Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আজকের ‘পোস্ট ট্রুথ’ দুনিয়ায় কতটা কার্যকরী মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি?

দু’হাজার সতেরো সালে ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সত্তর বছর পূর্ণ হয় এবং যদি এই সাত দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের কথা বলতে হয়, তবে তা অবশ্যই জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর অনুপস্থিতি।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের মধ্যরাত্রে তার অবিস্মরণীয় ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ ভাষণে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মহাত্মার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, উনি ভারতের সনাতন আত্মার প্রতিনিধি যার মন্ত্র মনে রাখবে আগামীদিনের প্রজন্ম। নেহরুর ভাষণের ঠিক পাঁচ মাস পরে- ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি- এক উগ্র হিন্দুবাদীর হাতেই এই মহান আত্মার মৃত্যু ঘটে। যে দেশের প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি সবচেয়ে বেশি শ্রমদান করেছিলেন, সেই দেশের রাজধানীতেই তার দুর্ভাগ্যজনক অন্তিম পরিণতি ঘটে।

ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী; Image Source: Famous Biographies

আজকে যখন চলছে ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর রমরমা, তখন ফের সেই প্রশ্নটাই করতে ইচ্ছে করে: মহাত্মার সেই সনাতন আত্মা কি আজ একটুও বেঁচে রয়েছে?

মহাত্মা গান্ধী দুটি নীতি দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন- ‘অহিংসা’ এবং ‘সত্য’- এবং এই দুটি নীতিকে তিনি এক পরিপূর্ণ অর্থ দিয়েছিলেন এবং জাতীয়তাবাদের হেতু ব্যবহার করেছিলেন। পরে মহাত্মার উপরে তৈরি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র ‘গান্ধী’-র বিভিন্ন পোস্টারেও বলা হয় যে যে তার সাফল্য পৃথিবীতে এক চিরকালীন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আমি কিন্তু এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নই।

একথা অনস্বীকার্য যে, মহাত্মা গান্ধী বিশ্বের প্রথম অহিংস স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের এক অনন্য নেতা ছিলেন। একই সঙ্গে, নিজের নানা বিশ্বাস ও ধারণাকে বাস্তব জীবনে সফল করার চেষ্টায় রত এক দার্শনিকও ছিলেন গান্ধীজি। তা ব্যক্তিগত উন্নয়নার্থে হোক বা সামাজিক বদলের উদ্দেশ্যে, মহাত্মার এই নিরন্তর প্রয়াসে কোনোদিন কোনো ক্লান্তি ছিল না। আর সেজন্যই হয়তো তার আত্মজীবনীর নাম ‘দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’।

পৃথিবীতে এমন কোনো অভিধান নেই যা ‘সত্য’-র অর্থকে মহাত্মার মতো গভীরে গিয়ে অনুধাবন করেছে। গান্ধীর কাছে সত্যের ভিত ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস। সেই সত্য যে শুধু নিখুঁত তা-ই নয়, পাশাপাশি ন্যায্য এবং ঠিক। সত্যের কাছে পৌঁছতে হলে অসত্য এবং অন্যায়ের আশ্রয় নিলে (যার মধ্যে পড়ে অপরপক্ষের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অবস্থান নেওয়াও) কোনোদিনই সেই লক্ষ্যে সফল হওয়া যাবে না।

মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী; Image Source: Amazon.in

নিজের সত্য অনুধাবনের পথকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গান্ধী ‘সত্যাগ্রহ’ কথাটির সূচনা করেন। ‘সত্যাগ্রহ’-এর অর্থ, সোজাসুজি বললে ‘সত্যের সঙ্গ দেওয়া’ অথবা, মহাত্মা নিজে যেভাবে তার বিবরণ দিয়েছেন- সত্যের শক্তি, প্রেমের শক্তি এবং আত্মার শক্তি।

মহাত্মা সত্যাগ্রহকে বর্ণনা করতে ইংরেজি ‘প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স’ কথাটির প্রয়োগ পছন্দ করতেন না। কারণ তার মতে, সত্যাগ্রহের মধ্যে ‘প্যাসিভ’ বা নিষ্ক্রিয়তা নয়, রয়েছে সক্রিয়তার প্রয়োজন। দেশের জনক মনে করতেন, যদি কেউ সত্যের প্রতি আস্থাশীল এবং যত্নবান হয়, তাহলে সে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না কখনোই। সত্যের পক্ষে লড়তে তাকে সক্রিয়ভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে, নচেৎ নয়।

গান্ধীর অহিংসা তাই অসহযোগ বা ‘অ’জোট বা নির্জোট-এর মতো শুধুমাত্র একটি বিরোধী ধারণাতেই নিবদ্ধ নয়- অর্থাৎ সহযোগের বিরুদ্ধে অসহযোগ বা জোটের বিরুদ্ধে নির্জোট-এর মতো অহিংসা অর্থ হিংসার বিরুদ্ধতার মধ্যেই থেমে থাকে না। অহিংসার অর্থ একপ্রকার সত্যের প্রতিষ্ঠা করা- বিরোধীকে বেদনা দিয়ে নয়, নিজেকে কষ্ট দিয়ে। গান্ধীর দর্শন বলে নিজের বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ়তা দেখানোর হেতু যদি স্বেচ্ছায় শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়, তবে তা করতেও পিছপা হওয়া অনুচিত।

তার এই চিন্তাকেই মহাত্মা গান্ধী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজে লাগিয়েছিলেন, এবং সুফলও পেয়েছিলেন। যেখানে উগ্রপন্থা বা নিয়মতন্ত্র দেশের স্বাধীনতা আনতে সফল হয়নি, সেখানে গান্ধী এক অন্য উপায় বের করেন। সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছে যান স্বাধীনতার ন্যায্যতার প্রশ্ন নিয়ে এবং তার এই লড়াইয়ের কোনো জবাব ব্রিটিশের কাছে ছিল না। অহিংসার আশ্রয় নিয়ে, তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া শাস্তি মেনে নিয়ে, অনশন ধর্মঘট ইত্যাদি করে গান্ধী তার বিরোধীদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিজের নীতি-বিশ্বাসের পাশে থাকতে তিনি যেকোনো দূরত্বে যেতে রাজি ছিলেন। তার এই দৃঢ় সংকল্পের সামনে প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশও শেষপর্যন্ত থমকে দাঁড়ায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একবার গান্ধীর উপরে একটি বক্তৃতায় যোগদান করেন; তার উপরে আধডজন বইও কেনেন এবং সত্যাগ্রহকে নীতি এবং প্রণালী- দুই হিসেবেই গ্রহণ করেন। ভারতের বাইরে যদি কেউ অহিংসাকে স্বার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে থাকেন, তবে তা এই কৃষ্ণাঙ্গ নেতা।

লুথার ঘোষণা করেন, “ঘৃণা জন্ম দেয় ঘৃণাকে। হিংসা জন্ম দেয় হিংসাকেই। আমাদের ঘৃণার জবাব দিতে হবে আত্মার শক্তি দিয়ে”। 

তিনি এও বলেন যে, তাদের যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, তার অনুপ্রেরণা হিসেবেও তারা দেখেন গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধকেই। ২০১১ সালে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারতের সংসদে তার বক্তব্য রাখতে গিয়েও বলেন যে, যদি এই পৃথিবীতে গান্ধীজির মতো মানুষের আগমন না ঘটত, তাহলে তার মতো মানুষের রাষ্ট্রপতি হওয়ার খোয়াব চিরকাল খোয়াবই থেকে যেত।

মার্টিন লুথার কিং; Image Source: Medium

সুতরাং, গান্ধীর মতবাদ যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশকেও প্রভাবিত করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গান্ধীবাদের সাফল্যের খুব বেশি নিদর্শন আজকাল দেখা যায় না। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় উত্তর-উপনিবেশ যুগ। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশই আছে, যাদের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে ছিল হিংসাত্মক সংগ্রাম। বহু ক্ষেত্রে মানুষ পিষ্ট হয়েছে সামরিক শক্তির পায়ের তলায়; ঘরদোর হারিয়ে তাদের দেশ থেকে পলায়ন করতে হয়েছে; অহিংসার নীতি তাদের কোনো সাহায্যেই আসেনি। আসলে অহিংসার নীতি তাদের বিরুদ্ধেই সফল হয় যাদের মনে নৈতিক পরাজয়ের ভীতি রয়েছে; যাদের ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু গান্ধীর জীবদ্দশাতেও তার অহিংসার নীতি হিটলারের জার্মানির নির্মম দমন-পীড়নের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে সফল হতো না; হয়ও নি।

গান্ধীর অহিংসার মৌলিক চিন্তা হচ্ছে: “তুমি যে ভুল, সেটা প্রমাণিত করতে আমি নিজেকে শাস্তি দিতেও রাজি।” কিন্তু, ঘটনা হচ্ছে, যদি সেই বিরোধী তাদের ভুল বুঝতে বিন্দুমাত্রও আগ্রহী নয় এবং উল্টো চায় তাদের সঙ্গে অসম্মতি দেখানো বিরোধীদের শাস্তি দিতে, তাদের উপরে অহিংসবাদী আন্দোলনের কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। যদি কেউ তাদের ভুল প্রমাণ করার জন্যে নিজে কষ্ট সহ্য করতে রাজি থাকে, তবে তা তাদের কাছে জয়েরই সমান।

তাই যখন নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্ববরেণ্য নেতা একদিকে আমাকে বলেছিলেন যে গান্ধী চিরকালই এক বড় অনুপ্রেরণা কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইতে অহিংসাকে অস্ত্র করতে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন, আমি আশ্চর্য হইনি।

Image Source: History Channel

একথা আজ দুঃখের হলেও সত্যি যে, সংগঠিত হিংসার কার্যকারিতা আজ অহিংসার চেয়ে বেশি। গান্ধীজির প্রয়াণের পর যুদ্ধ এবং সংঘর্ষে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বিশ্বের একাধিক দেশে (যার মধ্যে গান্ধীর নিজের ভালোবাসার ভারতও রয়েছে) আজ সরকার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে সামরিক খাতে। বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি আজ যে হারে পরমাণু অস্ত্র মজুদ করেছে তার ক্ষমতার কাছে গান্ধীর জীবৎকালে হিরোশিমায় বিস্ফোরিত অ্যাটম বোমাটি নেহাতই শিশু। অথচ হিরোশিমায় ঘটে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর মানবনিধন কাণ্ড গান্ধীজিকে চূড়ান্ত আহত করেছিল। ২৬/১১-তে মুম্বাইতে সন্ত্রাসবাদী হামলার মতো সীমান্ত-লঙ্ঘনকারী সন্ত্রাসের জবাবে যদি আজ মহাত্মার মতো অনশন প্রতিবাদ করা হতো, তাতে অপরাধীদের মনে বিন্দুমাত্রও নৈতিক সংকটের উন্মেষ ঘটতো না।

নৈতিকতাকে বাদ দিলে গান্ধীবাদের আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। মার্ক্সবাদে যেমন প্রলেতারিয়েতের গুরুত্ব, তেমনই গান্ধীবাদে নৈতিকতার। কিন্তু গান্ধীর পথে চলার প্রতিশ্রুতি যারা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে তার রাজনৈতিক প্রণালীর যথার্থতা কিন্তু খুব কমই দেখা গিয়েছে। জবরদস্তি হরতাল, লোকদেখানো অনশন ধর্মঘট বা ‘রিলে ফাস্ট’ বা পালাবদলের অনশন বা ধর্না- এসবের বাড়াবাড়ি দেখলে বোঝা যায় যে, আজ আমরা গান্ধীজির সত্যের ধারণার থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছি।

মহাত্মা গান্ধী দুটি নীতি দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন- ‘অহিংসা’ এবং ‘সত্য’; Image Source:  Wikimedia Commons

তবে এই সমস্ত ভড়ংবাজির জন্যে গান্ধীর মাহাত্ম্য খর্ব হয়েছে তা বলা চলে না। তার জীবনের স্বার্থকতা; তার বার্তার মৌলিকতা আজও প্রাসঙ্গিক। যেই সময়ে পৃথিবী জুড়ে ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদ, হিংসা এবং যুদ্ধের ভয়াল ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে, তখন গান্ধী আমাদের শিখিয়েছিলেন সত্য, অহিংসা এবং শান্তির মতো জগৎজয়ী ধারণাগুলোর গুরুত্ব। উপনিবেশবাদ এবং তার প্রধান চালিকাশক্তি বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে তিনি সফলভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তার দৃঢ়তা এবং সাহসের সাথে পা মিলিয়ে চলেছে এমন মানুষের দেখা খুব বেশি মেলে না। গান্ধীজি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি কোনোদিন ক্ষুদ্র সমর্থন ছুঁতে পারেননি।

গান্ধীর সত্য ছিল তার নিজস্ব। তিনি তার রচনা এবং প্রয়োগ করেছিলেন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। আজকের দিনে গান্ধীর মাহাত্ম্য বোঝার মতো মানুষ খুব কমই রয়েছে। যদিও গান্ধীর চিন্তার মৌলিকতা এবং তার জীবন কাহিনী পৃথিবী শুদ্ধ মানুষকে আজও উদ্দীপ্ত করে, কিন্তু তার জয় দুনিয়াকে বরাবরের জন্যে বদলে দিয়েছে, সেকথা বোধহয় বলা যাবে না। আজকের যেই ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বিশ্বে আমার বাস করি, তাতে নিজের সাফল্য নিয়ে স্বয়ং মহাত্মাও কতটা নিশ্চিত থাকতেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

Featured Image Source: History and Art Collection / Alamy Stock Photo

শশী থারুর ভারতের একজন সংসদ সদস্য, এই লেখাটি তার ব্যক্তিগত মতামত।

Related Articles