ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্সের’ আলোকে মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত (৩য় পর্ব)

১৫১২ সালের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ফ্লোরেন্টাইনের ক্ষমতাবৃত্ত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে, মেদিচিদের হাতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দীত্বের পর বরণ করতে হয় নির্বাসন। এই নির্বাসনকালেই নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ‘দ্য ডিসকোর্সেস অন লেভি’, ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’, ‘ফ্লোরেন্টাইন হিস্টরিজের’ পাশাপাশি লিখেছেন তার বিখ্যাত বই, দ্য প্রিন্স’। শুরুর দিকে ‘দ্য প্রিন্স’ নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করা হলেও, বইটি প্রকাশ করা হয় ১৬৩২ সালে, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির মৃত্যুর ৫ বছর পরে। প্রকাশের পরপরই বইটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে, সমালোচনা কুড়ায় নৈতিকতার উপর রাজনৈতিক স্বার্থকে স্থান দেওয়ায়, রাজনৈতিক অপরাধকে বৈধতা দেওয়ায়। ১৫৫৭ সালে রোমে যখন পোপ চতুর্থ পল নিষিদ্ধ বইয়ের ইনডেক্স তৈরি করেন, তাতে অন্তর্ভুক্ত করেন ম্যাকিয়াভেলির লেখা দ্য প্রিন্সকেও

জ্ঞানের প্রবাহকে যেমন কোনো সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না, তেমনিভাবে ‘দ্য প্রিন্সের’ চর্চাও পোপ আটকে রাখতে পারেনি নিষিদ্ধ করে। বরং, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের জনক হিসেবে, পাঁচশো বছর পরেও রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে তার বই, ‘দ্য প্রিন্স’। 

‘দ্য প্রিন্সের’ লেখক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি; Image Source: Britannica. 

রাজনীতিকে নৈতিকতা থেকে আলাদা করে দেখা এই লেখকের ‘দ্য প্রিন্সের’ আলোকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বর্তমান সময়ে সৌদি আরবের আলোচিত প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতিকে। তৃতীয় ও শেষ পর্বে থাকছে মোহাম্মদ বিন সালমান একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের চরিত্র কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেন, সেই আলোচনা। 

‘দ্য প্রিন্সের’ পঞ্চদশ অধ্যায়

‘দ্য প্রিন্সের’ পঞ্চদশ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে প্রশংসিত হতে পারে, সেই ব্যাপারে। একজন শাসক যখন অনুকম্পাশীল হন, বিশ্বাসী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন, তার চরিত্রে থাকে দয়া ও ধার্মিকতা, তখন তিনি প্রজাদের কাছে প্রশংসিত হোন, প্রজাদের কাছে একজনের শাসকের পাশাপাশি হয়ে ওঠেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

আবার, শাসকের মধ্যে যখন কাপুরুষতা ফুটে ওঠে, বিভিন্ন কাজে অস্থিরতা ফুটে ওঠে, শাসনে প্রকাশ ঘটে লঘুচিন্তার ছাপ, প্রজাদের মধ্যে তখন রাজার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। রাজার মধ্যে ভীরুতা ও কমনীয়তা থাকলে প্রজারা সেগুলো দ্বারা প্রভাবিত হন, সংকটে পড়ে শাসক হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা। এমতাবস্থায়, প্রজারা অনেক সময়ই রাজার বিরুদ্ধে আঁতাতে জড়িয়ে পড়েন, অনেক সময় রাজার বিরুদ্ধে করেন বিদ্রোহ। কখনো কখনো প্রজারা হাত মেলায় রাজার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে, অনেক সময় বিদেশীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায় প্রজারা।

ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত সমালোচনা কুড়িয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: Th Times.

২০১৫ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান তার রাজনৈতিক উত্থানের পর থেকে যেসব কাজ করেছেন, সেগুলো প্রশংসার চেয়ে সমালোচনাই কুড়িয়েছে বেশি। রাজনৈতিকভাবে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালানো। অনেকটা সৌদি আরবের এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে ইয়েমেন অভিযান শুরু করেন মোহাম্মদ বিন সালমান, তার সঙ্গী হয় মধ্যপ্রচায়ের সুন্নিপ্রধান আট দেশ।

সাত বছরে বিপুল সামরিক ব্যয় আর ইয়েমেনে বিশ হাজারের মতো সামরিক অভিযানের পরেও এখন পর্যন্ত সৌদির প্রাপ্তি শূন্য, সময়ের সাথে যুদ্ধফ্রন্টে সৌদিকে রেখে ফ্রন্ট ছেড়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ইয়েমেন যুদ্ধের মতো তার লঘুচিন্তার ছাপ রয়েছে কাতার অবরোধের সিদ্ধান্তেও। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরেই উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয় দেশকে নিয়ে কাতার অবরোধের ঘোষণা দেন মোহাম্মদ বিন সালমান। চার বছর পর, কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে সেই অবরোধ। ইরানকে মোকাবেলা থেকে শুরু করে সমালোচকদের মুখবন্ধ করার প্রক্রিয়াতে মোহাম্মদ বিন সালমানের অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। বয়স ত্রিশের কোঠায় থাকায় অভাব আছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার, ব্যর্থ হচ্ছেন নিজের ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে।

‘দ্য প্রিন্সের’ ষোড়শ অধ্যায় 

‘দ্য প্রিন্সের’ ষোড়শ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন রাষ্ট্রনায়কের জন্য বদান্যতা ও কৃপণতার মধ্যে কোনটি ভালো, সেই ব্যাপারে। একজন রাষ্ট্রনায়ক যদি তার উদার হস্তের জন্য প্রজাদের কাছে প্রশংসিত হন, তাহলে সেটি খুবই আনন্দের ব্যাপার। তবে রাষ্ট্রনায়ক যদি কখনো এই গুণটির আতিশায্য দেখান, মাত্রাতিরিক্ত খরচ করেন, তাহলে তা ভবিষ্যতের জন্য খুব একটা সুখকর হয় না। কারণ, রাজার অতিরিক্ত খরচের ভার বহন করতে গিয়ে রাজকোষে টান পড়বে, সেই খরচ যোগাতে আমলারা অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেবেন প্রজাদের উপর। আবার, রাজা অতিরিক্ত খরচ না করলে, সেই অর্থ সাধারণের উন্নয়নে ব্যবহার করা যেত, বাড়ানো যেত ক্রমক্ষমতা, বৃদ্ধি ঘটত জীবনমানের। ফলে, অকৃপণতা গুণটি রাজার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য খুব একটা ইতিবাচক হয় না।

এর বিপরীতে, যারা যখন কৃপন হন, তখন তার খরচের জন্য কোনো অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয় না, কর বাড়াতে হয় না রাজস্ব বাড়াতেও। জনগণের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা না চাপিয়েই তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন, শত্রুর মোকাবেলা করতে পারেন, বদান্যতা দেখিয়ে ক্ষুদ্র অংশের উপকার না করে তিনি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উপকার করতে পারে। তিনিই কালক্রমে উদার রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই পরিচিত লাভ করেন, জনগণের কাছে আবির্ভূত হন প্রকৃত শাসক হিসেবে।

১৫ নভেম্বর, ২০১৭। নিলাম সংস্থা ‘ক্রিস্টিস’-এর আয়োজিত নিলামে প্রায় ৪৫ কোটি মার্কিন ডলারে বিক্রি হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পেইন্টিং, ‘সালভাতর মুন্দি’। ৪৫ কোটি ডলার দামের মাধ্যমে এই পেইন্টিং নতুন বিশ্বরেকর্ড করে, এর ক্রেতাকে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ। মার্কিন গোয়েন্দাদের তদন্তে অবিশ্বাস্য মূল্যে এই পেইন্টিংয়ের ক্রেতা হিসেবে উঠে আসে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম। এটি স্থান পায় তার ৫০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা ইয়টে। এক মাস পরেই নিউ ইয়র্ক টাইমসের সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে একটি প্রাসাদ কিনেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

ব্যয়বহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: Pinterest

সৌদি রাজকোষের অর্থ ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই এভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান, বারবার শিরোনাম হয়েছেন বিলাসবহুল ইয়ট, প্রাসাদ আর দুর্লভ পেইন্টিং কেনার খবরে। ফলে, সময়ের সাথে একটি উড়নচণ্ডী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের। ম্যাকিয়াভেলির পাঠের আলোকে বলা যায়, মোহাম্মদ বিন সালমানের এই ভাবমূর্তি তার শাসনের জন্য খুব একটা উপকারী না। বরং, যেকোনো অর্থনৈতিক সংকটে প্রজারা তাকেই দুষবে।

‘দ্য প্রিন্সের’ সপ্তদশ অধ্যায়

দ্য প্রিন্সের সপ্তদশ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন রাষ্ট্রনায়কের দয়ালু হওয়া উচিত নাকি নির্দয় হওয়া উচিত, সেই প্রসঙ্গে। একজন রাষ্ট্রনায়কের কঠোর নায়করূপে অভিহিত হওয়ার চেয়ে দয়ালু রাষ্ট্রনায়করূপে পরিচিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। কারণ, একজন রাষ্ট্রনায়ক যদি অতিরিক্ত বদান্যতা দেখান, তবে তা রাজ্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে, অস্থিতিশীলতার সুযোগে ঠেলে দিতে পারে গৃহযুদ্ধের দিকে, বিঘ্নিত হতে পারে রাষ্ট্রের অখণ্ডতার ধারণা। ফলে, দয়ালু পরিচয়ের পাশাপাশি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে কঠোরও হতে হবে, হতে হবে নির্দয়। তবে, প্রত্যেক কাজেই রাষ্ট্রনায়ককে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধুর প্রতি বদান্যতা ও শত্রুর প্রতি নির্মমতা যেনো কখনো এই পর্যায়ে গিয়ে না পৌঁছে যে, তার বন্ধু বা শত্রুরা সুযোগ পেলেই তাকে রাজ্যচ্যুত করে।

অক্টোবর, ২০১৮। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর নির্মমভাবে খুন হন সাংবাদিক জামাল খাসোগজি। একটা দীর্ঘ সময় সৌদি রাজপরিবারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন জামাল খাসোগজি, সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে শুরু থেকেই তৈরি হয় মতভিন্নতা, ছাড়তে হয় দেশ। দেশ ছাড়ার পরও খাসোগজি নিয়মিত সৌদি আরবের বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন, লিখেছেন কলাম। কনস্যুলেটে হত্যার ১৮ দিন পর সৌদি আরব স্বীকার করে হত্যার দায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে হত্যার অনুমোদনকারী হিসেবে উঠে আসে মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে হত্যা করা হন সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে; Image Source: Middle East Monitor. 

জামাল খাসোগপজির এই হত্যার বাইরেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনাকারীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন এই ক্রাউন প্রিন্স। সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টা করেছেন কানাডাতে, ইয়েমেন যুদ্ধের ভয়াবহতার জন্যও দায়ী করা হয় তাকে। তার সময়েই সৌদি আরবে বেড়েছে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা, অভিযোগ আছে অধিকারকর্মীদের উপর চড়াও হওয়ার। সব মিলিয়ে, কঠোর স্বৈরতন্ত্রের কাঠামো তৈরি করছেন মোহাম্মদ বিন সালমান, যেকোনো উপায়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার নীতি তাকে দিয়েছে একজন নির্দয় শাসকের পরিচিতি।

‘দ্য প্রিন্সের’ অষ্টাদশ অধ্যায়

দ্য প্রিন্সের অষ্টাদশ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে তার অঙ্গীকারের মূল্য দিবেন, সেই প্রসঙ্গে। অপরের প্রতি ধড়িবাজ ও প্রতারক হওয়ার চেয়ে একজন রাষ্ট্রনায়কের বলিষ্ঠ, ঈমানদার হওয়াই অনেক বেশি প্রশংসনীয়। কিন্তু, ইতিহাস বলে, যেসব রাষ্ট্রনায়ক সৎপথের অনুসারী ছিলেন, প্রতারণা থেকে দূরে থেকেছেন, অধীনস্থদের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছেন, তাদের অনেককেই পরবর্তীতে চাতুর্য ও কৌশলের কাছে পরাজিত হতে হয়েছে। চাতুর্য ও কৌশলকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় আসা অনেকেই পরবর্তীতে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

পৃথিবীতে দুটি পথ অবলম্বন করেই রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব। প্রথমত, আইনানুসারে, দ্বিতীয়ত, আসুরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। যদিও প্রথম পদ্ধতিটি মানুষের জন্য, দ্বিতীয় পদ্ধতিটি পশুদের জন্য, কিন্তু প্রথম পদ্ধতিটি কার্যকর না হলে শাসকের কাছে দ্বিতীয় পদ্ধতি গ্রহণ ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ, সময়ে রাজা রাজনৈতিক জ্ঞান ব্যবহার করে চাতুর্য দেখাবেন, তার সামর্থ্য থাকতে হবে বলপ্রয়োগেরও। কিন্তু, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হতে হলে, এই দুটিই সূচারুভাবে প্রয়োগ করার সামর্থ্য থাকতে হবে।

সউদ বংশের তৃতীয় প্রজন্মের ক্রাউন প্রিন্স, মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থানের প্রক্রিয়ায় চতুরতা ছিল, ছিল কলাকৌশলের ব্যবহারও। কিন্তু, রাজতন্ত্রে যেহেতু উত্তরাধিকার বংশানুক্রিমকভাবেই নির্ধারিত হয়, তাই প্রথা ভেঙে যুবরাজ বিন সালমানের উত্থানকেও আইনত অবৈধ বলার উপায় নেই। শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মোহাম্মদ বিন সালমান চতুরতার ব্যবহার করেছেন, বলপ্রয়োগেরও অজস্র উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। শাসক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলির দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে মূল্যায়ন করতে হলে, আমাদের জানতে হবে, মোহাম্মদ বিন সালমান এই চতুরতা কিংবা বলপ্রয়োগ যথাযথভাবে করতে পারছেন কিনা।

এখনো শাসনকাজে চতুরতা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেননি এমবিএস; Image Source: Getty Images.

রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার অনেকটা জাতীয় সংসদের মতো। যেকোনো ইস্যুতে টুইটারে সাধারণত বিতর্ক হয়, টুইটারকে অনুসরণ করেই অনেক পলিসি নেয় সৌদির শাসকেরা। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে উত্থানের পরপরই নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে টুইটারকে বেছে নেন মোহাম্মদ বিন সালমান, সময়ের সাথে প্রচলন করেন বিভিন্ন হ্যাশট্যাগের। কিন্তু, একই সাথে টুইটারে তার সমালোচকদের কঠোর হাতে দমন করেন, দমন-পীড়ন চালান টুইটারে সক্রিয় মানবাধিকার কর্মীদের উপরও। আর টুইটারে বেনামে তার সমালোচনা করা ব্যক্তিদের ধরতে টুইটারের কর্মীদের ঘুষ দেন বিন সালমানের অনুগতরা। এই স্ক্যান্ডাল সামনে আসার পরে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হয় বিন সালমানের অনুগত সেই টুইটার কর্মীর উপরে। এর বাইরে, সৌদির রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কমিয়ে সেই ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে শেষ করতে পারেননি, পরিস্থিতি অগোছালো হয়ে যাওয়ায় তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে বাদশাহ সালমানকে। 

জামাল খাসোগজিকে হত্যা, ইয়েমেনে সামরিক শুরু করে নির্বিচারে হামলা, প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো নির্দয়তার বেশ কিছু উদাহরণ আগের অধ্যায়ের আলোচনায় উঠে এসেছে। মোহাম্মদ বিন সালমান এই নির্দয়তাগুলোকে সময়ের সাথে জাতীয়তাবাদের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে সাফল্য এসেছে সামান্যই।

‘দ্য প্রিন্সের’ উনবিংশ অধ্যায়

দ্য প্রিন্সের উনবিংশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে একজন রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে ঘৃণা ও গ্লানি থেকে বেঁচে থাকবেন, সেই প্রসঙ্গে। আগের অধ্যায়গুলোর আলোচনার একটি সারমর্ম এরকম দাঁড়ায় যে, রাষ্ট্রনায়ক যা-ই করুক না কেন, তিনি যেন এমন কোনো কাজ না করেন, যার কারণে তাকে জনগণের কাছে ঘৃণিত হতে হয়, জনগণের নিন্দার বাণ তার দিকে ছুটে আসে। যদি কোনো রাষ্ট্রনায়ক নিজেকে প্রজাদের ঘৃণা আর নিন্দা অর্জন থেকে দূরে রাখতে পারেন, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে শাসকের রাজ্য হারানোর মতো জোরালো কোনো কারণ তৈরি হয় না।

শাসনকাজে এখনো স্থিতিশীলতা আনতে পারেননি মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: financial Times. 

একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শাসক যদি কাপুরুষ না হোন, অস্থিরচিত্ত না হয়ে স্থিতিশীলভাবে সিদ্ধান্ত নেন, ভীরুতার বদলে দৃঢ়চিত্তে শত্রুদের মোকাবেলা করেন, লঘুচিন্তার বদলে শাসনকার্যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন, কমনীয়তাকে এড়িয়ে চলেন, তবে সময়ের সাথে সেই শাসক সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। তখন তিনি সহজেই প্রজাদের মধ্যে কোনো আঁতাত হলে তার মোকাবেলা করতে পারেন, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাই তাকে সমর্থন দেবে বিদ্রোহ দমনে। বিদেশী শত্রুর আক্রমণ হলে, সেনাবাহিনী আর প্রজাদের সাহায্যে তিনি শত্রুর মোকাবেলা করতে পারবেন।

দ্য প্রিন্সের বিংশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক কোন ধরনের দুর্গ ও অস্ত্রশস্ত্রের উপর ভরসা করতে পারেন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহিমান্বিত হওয়ার প্রক্রিয়া আলোচিত হয়েছে একবিংশ অধ্যায়ে। পরের অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে অমাত্যগণে নিয়োগের ব্যাপারে, ত্রয়োবিংশ অধ্যায়ের আলোচনা চাটুকার সভাসদদের নিয়ে। সর্বশেষ তিন অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ইতালির তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে, কীভাবে ইতালিকে অসভ্যদের হাত থেকে মুক্ত করা যায়, সেই প্রসঙ্গে। এই অধ্যায়গুলোর সাথে মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের যে অংশগুলো সম্পর্কিত, তা পূর্বের আলোচনাতেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত

অনেকগুলো প্রথা ভেঙে বয়স ত্রিশের কোঠায় থাকতেই সৌদি আরবের শীর্ষ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হন মোহাম্মদ বিন সালমান। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে। কিন্তু, অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে উচ্চপদে আরোহণের অনুসৃত দীর্ঘদিনের নীতির ব্যত্যয়ের ফলাফল যে খুব একটা ভালো হয়নি, তার প্রমাণ গত কয়েক বছরে তিনি দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবের পরেও বিশেষজ্ঞ মতামত এড়িয়ে, একের পর এক বেপরোয়া পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদের আত্মঘাতী হয়েছে তার জন্য, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য।

আত্মঘাতী পদক্ষেপের গোলকধাঁধায় আটকে আছেন মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: The Muslim Times. 

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্সের আলোকে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা দেখি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের যেরকম ভূমিকা নেওয়া উচিত, তিনি তার বিপরীত উদ্যোগ নিয়েছেন। এই বেপরোয়া রাজনীতির ফলাফল ইতোমধ্যেই পাচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, অস্থিতিশীল করে তুলেছেন সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আশু সমাপ্তি ঘটবে

ঠিক কবে বা কীভাবে মোহাম্মদ বিন সালমানের অধ্যায়ের শেষ হবে, সেটা আমরা জানি না, সেই উত্তর ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন দিতে পারে না। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলির দর্শন থেকে আমরা বলতে পারি, মোহাম্মদ বিন সালমান যদি নিজেকে পরিবর্তন না করেন, তবে হয়তো তিনিই পরিবর্তন হয়ে যাবেন অন্য কোনো প্রিন্সের দ্বারা।

This article was written in Bangla about the political future of Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman, in the light of  Niccolo Machiavellie's 'The Prince'. (Part- three) 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: The Guardian. 

Related Articles