ২০১৯-এও তাই ‘বিকল্পহীন’ মোদীকেই উচিত দেশের ধ্বজাধারী নায়ক করা। হাজার হলেও দেশের ভবিষ্যৎ একমাত্র তার হাতেই সুরক্ষিত।

কিন্তু অপরদিকে অন্য একটি সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। ক্ষমতায় থাকার চার বছর পরে যখন মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হওয়া বেশ জোরে বইছে- সংখ্যালঘু উৎপীড়ন, কর্মহীনতা, নারীবিদ্বেষ, বাকস্বাধীনতার অধঃপতন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল মন্তব্যের অভিযোগ ইত্যাদি নানা কারণে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বেশ বিব্রত, তখন জেটলির এরূপ ১৯৭৫-এর কাহিনীর পুনর্নির্মাণ অনেককেই বেশ অবাক করেছে। তিনি কি তাহলে অন্য কোনো লক্ষ্যের দিকে তাক করেই তার ধারাবাহিকগুলি লিখেছেন?

সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং লেখক রামচন্দ্র গুহ তার একটি টুইটে জেটলির ব্লগে লেখা তিনটি শীর্ষকের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এক, ‘গণতন্ত্রে কি ব্যক্তি অপরিহার্য?’; দুই, ‘অর্থনীতির অব্যবস্থা, স্লোগান বনাম নীতি’ এবং তিন, ‘চূড়ান্ত ক্ষমতার চূড়ান্ত অবক্ষয়’।

শীর্ষকগুলি বন্দুকের নল আজকে কার দিকে ঘোরায়?

এই তিনটি শীর্ষকই নিঃসন্দেহে ১৯৭৫ সালের সর্বোচ্চ নেত্রী ইন্দিরাকে তাক করে লেখা, কিন্তু এর মধ্যে অনেকে একটু অন্য কাহিনীও দেখছেন। নরেন্দ্র মোদীর উত্থান এবং তার প্রধানমন্ত্রিত্বের শুরুর দিকে অরুণ জেটলি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম একজন সদস্য হলেও যত সময় এগিয়েছে এবং পদ্মবাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে, ততই এই ৬৫-বছর বয়সী নেতা জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছেন। জেটলির নিজের কোনো গণভিত্তি না থাকলেও কেন্দ্রে তার গুরুত্ব দুটি কারণে।

বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী; Source: Author: Rashmirparida; Wikimedia Commons

এক, তার গণমাধ্যমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, যার দরুন তিনি মোদী নেতৃত্বের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সেতুবন্ধনের কাজটি ভালো পারেন এবং দুই, দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দের সঙ্গে তার পরিচয় দৃঢ় হওয়ায় ‘বহিরাগত’ মোদী এবং তার সেনাপতি অমিত শাহের কাছে তার গুরুত্ব যথেষ্ঠ।

কিন্তু, একই সঙ্গে, জেটলির তত্বাবধানে অর্থনীতির সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারা (যদিও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের মুখ্য দায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের উপরেই বর্তায় এই কয়েক বছরে); তার নিজস্ব রাজনৈতিক গণভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও বিজেপির উপরের সারিতে তার অবস্থান বা বিজেপির অনেক নেতার সঙ্গেই তার ধোপদুরস্ত-ইংরেজি বলিয়ে ভাবমূর্তির ফারাক- এই সমস্ত কারণে অর্থমন্ত্রীর শত্রুর সংখ্যাও বিজেপিতে নেহাত কম নয়।

বিজেপির এক বর্ষীয়ান নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী- যিনি আবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ- সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক আক্রমণ শাণিয়েছেন জেটলির প্রতি এবং বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব তাতে বিন্দুমাত্র ওজর-আপত্তি তোলেনি; এমনকি প্রধানমন্ত্রী মোদীও নন। অনেকের মতে, মোদী-শাহদের এই নীরবতা জেটলিকে আহত করেছে। সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর পক্ষ থেকে জেটলিকে স্যুট-টাই পরা ওয়েটার বলে কটাক্ষ করা হলেও কোনো বিজেপি নেতা জেটলির সমর্থনে এগিয়ে আসেননি।

তবে কি তাহলে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির তেতাল্লিশতম বার্ষিকীতে একনায়কতন্ত্র, অর্থনৈতিক ডামাডোল, ক্ষমতার অবক্ষয় ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরোক্ষে জেটলি খোঁটা দিলেন নিজের দলের সরকারকেই? অনেকেই হয়তো বলবেন, মোদী ইন্দিরার মতো জরুরি অবস্থা জারি করেননি তাই এই খোঁটার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। কিন্তু, একথা তো অস্বীকার করা যায় না যে, বর্তমান সময়ে কাশ্মীর এবং ভারতের অন্যান্য প্রান্তে নানা বিষয়ে মোদী সরকারকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে দেশের ভিতরে ও বাইরেও। এও বলা হচ্ছে যে, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি অবস্থা জারি না করেই কার্যসাধন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সেই পদক্ষেপ নিয়ে দুনিয়ার চক্ষুশূল হওয়ার প্রয়োজন কী?

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলাতে একটি জনসভায় বক্তব্য রাখছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ; Source: Amit Shah’s Twitter handle @AmitShah

যেকোনো চতুর মানুষই, যখন তার নিজের দলই সমালোচনায় বিদ্ধ, তখন অন্যের সমালোচনায় মুখর হওয়া থেকে বিরত থাকবে, কারণ তাতে হিতে বিপরীত হবে। অরুণ জেটলি অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ। তিনি যা করেছেন জেনেই করেছেন। আর সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েই নিজের অপমানের শোধটি ভালোভাবেই হয়তো নিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীকে সমালোচনার উসিলায়। কিন্তু কেউই তাকে দোষী ঠাওরাতে পারবে না।

সত্যিই, রাজনীতিকরা কত বুদ্ধিই না ধরেন!

Featured Image Source: DNA India

Related Articles