Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লাদাখে মুখোমুখি চীন-ভারত: প্রতিবেশীদের দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ

৫-৬ মে, ২০২০। লাদাখের প্যাংগং লেকের উত্তর তীরে সংঘর্ষে জড়ায় টহলরত ভারতীয় আর চীনা সামরিক বাহিনী। দুই পক্ষের সৈন্যরা একে অপরের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে, জড়িয়ে পড়ে হাতাহাতি লড়াইয়ে। দু’পক্ষের প্রায় আড়াইশো সৈন্য আহত হয় এই সংঘর্ষে। এই সংঘর্ষ বদলে দেয় চার দশকের বেশি সময় ধরে স্থিতিশীল সীমান্তকে, লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের দুই পাশের দেশ হাজির হয় নিজেদের ভূখণ্ড আর নিজেদের স্বার্থের সরাসরি লড়াইয়ে।

প্যাংগং লেকের এই সংঘর্ষের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় আড়াই হাজার মাইলব্যাপী বিস্তৃত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের অন্যান্য অংশেও; ভারতীয় আর চীনা সৈন্যরা এরপর সংঘর্ষে জড়ায় নকুলা অঞ্চলে। দুই পক্ষের দেড়শজন সৈন্যের এই সংঘর্ষে ভারতের চারজন সৈন্য আহত হয়, চীনের আহত হয় সাতজন সৈন্য। পরের দিনই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে প্যাংগং লেক আর নকুলার সংঘর্ষের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। ১২ মে আরেকটি স্টেটমেন্ট ইস্যু করে ভারতীয় সামরিক বাহিনী, শঙ্কা প্রকাশ করে গালওয়ান ভ্যালিতেও একইরকম সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার।

গালওয়ান ভ্যালিতে ভারতীয় সৈন্যরা; Image Source: India Aware.

পরের দিনগুলোতে দুই পক্ষ সংঘর্ষের ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ করে বিবৃতি দিতে থাকে, সামরিক সংঘর্ষগুলোর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পলিটিক্যাল ফ্রন্টেও। প্যাংগং, গালওয়ান ভ্যালি আর হট স্প্রিংইয়ের উত্তেজনার জন্য চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী করে ভারতের সামরিক বাহিনীকে, দুই পক্ষের সংঘর্ষে চীনের অংশগ্রহণকে আখ্যায়িত করে ‘প্রয়োজনীয় প্রতি-পদক্ষেপ’ হিসেবে। চীনের এই দাবির পাল্টা বিবৃতি আসে ভারতের পক্ষ থেকেও। মে মাসের শেষদিকে লাদাখে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের দুই পাশেই বাড়তে থাকে সৈন্য সমাবেশ, চীনের পাশাপাশি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে ভারতও।

সাড়ে চার দশকের স্থিতিশীল সীমান্ত সম্পর্কে বেশ কয়েকবারই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, দুই পক্ষ সমাধানে পৌঁছেছে আলোচনার মাধ্যমেই। প্যাংগং লেক, গালওয়ান ভ্যালি আর হট স্প্রিংয়ের উত্তেজনা কমাতে আলোচনায় বসেন দুই পক্ষের সামরিক নেতৃবৃন্দ। ভারতের পক্ষে আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরিন্দর সিং, চীনের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন পিএলএর দক্ষিণ জিনজিয়াং অঞ্চলের কমান্ডার মেজর জেনারেল লিউ লিন। পরের দিনগুলোতে মেজর জেনারেল র‍্যাংকের অফিসারদের মধ্যে আরো কয়েকটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তবে আলোচনার পর্বগুলো যে সংঘাতের উত্তাপ কমাতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গালওয়ান ভ্যালিতে দুই পক্ষের ১৫ জুনের সংঘাতে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত লাদাখের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় দুই দেশের সামরিক বাহিনী। সংঘর্ষে ভারতের নিহত হয় সামরিক বাহিনীর ২০ সদস্য, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন কর্নেল পদমর্যাদার অফিসার। সংঘর্ষে চীনের পিপলস লিবারেশন ফোর্সের নিহত সৈন্যসংখ্যা নিয়ে শুরু থেকেই রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। ভারত শুরুতে দুই পক্ষের সমসংখ্যক সৈন্য নিহত হওয়ার দাবি করে, রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তাসে চীনের সামরিক বাহিনীর নিহত সদস্য সংখ্যা দাবি করা হয় ৪৫ জন। চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল টাইমসের খবর অনুযায়ী, চীন এখন পর্যন্ত এই সংঘর্ষে চারজন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে। নিহতের সংখ্যার ব্যাপারে দাপ্তরিক এই বিবৃতির বাইরে ভারতের সাথে আন-অফিসিয়াল আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে চীন নিহতের বিভিন্ন সংখ্যা দাবি করেছে, এমন দাবি রয়েছে ভারতের সূত্রগুলোর দিক থেকে। 

লাদাখে পিপলস লিবারেশন আর্মি;  Image Source: Business Today. 

তবে নিহতের সংখ্যা ছাপিয়ে এই সংঘর্ষের মাধ্যমে চার যুগ ধরে ভারত-চীনের স্থিতিশীল সীমান্ত কাঠামোতে চিড় ধরে, ৪৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ঘটে সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনা।

সংঘর্ষ-পরবর্তী পথপরিক্রমা

ভারতের সাধারণত সীমান্ত উত্তেজনা থাকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সাথে, সামরিক আর রাজনৈতিক সংঘাতগুলোও হয় সাধারণত পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। গালওয়ান উপত্যকায় এই সংঘাতের মাধ্যমে পরিচিত সেই চিত্র বদলে যায়, সীমান্তে ভারতকে খুলতে হয় নতুন যুদ্ধফ্রন্ট। এই সংঘাতের মাধ্যমে চীনও তার প্রথাগত রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে আসে, যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিতর্কিত দোকলাম সংকটের মধ্য দিয়ে। দুই পক্ষের জন্যই আঞ্চলিক নেতৃত্বের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার সুযোগ আসে এই সংঘাতের মাধ্যমে।

তবে এই সংঘাতে জড়ালেও শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষই উত্তেজনাকে সীমিত রেখেছে, হেঁটেছে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের দিকে। ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এগারো দফা বৈঠক হয়েছে দুই পক্ষের সামরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে, রাশিয়ার মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে পাঁচ দফার চুক্তি। তবে সংকটের সমাধান এখনও হয়নি।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নবম দফার বৈঠকে প্যাংগং লেকের তীর থেকে সেনা সরাতে রাজি হয় দুই পক্ষ। চুক্তির ধারাবাহিকতায় প্যাংগং লেকের উত্তর ও দক্ষিণ তীর থেকে যাবতীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম সরিয়ে নেয় দুই দেশ, কমে আসে নিয়োজিত সৈন্যের সংখ্যাও। তবে প্যাংগং লেকের তীর থেকে সৈন্য সরে গেলেও দেপসাং, হটস্প্রিং, গোগরা অঞ্চল থেকে এখনও সেনা সরায়নি দুই পক্ষ।

লাদাখে সামরিক উপস্থিতি আছে দুই পক্ষেরই; Image Source: National Herald. 

স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত হয়, যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মানুষ এখন উপভোগ করছেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এই গণতান্ত্রিক বিশ্বে চীনের কর্তৃত্ববাদী কাঠামো সবসময়ই বৈধতার সংকটে ছিল, সমালোচনা ছিল পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও। এর মধ্যে, সম্প্রতি করোনা মহামারির উৎপত্তিস্থল ছিল চীন, পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার দায়ও পড়েছে চীনের কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর উপর। ফলে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে হওয়া সংঘর্ষে বৈশ্বিক সহানুভূতি পেয়েছে ভারত, পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনও এসেছে ভারতের দিকেই।

তবে সংঘাতস্থল গালওয়ান ভ্যালিতে চীনের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সামরিক উপস্থিতি ছিল ভারতের। সম্প্রতি তারা নতুন করে চালু করেছে দৌলত বেগ ওলদি বিমানঘাঁটি। মে মাসের সংঘর্ষের পরপরই লাদাখ ফ্রন্টে গিয়েছেন ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রধান, পরবর্তী সময়ে গিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও।

সংঘাতের প্রকৃত কারণ

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় চার যুগ ধরে স্থিতিশীল সীমান্তে হঠাৎ এই উত্তেজনাকে মে মাসের সংঘর্ষের ধারাবাহিক রূপ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই, মে মাসের সংঘাতকেও সুযোগ নেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার। বরং এই সংঘর্ষগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দুই দেশে জাতীয় স্বার্থের হিসাব, জড়িয়ে রয়েছে সীমিত সম্পদের মধ্যে থেকে জাতি হিসেবে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে রাখার তাড়না।

প্রথমত, লাদাখের বিভিন্ন ফ্রন্টে সাম্প্রতিক সময়ে যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক একটি কারণ পানির উৎসের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের দ্রুত শিল্পায়ন হয়েছে, বেড়েছে আবাদি কৃষিজমির পরিমাণ। পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে তারা কয়েক বছরের মধ্যেই মরুভূমিকে রূপান্তর করেছে বনে। অর্থনীতির এই বিরাট কর্মচাঞ্চল্যের জন্য চীন নির্ভরশীল তিব্বতের পানির উৎসগুলোর উপর। তিব্বতের পানির উৎসগুলো পৃথিবীর প্রায় ৪৫ ভাগ মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে।

ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করতে চায় চীন; Image Source: Al Jazzera. 

ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত যখন সিয়াচেন হিমবাহে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে, লাদাখে নিজেদের অংশ বাড়িয়েছে সামরিক অবকাঠামো, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে সরাসরি নিয়েছে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে, পুনরায় চালু করেছে দৌলত বেগ ওলদি বিমানঘাঁটি, তখন চীন নিজেদের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে বিচলিত হয়েছে। আবার চীনের ইয়ারলাং সাংপু নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে জিনজিয়াং প্রদেশে নেওয়ার চেষ্টাও ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে। একই প্রক্রিয়ায় চীন খরার মুখে ফেলেছে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওসের মতো দেশগুলোকে। ইয়ারলং সাংপু নদী ভারতে পরিচিত ব্রহ্মপুত্র নামে। ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ পানির সরবরাহের জন্য নির্ভরশীল ব্রহ্মপুত্রের উপর। ফলে পানির উৎসের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দুই দেশই আগ্রহী, সংলাপের মাধ্যমে পানি বন্টন নিশ্চিত করলেও সামরিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে চেয়েছে উভয়েই।

দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে চীনের, আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন বাস্তবতায় উঠতি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ভারতের। দুই পক্ষই আঞ্চলিক রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে নিজেদের কাছে টানছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে, এই প্রতিযোগিতার উত্তাপ ছড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও। দুই দেশের মধ্যে এই রাজনৈতিক সংঘাতের এক বাহ্যিক প্রকাশ ঘটেছে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায়, যা পরবর্তীতে ছড়িয়েছে আড়াই হাজার মাইলব্যাপী বিস্তৃত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের অন্যান্য ফ্রন্টেও।

রাজনৈতিকভাবে দুই নেতাই দেশকে নতুনভাবে তুলে আনছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে; Image Source: Indian Express.

প্রতিবেশীদের দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের, বাই-পোলার বিশ্বে নেতৃত্ব দেয় গণতান্ত্রিক বিশ্বকে। পরবর্তী চার দশকের বেশি সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নব্বইয়ের দশকে শেষ হয় দুই মতাদর্শের এই স্নায়ুযুদ্ধ, বিজয়ী হয় যুক্তরাষ্ট্র। পরের দুই দশক প্রায় একক কর্তৃত্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এশিয়ার দেশ চীন, শুরু হয়েছে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ। 

বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে যখন স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তখন যুক্তরাষ্ট্র ছিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। সামরিক বাহিনীর সামর্থ্যে তারা এগিয়ে ছিলোপ্রতিদ্বন্দ্বী সকল দেশ থেকে, এগিয়ে ছিলো প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও। একবিংশ শতাব্দীতে যখন যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধে নামছে, তখন অনেকগুলো সমীকরণই বদলে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য সীমিত হচ্ছে, অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে চীনের। প্রযুক্তিগত দক্ষতায় যুক্তরাষ্ট্রকে সমানে সমানে টেক্কা দিচ্ছে চীন, স্বল্পমূল্যের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে চীন বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সামরিক বাহিনীর সামর্থ্যে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনও এগিয়ে আছে, তবে এই স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য নির্ধারণ করবে না।

ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন বাস্তবতায় নতুন পলিসি নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এই স্নায়ুযুদ্ধে, জোর দিতে হচ্ছে আঞ্চলিক মিত্র তৈরির প্রক্রিয়াতে। সম্প্রতি লাদাখ এবং লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের অন্যান্য ফ্রন্টে দুই প্রতিবেশী দেশ যে সংঘাতে জড়িয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে।

প্রথমত, প্রতিবছর দুই দেশের মধ্যে প্রায় একশো বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ভারতের সাথে বাণিজ্যে চীনের উদ্বৃত ছিল ৬৩ বিলিয়ন ডলার, পরের বছর যেটা কমে আসে ৫৩ বিলিয়ন ডলারে। গালওয়ান ভ্যালিতে সংঘর্ষের পরপরই ভারতে চীনা পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয়। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় চীনের সকল পণ্য পুরোপুরি বর্জন করা ভারতের পক্ষে সম্ভব না হলেও পরের অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য আরো কমেছে। ২০১৯ সালে ভারত যেখানে চীন থেকে আমদানি করেছিল ৭০ বিলিয়ন ডলারে পণ্য, লাদাখে সংকটের পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে এই আমদানি কমে আসে ৬২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, চীনের সাথে বাণিজ্য কমাচ্ছে ভারত।

লাদাখ সংকট থেকে বাণিজ্যযুদ্ধে সুবিধা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; Image Source: Forbes India.

প্রতিবেশীর সাথে এই বাণিজ্যের হ্রাস একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে চীনের জন্য। আগামী দিনগুলোতে ভারতের সাথে চীনের বাণিজ্য আরো কমলে অর্থনৈতিকভাবে চীনের সামর্থ্য সীমিত হবে। এই পরিস্থিতির উপকারভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র

দ্বিতীয়ত, সবসময়ই বৈশ্বিক পরাশক্তির নির্ধারক ফ্যাক্টর হয় উদ্ভাবনী শক্তি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মন্থর হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইনোভেশন ইঞ্জিন, বাজার দখল করছে চীনের উদ্যোক্তারা। প্রযুক্তি জগতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্কা দিতে হলে ভারতের মেধাবী অংশকে প্রয়োজন, প্রয়োজন ইনোভেশন ইঞ্জিন গতিশীল রাখাও। চীনের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ভারতীয় উদ্যোক্তারা তাই একমুখীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক করতে চাইবে অস্থিতিশীলতা এড়াতে, অভিবাসনও হবে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রমুখী।

ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে অভিবাসীরা; Image Source: Time Magazine.

তৃতীয়ত, এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে ভারতের রাজনৈতিক উত্থান ঘটছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জানান দিচ্ছে নিজেদের উপস্থিতির। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে দুই দেশের, চীনের একক কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও। ভারতের এই রাজনৈতিক উত্থান চীনের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সীমিত করবে, সীমিত করবে চীনের প্রভাব বলয়কেও। ফলে ভারতের রাজনৈতিক উত্থান যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক সুবিধা দেবে একবিংশ শতাব্দীর নতুন স্নায়ুযুদ্ধে।

তবে এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। যেকোনো ধরনের সামরিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে হতে পারে ভারতের পক্ষে, ভারতকে দিতে হতে পারে সামরিক সাহায্য।

লাদাখে দুই প্রতিবেশীর মুখোমুখি অবস্থানের চিত্র প্রতিমুহূর্তে বদলাবে, প্রভাবিত করবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেও। লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের অন্যান্য ফ্রন্টেও এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে, বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক মানচিত্র। তবে প্রতিবেশী দুই দেশের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত থাকায় সেই সংঘাত মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

This article is written in Bangla, about the last year conflict between India and China in Ladakh. This article also critically analyze the interest of US from this conflict. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Image Source: Getty Images. 

Related Articles