Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীন কি পুনরায় সমাজতন্ত্রে ফিরে যাচ্ছে?

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুং চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের গোড়াপত্তন করেন। সে থেকে চীনে এ একদলীয় শাসনই চলে আসছে। মাও সে তুং ছিলেন কট্টর সমাজতান্ত্রিক নেতা। ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যুর পর তুলনামূলক মধ্যপন্থী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন দেং শিয়াও পিং। তখন নামে কমিউনিস্ট পার্টি হলেও দলটির শাসন ব্যবস্থা ছিল কার্যত ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের চীনা সংস্করণ।

গত চার দশক এমনই চলছিল। তবে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীনের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। চীন যেন ফিরে যাচ্ছে আবার মাও যুগে। গত এক বছরে চীনের অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু কার্যক্রম ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা আবার সমাজতন্ত্রে ফিরে যাচ্ছে।

সত্তরের দশকে চীনের অর্থনীতি তলানির দিকে থাকলেও আজ তারা যুক্তরাষ্ট্রের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেং শিয়াওপিংয়ের সময় চীনে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু এতে চার দশকে চীন অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ হলেও দেশটির আয় বা সম্পদের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। তখন যারা সঠিক সময়ে সঠিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তারাই আজ নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থায় রাখতে পারছে।

শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীনের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে; Image Source: Lintao Zhang / Getty Images file

আশির দশকে যাদের বাবা-মায়েদের কল-কারখানা কেনার মতো সামর্থ্য ছিল, তারাই এখন স্পোর্টস কার নিয়ে ঘুরতে পারে। অন্যদিকে নির্মাণ শ্রমিকরা আদৌ কোনোদিন একটা বাড়ি কেনার মতো সামর্থ্যবান হতে পারবে কিনা সন্দেহ। চীনের সবচেয়ে ধনী শ্রেণি মোট জনগণের ২০ শতাংশ, যাদের আয়ের পরিমাণ সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশের দশ গুণ বেশি। আয়ের এ বৈষম্য আমেরিকা বা জার্মানি, ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়েও বেশি।

গত এক দশকে চীনে হতদরিদ্রের সংখ্যা অনেক কমে আসলেও ৬০ কোটিরও বেশি সংখ্যক মানুষের (যা চীনের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) বছরে ইনকাম ১২ হাজার ইউয়ান বা ১,৮৫৮ মার্কিন ডলারেরও কম, বাংলাদেশি টাকায় যা মাত্র ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ব্লুমবার্গের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের ৫০০ ধনীর ব্যক্তির মাঝে দেশটির বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ৮১ জন। আমেরিকার পর যা কোনো দেশের সর্বোচ্চ। এছাড়াও হাজার হাজার বিলিয়নিয়ার ও মিলিয়নিয়ার ব্যক্তিরা আছেন, যারা প্রথম ৫০০ এর তালিকায় আসতে পারেননি।

শি জিনপিং চাচ্ছেন এরকম ব্যবস্থা আর চলতে না দিতে। চীন সরকার তার নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে নিয়ে আসছে, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে। শি জিনপিং ২০১৭ সালের এক ভাষণে প্রথম ‘কমন প্রসপারিটি’ টার্মটি আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এটা মাও সে তুং এর সময় বেশি প্রচলিত ছিল। তবে গত এক বছরে শি জিনপিংয়ের এ টার্ম ব্যবহার করার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত এক বছরের মধ্যে শি জিনপিংয়ের প্রথম শিকার ছিল আলিবাবার ফিনটেক কোম্পানি অ্যান্ট গ্রুপ; Image Source: Aly Song/Reuters

শুরুটা করেছিলেন গত বছর আলিবাবার ফিনটেক কোম্পানি অ্যান্ট গ্রুপের পাবলিক কোম্পানি হিসাবে নাম লেখানো বা আইপিও আটকে দিয়ে। তবে সেটার জন্য আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা সরকারের সমালোচনা করারও একটা ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন অনেকে। সে থেকে জ্যাক মাকে খুব বেশি জনসম্মুখে দেখা যাচ্ছে না। টেনসেন্ট, ডিডিসহ বেশ কিছু টেক কোম্পানিকে পড়তে হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির খড়গে। এসব বেসরকারি বিগ টেক কোম্পানি ও তাদের প্রতিষ্ঠাতারা সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছিলেন। শি জিনপিং তাদের একটা বার্তা দিতে চাচ্ছেন পার্টির ওপরে কিছু নেই।

তবে চীন শুধু টেক কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেই বসে নেই। পুরো সমাজ ব্যবস্থাকেই যেন পরিবর্তন করতে নেমেছে তারা। তারা দেখছে শিশুরা অলস হয়ে পড়ছে, ভিডিও গেমে বেশি সময় দিচ্ছে। এ কারণে ১৮ বছরের নিচের শিশুদের অনলাইন ভিডিও গেমের জন্য সপ্তাহে এক ঘণ্টা সময় বেধে দিয়েছে সরকার। তারা কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আর সরকারি ছুটিতে রাত ৮টা থেকে ৯টা গেম খেলতে পারবে। চীন ভিডিও গেমের আসক্তিকে দেখছে ‘আধ্যাত্মিক আফিম’ হিসেবে।

এছাড়া চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় তীব্র প্রতিযোগিতা থাকায় বাচ্চাদের স্কুলের পর প্রাইভেট পড়ানোর পেছনে বাবা-মাদের অতিরিক্ত খরচ করতে হয় দেখে তারা নতুন ‘তিন সন্তান নীতি’তে আগ্রহ পাচ্ছেন না। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ওপরও চাপ বাড়ছে। এ কারণে স্কুলের পর অতিরিক্ত সময় পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এতে আদৌ কতটুকু সমাধান হবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করা হলেও প্রতিযোগিতা কমেনি। ফলে অবৈধভাবে হয়তো ঠিকই এসব চলবে। আর তখন হয়তো সেগুলো আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। আর তা কেবল বিত্তবানরাই বহন করতে পারবে।

চীনের অন্যতম লাভজনক একটা ক্ষেত্র বিনোদন খাত। ২০২১ সালে ৩৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেভিনিউ আসতে পারে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি থেকে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়নি এ খাতও। অভিনেতাদের ‘মেয়েলি’ভাবে উপস্থাপন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে পার্টির পক্ষ থেকে। চীন মনে করছে তারা ‘পুরুষত্ব সঙ্কটে’ ভুগছে। বর্তমান ছেলে শিশুরা ও টিনেজাররা শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল। ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে উপযোগী পুরুষ সদস্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্কটে পড়তে পারে দেশটি।

পুরুষ শিল্পীদের মিডিয়াতে ‘মেয়েলি’ রূপে উপস্থাপন করা নিষিদ্ধ করেছে চীন; Image Source: Zhu Ren/VCG via Getty Images

তাই তারা চাচ্ছে বিনোদন জগতে এমন সব কন্টেন্ট দেখানো হোক, যা দেখে শিশুরা বিপ্লবী চিন্তায় জাগ্রত হবে। তারা আগে থেকেই পুরুষ শিল্পীরা কানের দুল পরা থাকলে সেগুলো ব্লার করে দিত। ট্যাটু আর পুরুষদের পনিটেল চুলও ব্লার করে দেওয়া হতো।

তারকাদের নিয়ে উন্মাদনাও সীমিত করতে চাচ্ছে তারা। দেশটিতে জনপ্রিয় তারকাদের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীনের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ওয়েইবুতে বেশ কিছু কোরিয়ান পপ তারকাদের ফ্যান ক্লাব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

চীন মনে করে তারকারা পার্টির সমালোচনা করলে সেটা তরুণসহ অন্যান্য জনসাধারণের মাঝে ভালো প্রভাব ফেলে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে তারা। তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঝেং শুয়াংকে কর ফাঁকির অভিযোগে ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়েছে। আরেক জনপ্রিয় বিলিয়নিয়ার অভিনেত্রী ঝাও ওয়েইর সিনেমা, ভিডিও, বিজ্ঞাপনচিত্র বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

শি জিনপিংয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন। কারণ চীনা রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াতেও সাক্ষাৎকার দেন না। তবে একটা তত্ত্ব হচ্ছে, শি জিনপিং তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছেন। ২০১৮ সালে তিনি অবশ্য আইন পরিবর্তন করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। তবে তৃতীয়বারের মতো আসতে গিয়ে তিনি হয়তো নিজেকে জনপ্রিয় হিসাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন।

চীনের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঝেং শুয়াংকে কর ফাঁকির অভিযোগে ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়েছে; Image Source: GETTY IMAGES

তার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত অবশ্যই জনকল্যাণকর। যেমন- স্বাস্থ্য খাতের খরচকে জনসাধারণের আয়ত্বের মধ্যে আনতে চানছেন। এছাড়া চীনের কর্মক্ষেত্রের বিতর্কিত ‘৯৯৬’ ঐতিহ্য কীভাবে আইন ভঙ্গ করতে পারে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রাইড শেয়ারিং ও ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলোকে তাদের নিম্ন আয়ের কর্মীদের ব্যাপারে যত্নবান হতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের বাড়ি কেনার ব্যাপারটা সামর্থ্যের মধ্যে আনার জন্যও কাজ করছে তারা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, শি জিনপিং এর আদর্শের সাথে তার বাবার আদর্শ ছিল অনেকটাই বিপরীত। তার বাবা অনেকটাই মধ্যপন্থী ছিলেন। এ কারণে মাওয়ের যুগে তিনি নিষিদ্ধও হয়েছিলেন। পরে দেং শিয়াওপিংয়ের সময় আবার ফিরে আসেন। শি জিনপিং হয়তো তার বাবার সাথে একমত পোষণ করেন না।

তবে অনেকেই মনে করছেন তার কার্যক্রমগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ। কোনো ক্ষেত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেখানে সরকার প্রতিক্রিয়া দেখাবেই। সেক্ষেত্রে এটা হয়তো সাময়িক একটা ঝড়। পার্টির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতি সরকারের সহযোগিতা সবসময়ই থাকবে।

This is a Bengali article written about China's recent crackdown on different sectors of the country. All the references are hyperlinked in the article. 

Featured Image: AP Photo/Ng Han Guan

Related Articles