বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত। পর্দা উঠেছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের, এরই মধ্যে কয়েকধাপ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নানা কারণে ভারতের এবারের নির্বাচনটি খোদ ভারতসহ সারা বিশ্বেই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, একে অপরের সমালোচনা, ব্যক্তিগত আক্রমণ আর ধর্মীয় বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এবারের নির্বাচন। শাসকদলের তরফ থেকে যেখানে জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ববাদ আর জাতীয় নিরাপত্তাকে মুখ্য ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেখানে বিরোধী দলগুলো ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, বহুত্ববাদ আর সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি অটুট রাখতে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইস্যুতে ভোট চাইছেন।
১৭তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে ১১ এপ্রিল, চললো ১৯ মে পর্যন্ত। মোট সাতটি ধাপে সম্পন্ন হবে ৫৪৩ আসনের লোকসভা নির্বাচনের এই মহোৎসব। ২৩শে মে ভোট গণনা করে ঐদিনই ফলাফল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। এবারে প্রায় ৯০ কোটি ভারতীয় নাগরিক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। লোকসভার পাশাপাশি অন্ধ্র প্রদেশ, অরুনাচল প্রদেশ, ওড়িশা এবং সিকিমের বিধান সভা নির্বাচনও একইসাথে সম্পন্ন হবে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন বিভিন্ন কারণে আলোচিত হলেও প্রচারাভিযানে ব্যবহৃত ‘ভাষা’ এবারের নির্বাচনকে বৈচিত্রময় করে তুলেছে। ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে এরকম নজির আর নেই। নির্বাচনী প্রচারে নেতারা এবার ব্যক্তিগত আক্রমণে শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ করছেন, যা ভারতীয় রাজনীতির মানের অবনতির প্রকাশ বলে ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)’র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারাভিযানের প্রধান হাতিয়ার জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ববাদ এবং জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু। সাম্প্রতিককালে পুলওয়ামায় ঘটে যাওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানদের উপর হামলার ঘটনা এবং এর প্রতিশোধ নিতে পাকিস্থানের অভ্যন্তরে বালাকোটে চালানো এয়ার স্ট্রাইকের মতো ঘটনাও বিজেপির পক্ষে প্রচারের ইস্যু হয়ে উঠেছে, যদিও বিরোধীদের দাবী, বিজেপি দেশের নিরাপত্তা এবং সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করছে। অপরদিকে বিজেপির দাবী, এযাবৎকালের কোনো সরকারই দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় এমন সাহস দেখাতে পারেনি।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি এবার সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন পাবে না। তাই কংগ্রেস ছাড়া অনেকগুলো ছোট ছোট আঞ্চলিক দল মিলে তৈরি হয়েছে তৃতীয় একটি জোট, বিরোধীদের এই জোটের নাম মহা গাঁটবন্ধন। এই জোটের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস এবং বিজেপি। সুতরাং ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বহুমুখী সমীকরণের জটিল এক খেলা চলছে।
এদিকে ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এবার প্রথমবারের মতো রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে। তিনি অভিযোগ করছেন, বিজেপি ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর আঘাত হানছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মোদী ওয়াদা করেছিলেন, বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত এনে সব নাগরিকের ব্যাংক হিসেবে পনের লক্ষ করে রুপি পৌঁছে দেবেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে, এবং দেশে সুদিন আসবে।
রাহুলের অভিযোগ, এসবের কিছুই মোদী করতে পারেননি। উল্টো বিজেপির গত পাঁচ বছরের শাসনামলে বেকারত্ব দেশের গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। তিনি আরও বলছেন, মোদী সেনাবাহিনীর শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। মোদী নিজেকে দেশের এবং জনগণের নিরাপত্তার চৌকিদার দাবী করায় কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচার সভাগুলোতে ‘চৌকিদার চোর হে’ অর্থাৎ ‘চৌকিদারই চোর’ স্লোগান তুলছে। এর জবাবে মোদী রাহুলকে ৫০ বছরের বালক বলে বিদ্রুপ করে বলছেন, কংগ্রেস দেশকে দুর্নীতি আর পরিবারতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। এমনকি বিজেপি এবং মোদী প্রয়াত রাজিব গান্ধীকেও রেহাই দেননি। রাজিব দুর্নীতিগ্রস্থ হিসাবে মারা গেছেন বলে তার ভাষণে উল্লেখ করছেন মোদী।
কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে ভাই রাহুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। এবারই প্রথম প্রিয়াঙ্কা সরাসরি রাজনীতিতে নেমেছেন। তাকে উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব দিয়ে দলের মহাসচিব পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। ভারতের জনগণের কাছে প্রিয়াঙ্কা অনেকটাই তার দাদী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া হয়ে উঠেছেন। তিনিও ভাইয়ের মতোই মোদীর দিকে আক্রমনের তীর নিক্ষেপ করে চলেছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চালানো বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্যের জেরে পাঞ্জাবের ভাটিন্ডায় একটি র্যালিতে অংশ নিয়ে প্রিয়াঙ্কা মোদীকে এক হাত নিয়েছেন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, মোদীর আসল চেহারা এখন ‘জনগণের রাডারে’ ধরা পড়ে গেছে। উল্লেখ্য, ওই এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে মোদী এক ইন্টারভিউতে বলেন, আকাশে ঘন মেঘের কারণে ভারতীয় বিমান বাহিনী ওই অভিযান পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তার একক সিদ্ধান্তে অভিযানটি নির্দিষ্ট সময়েই চালানো হয়। তার যুক্তিতে মেঘের কারণে ভারতীয় বিমানগুলো পাকিস্তানী রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে পেরেছে, যদিও এর কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। এই নিয়ে বিরোধীরা একজোট হয়ে মোদীর সমালোচনায় মেতেছেন, করছেন বিদ্রুপ। এছাড়াও দেশজুড়ে গত পাঁচ বছরে যে ১২ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেন তার দায়ও প্রিয়াঙ্কা নরেন্দ্র মোদীর ঘাড়েই চাপান ভাটিন্ডার ওই নির্বাচনী সভামঞ্চ থেকে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীর সমালোচনায় সবচেয়ে এগিয়ে। মমতা তার কোনো নির্বাচনী সভাই বাদ দিচ্ছেন না মোদীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাতে। বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২৩টি পাবে বলে দাবী করছে। এতেই চটেছেন দিদি। মোদীও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারণায় এসে দিদির বিরুদ্ধে তুলেছেন দুর্নীতির অভিযোগ, বলছেন, মমতা ও তার দল মুসলিম তুষ্টির রাজনীতি করছেন। এর জবাবে মমতা বলছেন, মোদীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা শরীরে দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে। কংগ্রেসের মতো তিনি মোদীকে চোর না বলে বলছেন ‘চৌকিদার ঝুটা হে’ অর্থাৎ চৌকিদার মিথ্যেবাদী।
কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে ঘুর্ণিঝড় ‘ফণী’ আঘাত হানলে মোদী খোঁজখবর নিতে দিদিকে ফোন দিয়েছিলেন, কিন্তু মমতা ব্যানার্জী তার ফোন ধরেননি। মমতা সুর কয়েকধাপ চড়িয়ে বলছেন, তিনি এখন আর মোদীকে প্রধানমন্ত্রী মানেন না, নির্বাচন পরে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রীই হবেন তার প্রধানমন্ত্রী এবং অবশ্যই তিনি মোদী নন। পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যেক ধাপের নির্বাচনেই সহিংসতা হয়েছে, যার দায় বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের উপর চাপিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। মমতা এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতাকালে এটাও বলেন, নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন তৃণমূল কংগ্রেস ‘তোলাবাজ দল’ তখন তার নাকি ইচ্ছে হয় কষিয়ে মোদীকে গণতন্ত্রের থাপ্পড় দিতে।
উত্তর প্রদেশেও মোদী ভার্সেস মায়াবতী কথার লড়াই চলছে। সেখানকার এক দলিত নারী গণধর্ষণের শিকার হয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। আর একেই বিজেপি ইস্যু বানিয়ে মায়াবতীর বিরুদ্ধে প্রচারে ব্যবহার করছে। মোদী বলেন, মায়াবতী দলিতদের কথা বলেন অথচ দলিত নারীর উপর অত্যাচারের ঘটনায় তিনি নীরব কেন? তাহলে কি শুধু ভোটের জন্যই তিনি দলিতদের নিয়ে রাজনীতি করেন? এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে মায়াবতী জবাব দেন ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে। এক প্রেস রিলিজে মোদীকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যিনি নিজের স্ত্রীকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ত্যাগ করেন তিনি কীভাবে অন্য নারীদের সম্মান দেবেন?
ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে এভাবেই ব্যক্তিগত আক্রমণ, একে অন্যের চরিত্রহনন এবং ধর্মীয় ও জাতপাতের বিভাজনকে সামনে এনে নেতারা নির্বাচনে একে অন্যকে হারানোর কঠিন ছক আঁটছেন। নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে ভাষার এত অবনমন ভারতের ইতিহাসে বিরল। নজিরবিহীনভাবে প্রয়াত নেতারাও এসব অপমানজনক বাক্যবাণ থেকে বাদ পড়ছেন না। তবে আগামী দিনে জনতাই ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে তারা কার কথা বিশ্বাস করেছে আর কাকে যোগ্য মনে করেছে।
This is a Bangla article on 'Indian General Election 2019'. The 2019 Indian general election is currently being held in seven phases from 11 April to 19 May 2019 to constitute the 17th Lok Sabha. The counting of votes will be conducted on 23 May, and on the same day the results will be declared.
References:
1. Rahul Gandhi Says "Chowkidar Chor Hai" Not Coined By Him Or Congress - NDTV - May 08, 2019
2. Priyanka taunts Modi over cloud cover remark - Deccan Herald - May 14, 2019
3. Mamata Banerjee: Want to give PM Modi a tight slap of democracy - The Indian Express - May 07, 2019
4. Mayawati accuses Modi of ‘abandoning’ wife for 'political selfishness' - Omar Rashid - The Hindu - May 13, 2019
Feature Image: © A. Savin (Wikimedia Commons)