Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্বৈরতন্ত্রের পতন কেন হয়, কীভাবে হয়?

এরিস্টটল প্রণীত শাসনব্যবস্থার ছয়টি রূপের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ স্বৈরতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র আর গণতন্ত্রের খারাপ দিকগুলোর সমন্বয় দেখা যায় রাজতন্ত্রের এই বিচ্যুত রূপে। নগর রাষ্ট্রের যুগে স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বিদ্রোহ করে কিংবা রাজাকে সরিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে। এই ধারা বজায় ছিল সাম্রাজ্যবাদের যুগেও। জাতিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের যুগে এসে বদলেছে স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় আসার ধরন। গত শতাব্দীতে স্বৈরশাসকদের একটা বড় অংশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসে স্বৈরশাসক হয়েছেন, অনেকে স্বৈরশাসক হয়েছেন গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসে। ক্ষমতার নেশায় বিপ্লবীরা স্বৈরশাসক হয়েছেন, স্বৈরশাসক হয়েছেন একসময়ের অনেক গণতন্ত্রপন্থী নেতারাও ।  জনগণকে নিপীড়ন করে, মত প্রকাশের সু্যোগকে সংকুচিত করে, বিরোধীদের নির্মূল করে, কখনো জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে টিকে থেকেছে স্বৈরশাসকেরা।

তবুও একটা সময় এসে পতন হয়েছে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা স্বৈরশাসকদের। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার আর সামাজিক ন্যায্যতার দাবিতে জনগণ মুক্তি খুঁজেছে স্বৈরশাসকদের কবল থেকে।

শাসিতের জন্য সবচেয়ে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা  

স্বৈরতন্ত্রে সমন্বয় ঘটে অভিজাততন্ত্রের বিচ্যুত রূপ কতিপয়তন্ত্রের খারাপ দিকগুলোর, যুক্ত হয় পলিটির বিচ্যুত রূপ গণতন্ত্রের খারাপ দিকগুলোরও। কতিপয়তন্ত্রের চরম লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয় অর্থকে, গণতন্ত্রে সম্মিলন ঘটে অর্থপিপাসু কিছু মানুষের। ফলে স্বৈরতন্ত্রে শাসক বা শাসকের আশেপাশের মানুষের লক্ষ্য জনগণের উন্নয়ন থাকে না, লক্ষ্য থাকে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ অর্থ সংগ্রহ করা, মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা আর বিপুল অর্থের সঞ্চয় নিজেদের কাছে রাখা।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই , এই লক্ষ্য পূরণের জন্য জনগণের শোষক হয়ে উঠে স্বৈরশাসকেরা, জনগণের জানমালের রক্ষকের জায়গায় হয়ে উঠে ভক্ষক। ফলে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্বৈরশাসকেরা, তৈরি হয় পতনের ক্ষেত্র

স্বৈরশাসকদের নিপীড়নের অস্ত্র হয়ে উঠে সামরিক বাহিনী; Image Source: The Conservative

ভয় সৃষ্টি

স্বৈরশাসকেরা টিকে থাকার জন্য জনগণের সামনে বিভিন্নভাবে নিজেকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করেন, আবার প্রয়োজনে জনগণের মনে তৈরি করেন ভয়। এই ভয় স্বৈরশাসকেরা যেমন নিচুস্তরে তৈরি করেন, তৈরি করেন শাসন কাঠামোর বাকি সকল স্তরেও। চূড়ান্ত পর্যায়ে এই ভয়ই ক্ষমতার ভিত্তি হয় স্বৈরশাসকের, রক্ষা করে জন অসন্তোষ আর জনরোষের প্রকাশ থেকে।

কিন্তু স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় যখন কেউ চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে, জনগণ আসলে তখন সেই চ্যালেঞ্জকারীকেও ভয় পায়। ফলে জনগণ যদি জানেও চ্যালেঞ্জকারী তাদের জন্য আরো খারাপ শাসক হবে, ভয় থেকেই জনগণ তখন বর্তমান শাসককে রক্ষা করতে যায় না। ক্ষমতার স্তম্ভ হওয়া ভয় পতনেরও কারণ হয় স্বৈরশাসকদের।

স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হয় একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি; Image Source: GFiles

দুর্নীতি

স্বৈরশাসনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক জবাবদিহিতা থাকে না, আমলাতন্ত্রের মোরালিটি ভেঙে যায়, কমে যায় রাষ্ট্রের সামর্থ্য। ফলে সর্বস্তরের দুর্নীতি সর্বদা আষ্টেপৃষ্টে থাকে স্বৈরশাসনের সময়টা। স্বৈরশাসক চাইলেও এই দুর্নীতি দূর করতে পারে না, মেনে নিতে হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। অনেক সময় আবার স্বৈরশাসকেরাই জড়িয়ে পড়েন এই বিশাল লুটপাটের মধ্যে। ফলে একটা সময় দারিদ্রতার ফাঁদে আটকে পড়ে দেশের সিংহভাহ জনগণ, অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে শাসক আর শাসকের আশেপাশে থাকা লোকজনের মধ্যে। এই তীব্র বঞ্চনা আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা জনগণকে পরিবর্তনের প্রত্যাশী করে তোলে, উদ্বুদ্ব করে স্বৈরশাসকের পতনে।

পরাশক্তিগুলোর সাথে সংঘাত 

স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসে জনগণকে কখনোই বিশ্বাস করেন না, ক্ষমতায়ন ঘটান না অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর। ফলে, সবসময় আস্থার একটা সংকট শাসকশ্রেণির সাথে শোষিতের চলতেই থাকে।

তবুও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাঝে মাঝে কিছু জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নিতে হয় স্বৈরশাসকদের, জনগণকে দিতে হয় কিছু সুযোগ সুবিধা। আবার অনেক সময় আদর্শগত জায়গা থেকেও স্বৈরশাসকেরা জনগণকে তৈরি করে দেন সুযোগ সুবিধা। মাঝে মাঝেই এই বিনামূল্যে খাদ্য, স্বাস্থ্য বা ভূমি সংস্কারের উদ্যোগগুলো চোখ রাঙানোর মুখে পড়েছে পরাশক্তিগুলোর। ফলে জনগণ আর পরাশক্তির মাঝখানে পড়ে অনেক সময়ই পতন হয় স্বৈরশাসকদের।

জিম্বাবুয়েতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন রবার্ট মুগাবে, প্রতিশ্রুতি ছিল ভূমি সংস্কারের। আস্তে আস্তে তিনি স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করেছিলেন ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শ্বেতদের ভূমিচ্যুত করায় পড়েন পশ্চিমা রোষানলে, মিডিয়ার প্রচারে আবির্ভূত হন খলনায়ক হিসেবে, ধ্বস নামে জনপ্রিয়তায়। একইভাবে পতন হয়েছে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের, জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর। 

বিশ্বজুড়ে স্বৈরতন্ত্রের ধারকেরা; Image Source: Institution of Modern Russia

পরাশক্তিগুলো দ্বারা প্রভাবিত হওয়া  

বিশ্বায়নের এই যুগে শক্তিশালী হয়েছে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক ক্ষমতা, বেড়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। ফলে তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশেই স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের মেনে নিতে হয় পরাশক্তিগুলোর প্রভাব, দেশকে বানিয়ে ফেলেন স্যাটেলাইট স্টেইট বা তাবেদার রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, একটা সময় জনগণ বুঝতে পারে, রাষ্ট্র আসলে তাদের কল্যাণে কাজ করছে না, কাঠামোর কারণে তারা শুধু শোষিতই হচ্ছেন। ফলে একটা সময় জনগণ বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মাধ্যমে ইতি টানে স্বৈরশাসনের। ইরানের মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে বিপ্লব হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল শাহের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, পরিকল্পনা গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আর তেল বাণিজ্য নিয়ে দহরম মহরম।

নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা  

আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার বৈধতা আসে নির্বাচনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন একদলীয় স্বৈরশাসনে থাকা উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনে একজনই প্রার্থী থাকে নির্বাচনে, জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দিতে হয় সেই প্রার্থীকেই। এভাবেই তিন পুরুষ ধরে উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় রয়েছে উন পরিবার, চরম দারিদ্রতা আর তীব্র খাদ্যসঙ্কটের মধ্যেও মেনে নিচ্ছে স্বৈরশাসন।

কিন্তু সকল স্বৈরশাসকের জন্য পরিস্থিতি সবসময় এতোটা সুখকর হয় না। ২০০৬ সালে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে গিয়ে জনগণের কাছে বৈধতা হারিয়েছিলেন রবার্ট মুগাবে, গত বছর ক্ষমতা হারিয়েছেন সুদানের ওমর আল বশির।

শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল 

স্বৈরশাসকের শাসন টিকিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে থাকে তার চারপাশে থাকা কতিপয় অভিজাতেরা। শাসকের আশেপাশে জড়ো হয় নিজের স্বার্থের তাগিদে। একটা সময় এই অনুসারীদের মধ্যে স্বার্থ আর সুবিধার জন্য বিভাজন তৈরি হয়, জন্ম নেয় সংঘাতের। ফলে শাসকের অনুসারী হিসেবে থাকা এই স্বার্থগোষ্ঠীগুলো স্বৈরশাসকের কাছে আবির্ভূত হয় চাপ হিসেবে, ধীরে ধীরে নিয়ে যায় পতনের দিকে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের অভাব

স্বৈরশাসকেরা সাধারণত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা ছাড়ে না, আকঁড়ে ধরে থাকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে শাসকের দক্ষতা। আবেদন হারায় বয়সের কারণে। একটা সময় স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর কাছেও বন্দি হয়ে যান স্বৈরশাসক, নিজের অনুসারীদের যোগান দিতে হয় সীমাহীন সম্পদের যোগান। ফলে জনগণের বিশাল অংশ বঞ্চিত হয় সামাজিক ন্যায্যতা থেকে, বাধাগ্রস্ত হয় তাদের অর্থনৈতিক অধিকার। তৈরি হয় পতনের স্ফুলিঙ্গ।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের দাবিতে আরব বসন্ত; Image Source: Al Jazerra 

পাল্টা অভ্যুত্থান 

নগর রাষ্টের সময় থেকেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা স্বৈরশাসকদের একটি বৈশিষ্ট্য। আবার যেসব দেশ দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে ছিল, সেসব দেশে সম্ভাবনা থাকে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের। আধুনিককালে সেনাবাহিনীর অভ্যুথানের ধরন পাল্টেছে, যেমনটা দেখা গেছে আলজেরিয়ায়, সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ক্ষমতাচ্যুতি ঘটিয়েছে দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্টের।

দীর্ঘ শাসনের ফলে একটা সময় স্বৈরশাসকের কবল থেকে জনগণ মুক্তি খুঁজে, শাসকের দক্ষতার হ্রাস একটা সময় পতন ঘটায় স্বৈরশাসকের। কিন্তু যে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণ স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়, অধিকাংশ সময়ই তা থেকে যায় অপূর্ণ। অন্তহীন শোষণের চক্রে ঘুরপাক খায় শোষিতের জীবন।

This article is written in Bangla about the fall of autocratic regimes. All the necessary links are hyperlinked inside.  

Feature Image: DW

Related Articles