নাগরিক স্বাধীনতা: মুক্ত, সাম্য ও কল্যাণরাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত্তি

মানুষের জন্ম হয় একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে, স্বাধীন মানুষ হিসেবে। এরপর মানুষ ক্রমাগত বিভিন্ন সামাজিক বন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চক্রে আটকে যায়, পড়তে হয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বিধি নিষেধের শেকল। এর পাশাপাশি, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের দায়বদ্ধতা থাকে, থাকে ধর্মীয় মতানুসারে জীবনধারণের বাধ্যবাধকতা। মানুষের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতাগুলো বাস্তবিক ভিত্তি রয়েছে, এই দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতাগুলোর মধ্য থেকে ব্যক্তি নিজে লাভবান হয়, লাভবান হয় সমাজ ও রাষ্ট্র। মানুষ অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতাগুলোও গ্রহণ করে নিজের জৈবিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন সামনে রেখেই।

মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে; Image Source: Karen McCarthy

মানুষের বিভিন্ন ধরনের দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী রাজনৈতিক কাঠামোতে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাগুলোর উৎস আলাদা, রয়েছে আলাদা স্বার্থগোষ্ঠী। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, রাজনৈতিক বিধিনিষেধের মাধ্যমে মানুষ সাধারণত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, রাজনৈতিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। এর মাধ্যমে নাগরিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, দীর্ঘমেয়াদে শাসকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হন, ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশ।

নাগরিক স্বাধীনতা কী?

স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের বিশ্বাস নিয়ে ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়, রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ফ্রান্স যাত্রা করে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের দিকে। ফ্রান্সের সাথে একই সময়ে, রেনেসাঁর মাধ্যমে উঠে আসা সংস্কারপন্থী ধারণাকে কেন্দ্র করে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন ঘটতে থাকে ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তেও। নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র থেকে কিছু কিছু দেশ পুরোপুরি রিপাবলিকে পরিণত হয়, ইউরোপের অনেক দেশেই আসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র।

পরের কয়েক শতাব্দীতে গণতন্ত্র ক্রমাগত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে, শাসনতান্ত্রিক আদর্শের লড়াই শেষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাগরিক স্বাধীনতা। বর্তমান সময়ে নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সামাজিক কাঠামোতেও নাগরিক স্বাধীনতার ধারণার বিকাশ ঘটছে, বাড়ছে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, বাড়ছে রাজনৈতিক সচেতনতা, বাড়ছে নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা।

নাগরিক স্বাধীনতা একটি সামষ্টিক ধারণা। এর মাধ্যমে নাগরিকেরা বাধাহীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো চর্চার করতে পারে, দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করতে পারে, বাসস্থান পরিবর্তন করতে পারে, পরিবর্তন করতে পারে পেশা, অর্থনৈতিক কাজের লিগ্যাসি। নাগরিক স্বাধীনতার মাধ্যমে একজন নাগরিক স্বাধীনভাবে, যেকোন পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে, অন্য একজন নাগরিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

নাগরিক অধিকার জানা এবং চর্চা করা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়া; Image Source: Dreamstime.com

নাগরিক স্বাধীনতা একজন নাগরিককে মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, দেয় বাকস্বাধীনতা। স্বাধীন গণমাধ্যম নাগরিক স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে, নাগরিক স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে রাজনৈতিক পছন্দের জায়গাগুলো। একজন নাগরিক নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক দল তৈরির অধিকার রাখেন, যেকোনো রাজনৈতিক ইস্যুর প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষণ করতে রাজনৈতিক কর্মসূচিত আয়োজন করতে পারেন, রাজনৈতিক গ্রুপ তৈরি করতে পারেন।

নাগরিক স্বাধীনতা একজন নাগরিককে আইনি স্বাধীনতা উপভোগ করেন, উপভোগ করেন আইনি সুরক্ষা। যেকোনো নাগরিক অধিকার রাষ্ট্র, কোনো ব্যক্তি বা শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান হরণ করলে একজন নাগরিক বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে পারেন, বিচার বিভাগ তখন কাজ করবে তার নাগরিক অধিকারগুলোর সুরক্ষাকারী হিসেবে, তৈরি করবে সুরক্ষাবলয়। যেকোনো অপরাধে একজন নাগরিক আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন, সুযোগ পাবেন আইনি কাঠামোতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের।

নাগরিক স্বাধীনতার প্রকারভেদ

বর্তমান সময়ে তাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক স্বাধীনতার ইস্যু আলোচনা করা হয়। প্রকারভেদের আলোচনা করলে, মোটামুটিভাবে আমরা পাঁচ ধরনের নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা

একজন নাগরিক স্বাধীনভাবে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে, যেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ নয়। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা মানুষের অর্থনৈতিক কাজের সিদ্ধান্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। কিন্তু, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা হিসেবে পরিণত করার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই নাগরিকদের কোনো পেশা গ্রহণে বাধ্য করারও।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নাগরিক স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; Image Source: Dimond Consultaints. 

কমিউনিজম এবং সমাজতন্ত্রে মানুষের এই স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করা হয়, রাষ্ট্র ঠিক করে দেয় কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদন করতে হবে, ক্ষেত্রবিশেষে ঠিক করে দেয় কোনটি কিনতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা থাকে না এই দুই অর্থনৈতিক মডেলে, থাকে না ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের সুযোগ। ফলে, ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের স্বার্থে অধিক পরিশ্রম করার মানসিকতা হারিয়ে যায় মানুষের মধ্যে, যা সামগ্রিকভাবে একটি অসুখী সমাজ তৈরি করে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক প্রক্রিয়াগুলোর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা

একজন নাগরিক, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল ধরনের রাজনৈতিক অধিকার উপভোগ করবেন। একজন নাগরিক নিজের ইচ্ছামতো যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি নিজের সমর্থন জানাতে পারেন, আবার সমর্থন প্রত্যাহারও করতে পারেন। রাষ্ট্র, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ায় বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারে না।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার; Image Source: Gallup News. 

পাশাপাশি, একজন নাগরিকের স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশের অধিকার থাকবে, সরকারব্যবস্থা এবং সরকারি কার্যক্রম নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে। একজন নাগরিক স্বাধীনভাবে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতা পাবেন, স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চার অধিকার পাবেন।

জাতীয় স্বাধীনতা

একটি দেশের সকল লোক একই ধরনের নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে, নাগরিক সুবিধাগুলোতে প্রবেশাধিকার পাবে। পাশাপাশি, নাগরিক সুবিধা প্রদানের প্রক্রিয়াতে কোনো ধরনের অসঙ্গতি হলে যেকোনো নাগরিক সেই সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারবে।

রাষ্ট্র কতটুকু নাগরিক সুবিধা সরবারহ করবে, তা অনেক সময়ই রাষ্ট্রের অনুসৃত অর্থনৈতিক মডেলের উপর নির্ভর করে। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে সাধারণত নাগরিকদের খাওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার মতো সকল নাগরিক সুবিধাই রাষ্ট্র সরবরাহ করে। রাষ্ট্রের হাতে পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকায় রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রের নিয়োজিত আমলারা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যান।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে রাষ্ট্র বাজারকে চাহিদা আর যোগানের উপর ভিত্তি করে প্রবাহিত হতে দেয়, রাষ্ট্র বাজারের প্রবাহে হস্তক্ষেপ করে খুবই কম। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতগুলোও চলে যায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অধীনে, চলে যায় পুঁজিপতিদের হাতে।

মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের অধিকার রয়েছে; Image Source: Dhaka Tribune. 

কমিউনিজম আর পুঁজিবাদ, এই দুই অর্থনৈতিক মডেলের একটি সমন্বয় আছে সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে। এই অর্থনৈতিক মডেলে রাষ্ট্র বাজারের উপর কম হস্তক্ষেপ করে, তবে কাউকে মনোপলি কাজে লাগিয়ে সীমাহীন মুনাফা অর্জনের সুযোগ দেয় না। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতগুলো থাকে সরকারের অধীনে। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতেই শিক্ষা আর স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানের।

ব্যক্তিগত স্বাধীনতা

একজন নাগরিক যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন, যেকোনো পন্থায় তার ব্যক্তিগত জীবন কাটাতে পারেন, স্বাধীনভাবে তার বন্ধু নির্বাচন করতে পারেন। রাষ্ট্র কোনোভাবেই এই প্রক্রিয়াগুলোতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না কিংবা এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে না। পাশাপাশি, রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, কোনোভাবেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভাঙবে না, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার হরণ করবে না।

মানুষের স্বাধীন সত্ত্বার স্বীকৃতি

মানুষের স্বাধীন সত্ত্বাকে রাষ্ট্র স্বীকার করে নেবে। প্রতিটি মানুষই স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে। রাষ্ট্র সেই স্বাধীন সত্ত্বার প্রতি সম্মান জানাবে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো মানুষ যখন স্বাধীন সত্ত্বার তাড়নায় বিভিন্নভাবে যুক্ত হবে, প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করবে, প্রচলতি রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন চাইবে, রাষ্ট্র তখন সেই স্বাধীন সত্ত্বাকে বিকশিত হতে দেবে, বিকাশ ঘটতে দেবে, স্বাধীন সত্ত্বার প্রকাশ ঘটতে দেবে।

নাগরিক স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার; Image Source: University of Utah

মানুষের স্বাধীন সত্ত্বার প্রতি স্বীকৃতি দেওয়ার ধারণা এসেছে থমাস হবসের দর্শন থেকে। থমাস হবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ লেভিয়েথানে বলছেন, মানুষ স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে এবং মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে কিছু প্রাকৃতিক অধিকার অর্জন করে। প্রকৃতির রাজ্যের যে অনাচার এবং বিশৃঙ্খলা মানুষের সেকল জন্মগত প্রাকৃতিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করছিল, ক্ষমতাবান মানুষ হরণ করছিল দুর্বলের অধিকার, ক্ষেত্রবিশেষে বানিয়ে রাখছিল দাস। হবসের দর্শনানুযায়ী, মানুষের এসব জন্মগত অধিকার এবং স্বাধীন সত্ত্বাকে সুরক্ষা দিতেই রাষ্ট্র তৈরি হয়। রাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষ গড়ে তোলা হয়, যাতে শক্তিশালী কেউ দুর্বলের অধিকার হরণ করতে না পারে।

নাগরিক স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জনতুষ্টিবাদী আর কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা বিভিন্নভাবে নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করছেন। এটি নেতিবাচক ধারা তৈরি করছে। মানুষের জন্য চিরকল্যাণকর নাগরিক স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে তাই রাজনৈতিক ত্যাগের প্রয়োজন হবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই।

This article is written in Bangla about civil liberties. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: The New Yorker

Related Articles

Exit mobile version