কানহাইয়া কুমার- নামটি আমাদের কাছে হয়তো এখনো ততটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বয়স মাত্র ৩০ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এখনই ভারতের সব রাজনীতিবিদের হিসেবের বিষয় হয়ে উঠেছেন। আসামের ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা কানহাইয়া এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ছেন, নিয়মিতই মারমুখী কথা চালাচ্ছেন বিজেপি সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আনন্দবাজারের এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে ভারতের তরুণ সমাজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা কানহাইয়া। অথচ বছর দুয়েক আগেও তাকে কেউ চিনতো না। তাহলে কীভাবে রূপকথার চেয়েও অবাস্তব গল্প আজকের এই রাজনীতির ময়দানের তুরুপের তাসে পরিণত হলেন ছোট একটি গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন কৃষকের ছেলে?
কানহাইয়া ১৯৮৭ সালে বিহারের বেগুসরাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা একজন কৃষক এবং পারিবারিকভাবেই তারা ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর সমর্থক। ছোটবেলা থেকেই কানহাইয়া ছিলেন মেধাবী ছাত্র। হাই স্কুল পাস করার পর তিনি পাটনার একটি কলেজ থেকে ভূগোলে অনার্স করেন। পরে নালন্দা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। এরপর দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) থেকে আফ্রিকান স্টাডিজের উপর পিএইচডি করে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এই জেএনইউ এর সময়টাই মূলত কানহাইয়ার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালে বিজেপি সমর্থিত স্টুডেন্ট উইং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এভিবিপি)-কে হারিয়ে জেএনইউ এর স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
জেএনইউর মধ্যে কানহাইয়ার ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। একজন ভাল ছাত্র, সুবক্তা এবং ছাত্রবান্ধব মাটির মানুষ হিসেবে কানহাইয়া সাধারণ ছাত্রদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু লাইমলাইটে তিনি চলে আসেন যখন তাকে উস্কানিমূলক কথা বলার অভিযোগে “দেশদ্রোহিতার” আইনে গ্রেফতার করা হয়। মূলত সেদিন ছিল ভারতের ২০০১ সালে পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে বোমা হামলায় ফাঁসির আদেশে মৃত্যুবরণ করা আফজাল গুরুর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। উল্লেখ্য, আফজাল গুরু ছিলেন একজন কাশ্মিরী বিচ্ছিন্নতাবাদী, যাকে কাশ্মিরীরা বীর হিসেবে বিবেচনা করেন।
তার ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে খোদ ভারতের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং আইন বিভাগ দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। অনেকে বলে থাকেন, আমজনতাকে ঠাণ্ডা করার জন্য অনেকটা স্কেপগোট হিসেবে তাকে বলি দেয়া হয়েছে। আর আইনের ভাষায় বলতে গেলে, আজ পর্যন্ত আফজাল গুরুর সাথে ঐ হামলার সরাসরি কী যোগাযোগ ছিল সেটা প্রকাশ করা হয়নি। কারণ হামলার সময়েই হামলাকারী পাঁচজনকে পুলিশ ঘটনাস্থলেই মেরে ফেলে। আফজাল গুরুকে মূলত পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকেই প্রধান আসামী করে ফাঁসি দেয়া হয়। যে কারণে ভারতের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে কাশ্মিরীরা মনে করে এই রায়ের মাধ্যমে আবার সরকার প্রমাণ করেছে যে, আসলে কাশ্মিরীদেরকে ভারতের জনগণ হিসেবে মনে করা হয় না।
জেএনইউ এর শিক্ষার্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এদিন স্মরণসভা আয়োজন করা হয়, যেখানে কানহাইয়া এবং উপস্থিত সবাই আফজাল গুরুর পক্ষে স্লোগান দেন। একজন সন্ত্রাসীর পক্ষে স্লোগান দেয়ার কারণে দেশদ্রোহিতার মামলায় কানহাইয়াকে জেলে পাঠানো হয়।
এই দেশদ্রোহিতার মামলা নিয়েও নাটক হয়েছে অনেক। কানহাইয়া কুমারসহ দশজনের বিরুদ্ধে দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে ১,২০০ পাতার চার্জশিট জমা দেয় দিল্লি পুলিশ। কিন্তু আদালত দিল্লি পুলিশের জমা দেওয়া সেই চার্জশিট গ্রহণ করেনি। কারণ ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগে চার্জশিট জমা দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু কানহাইয়াদের চার্জশিটে কেজরিওয়াল সরকারের অনুমতি ছিল না।
এই ঘটনায় পুরো জেএনইউ জেগে ওঠে এবং বিজেপি সরকার সাধারণ জনগণের ব্যাপক রোষানলে পড়ে। বিজেপি মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী তার বিরুদ্ধে সংসদে ভাষণ দেন। তিন সপ্তাহ জেলে থাকার পর হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে কানহাইয়া মুক্তি পান এবং জেএনইউতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফিরে যান। সেখানে কানহাইয়া তার বিখ্যাত ৫২ মিনিটের একটি ভাষণ দেন, যেটি সকল ভারতীয় গণমধ্যমে লাইভ সম্প্রচার করা হয় এবং সেখানে থেকেই তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে আসেন। তিনি বলেছেন,
"দেশ থেকে মুক্তি নয়, দেশের ভেতরে মুক্তি চাই আমরা। আজাদি পেটের জ্বালা থেকে, আজাদি দুর্নীতি থেকে, আজাদি মনু-বাদ থেকে।"
বলা হচ্ছে, এটা ভারতের অন্যতম ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। যেখানে ভারতের একটি ছোট্ট গ্রামের অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা একজন তরুণ ভারতের আপামর গণমানুষের মনের কথা, দুঃখ-দুর্দশার কথা, অন্যায় ও শোষণের কথা, কৃষক-মজদুরের কথা তুলে ধরেছেন এবং পুরো বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
২০১৯ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কানহাইয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিহারের বেগুসরাই থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। এই ইলেকশনের সময়েও কানহাইয়া এনেছিলেন চমক। ফান্ডের জন্য তিনি ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে জনতার কাছে সাহায্য চান, যার অর্ধেকেরও বেশি ৩৫ লাখ রুপি একদিনেই উঠে আসে।
একদম সহজেই জয় পাওয়ার কথা থাকলেও এই আসনে বিজেপিকে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। বলাই হচ্ছে, আসনের অধিকাংশ তরুণের ভোট কানহাইয়ার পক্ষেই যাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দল কানহাইয়াকে সমর্থন জানিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কানহাইয়ার হয়ে কথা বলেছেন। বলিউড তারকারা, যেমন- শাবানা আজমী, জাভেদ আখতার, স্বরা ভাস্কর, প্রকাশ রাজ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তার হয়ে অনলাইন ও অফলাইনে প্রচারণা চালিয়েছেন। গত ২৯ এপ্রিল বেগুসরাইয়ে ভোট হয়। ফলাফল প্রকাশে এখনো আরও কিছুটা দেরি আছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি জরিপে কানহাইয়ার এগিয়ে থাকার আভাস পাওয়া গেছে।
পরিচিত হয়ে যাওয়ার পরও কানহাইয়ার জীবনযাত্রা পাল্টে যায়নি। বরং এখনো তিনি নিজেকে একজন কৃষকের ছেলে হিসেবেই পরিচয় দেন। কানহাইয়ার সবসময় রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা ছিল না। তার অনুপ্রেরণা ছিলেন মূলত তারই মতো আরেকজন শিক্ষার্থী রোহিত ভেমুলা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০১৫ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে স্কলারশিপে পিএইচডি করছিলেন রোহিত, যেখানে তার বিরুদ্ধে তিনি নিচু জাত অর্থাৎ দলিত শ্রেণীর গোষ্ঠীর হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার স্কলারশিপ বাতিল করে দেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্রদের সংগঠনের হয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন, যা পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হিয়ে যায়। রোহিত তার পড়াশোনা চালাতে পারেননি। ফলে হতাশ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন, যা ঐ সময় পুরো ভারতজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ভারতের হাজার হাজার বছরের পুরনো বর্ণপ্রথা এবং এখনো এই প্রথা কীভাবে একজন মানুষের জ্ঞান এবং দক্ষতার পরিচয়কে ছাপিয়ে জন্মগত পরিচয় দিয়ে সমাজে তার পরিচয় নির্ধারণ করে– সেটা আরেকবার সামনে চলে আসে। এই দলিত শ্রেণীর মানুষেরা কখনো স্বপ্নও দেখতে পারে না যে তারা কখনো তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবে। সমাজ কখনো তাদের ভুলতে দেয় না যে তারা নিচু তলার মানুষ। সেখান থেকেই কানহাইয়া নিপীড়িতদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন। তিনি এখনো তার বক্তৃতায় দলিতদের কথা বলতে গেলে তার বন্ধু রোহিতকে স্মরণ করেন। জেল থেকে বের হয়ে কানহাইয়া একটি বই লেখেন যার নাম “বিহার থেকে তিহার”।
এখানে তিনি তার ছোটবেলা থেকে শুরু করে চিন্তাধারা, রাজনৈতিক জীবন, জেএনইউ এ কাটানো সময়, তিন সপ্তাহের জেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখেছেন। কানহাইয়ার রাজনৈতিক পথচলা কেবল শুরু। হয়তো তিনি একটু আগেভাগেই তথাকথিত রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছেন। আবার হয়তো তার নিয়তিতেই ছিল দেশসেবায় নিয়োজিত হওয়া। যেটাই হোক, ভারতের রাজনীতিতে একজন কানহাইয়ার উত্থানকে ভারতের সাধারণ জনগণ আশার প্রদীপ হিসেবেই দেখছেন।
This is an article about Indian young politician Kanhaiya Kumar; who has been recently famous for his anti-government movement in support of the rural community and poor people. He was one of the candidtaes in the India's National Election of 2019.
Feature Image credit : DNA India