Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্সের’ আলোকে মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত (২য় পর্ব)

১৫১২ সাল। ফ্লোরেন্টাইনের রাজনীতি তখন নানা কারণে অস্থির এক সময় পার করছে। ১৪৯৪ সালে ক্ষমতা হারানো, ফ্লোরেন্সের ডি ফেক্টো শাসক মেদিচি পরিবার তখন রিপাবলিকানদের পরাজিত করে ক্ষমতায় আসার জন্য পথ খুঁজছে। মেদিচি পরিবারের পুনরুত্থান আটকাতে ১২ হাজার সদস্যদের এক বাহিনী তৈরি করা হয়, আনকোরা যে বাহিনীকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন আমলা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির উপর। 

সুসংগঠিত মেদিচি পরিবারের বাহিনীর সামনে রিপাবলিকানরা প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। বিজয়ী হয়ে ফ্লোরেন্সের ক্ষমতায় আবার আসে মেদিচি পরিবার, বন্দী করা হয় নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে। জেলে মেসেডিদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর মুক্তি পান নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয় নিজের পিতৃভূমিতে। 

নির্বাসনে থাকা অবস্থায় ম্যাকিয়াভেলি মনস্থির করেন মেদিচির মন জয় করার। সেই উদ্দেশ্যে লিখে ফেলেন ‘দ্য প্রিন্স’ নামক বই, উৎসর্গ করেন মেদিচি পরিবারের প্রিন্স জিয়্যুলিয়ানু দ্য’ মেদিচিকে, ১৫১৬ সালেই তার মৃত্যু হলে উৎসর্গপত্রে নাম চলে আসে মেদিচি পরিবারের আরেক প্রিন্স, লরেঞ্জো দি পিয়েরো দ্য’ মেদিচির।

‘দ্য প্রিন্সের’ লেখক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি; Image Source: Britannica.  

পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ‘দ্য প্রিন্স’ লেখা হলেও এটি প্রকাশিত হয় ১৫৩২ সালে, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির মৃত্যুর ৫ বছর পরে। প্রকাশের পরপরই আলোড়ন তোলে বইটি, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে এনে দেয় আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের জনকের খেতাব। তৎকালীন ইতালির প্রেক্ষাপটে বইটি লেখা হলেও, বইটি কালকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে, একে ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে আধুনিক রাজনীতিবিদদেরও। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্সের’ আলোকে, বর্তমান সময়ের আলোচিত সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। প্রথম পর্বে ‘দ্য প্রিন্সের’ প্রথম ছয় অধ্যায়ের আলোকে যুবরাজ বিন সালমানের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, দ্বিতীয় পর্বে ব্যাখ্যা করা হবে পরবর্তী আটটি অধ্যায়ের আলোকে। 

‘দ্য প্রিন্সের’ সপ্তম অধ্যায়

‘দ্য প্রিন্সের’ সপ্তম অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন পর-সাহায্যে ও সৌভাগ্যক্রমে লব্ধ রাজ্য শাসন সম্পর্কে। সাধারণ পর্যায় থেকে অনেক সময় ভাগ্যগুণে রাজনৈতিক উত্থান ঘটে, সাধারণ নাগরিক শ্রেণী থেকে শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পারে প্রবল ক্ষমতাশালী কারো সুদৃষ্টিতেও। অনেক সময় অভিজাতেরাও ক্ষমতা দখলের নেশায় উন্মুখ হন, ক্ষমতা দখল করতে চান অর্থের জোরে। সাধারণভাবে নিজগুণে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া শাসকদের চেয়ে এই পর-সাহায্যে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা অনেক সহজেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি অস্থিতিশীল সময় কাটান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন, ব্যর্থ হন শাসক হিসেবে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে। সহজে অঙ্কুরিত ও দ্রুত বেড়ে যাওয়া জাগতিক বস্তু যেমন অল্প ঝড়ো হাওয়াতেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, পর-সাহায্য ও সৌভাগ্যক্রমে অধিষ্ঠিত হওয়া রাষ্ট্রনায়কেরাও একই ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েন।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা বাদশাহ সালমান ইবনে আবদুল আজিজ, সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সউদের পঁচিশতম ছেলে। আবার, যুবরাজ বিন সালমান বাদশাহ সালমানের তের সন্তানের মধ্যে অষ্টম, বিন সালমানের মা বাদশাহ সালমানের তৃতীয় স্ত্রী। দশ হাজারের অধিক সদস্য বিশিষ্ট সৌদি রাজপরিবার থেকে শাসনক্ষমতায় আসা সবসময়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার, প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের শীর্ষপদে থাকা ব্যক্তির সুদৃষ্টিরও।

আবদুল আজিজ ইবনে সউদের পঁচিশতম ছেলে বাদশাহ সালমান, বাদশাহ সালমানের অষ্টম সন্তান মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: The Guardian. 

এর বাইরেও সৌদি আরবের রাষ্ট্রকাঠামোতে যোগ্যতার চর্চার প্রথা আছে, আছে বেশ কিছু উদাহরণও। রাষ্ট্রীয় শীর্ষপদগুলো আসতে সৌদি আরবের প্রিন্সদের প্রয়োজন অভিজ্ঞ ক্যারিয়ারের, প্রয়োজন নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত জায়গাগুলোতে কৃতিত্ব প্রদর্শনের। বর্তমান বাদশাহ সালমান ইবনে আবদুল আজিজ ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রায় পাঁচ দশক ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন রিয়াদের গভর্নর হিসেবে, দীর্ঘদিন গভর্নরের অফিস সামলানোর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তার ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুসরণ করার সুনাম, ছিল দক্ষ নীতি-নির্ধারকের সুনামও।

অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্বভাবতই সময় প্রয়োজন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তৈরির জন্য প্রয়োজন বয়সও। সৌদির শীর্ষপদগুলোতে সেজন্য সাধারণত বয়স্ক প্রিন্সদেরই দেখা যেত। বর্তমান বাদশাহ সালমান যখন ২০১১ সালে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর বয়স সত্তর পেরিয়েছে। পরের বছর তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স নায়েফ ইবনে আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হন তিনি। ২০১৫ সালে তিনি যখন বাদশাহ পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। বাদশাহ সালমান বর্তমানে সৌদির দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত প্রিন্স।

বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা, দুটোতেই রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের যে সাধারণ প্রথা, মোহাম্মদ বিন সালমান সেগুলো পূরণ করে ক্ষমতায় আসেননি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উত্থানে বরং আরেকটি ব্যাক-স্লাইডিং হয়ে থাকবে, ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পর-সাহায্যের মুখাপেক্ষী হওয়া।

২০১৫ সালের এপ্রিলে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ বিন সালমান, একই সময়ে প্রিন্স মুকরিনকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে মনোনীত করেন বাদশাহ সালমান। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উচ্চাশা তখন আকাশ ছুঁয়েছে। বাবা বাদশাহ সালমানের বয়স আর ভগ্নস্বাস্থ্যকে বিবেচনা করে পরিকল্পনা করেন রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে দিতে, নিজেই ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে। তার এই পরিকল্পনার সঙ্গী হন সংযুক্ত আরব আমিরাতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। বিন নায়েফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি আদায় করেন বিন জায়েদই, ইসরায়েলের লবির সাথে বিন সালমানের সম্পর্কও তৈরি করে দেন আমিরাতের এই প্রিন্সই।

মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদের জুটি বদলে দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি; Image Source: The Washington Post. 

সৌভাগ্য আর পর-সাহায্যকে কেন্দ্র করে ক্ষমতায় আসা মোহাম্মদ বিন সালমান শাসক হিসেবে সীমাহীন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, একের পর এক বিতর্কিত কাজ করে হয়েছেন সমালোচিত। ঘরে বাইরে দু-হাতে শত্রু তৈরি করছেন, ভেঙে দিতে চাচ্ছেন সৌদির প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামো। শাসক হিসেবে যতটা সহজে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ততটা সহজ পরিবেশ তিনি পাচ্ছেন না।

‘দ্য প্রিন্সের’ অষ্টম অধ্যায়

‘দ্য প্রিন্সের’ অষ্টম অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন সাধারণতন্ত্রে হীনপন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় আসা শাসকদের ব্যাপারে। সাধারণতন্ত্রে একজন শাসক ক্ষমতায় আসতে পারে দুই উপায়ে; প্রথমত, জনগণের সমর্থন নিয়ে বৈধ উপায়ে, দ্বিতীয়ত, জনগণের সমর্থন ছাড়াই হীন-পন্থা অবলম্বন করে। হীনপন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় আসা শাসকেরা ক্ষমতায় এসে নিজের শাসনকে টিকিয়ে রাখতে আবার দুটি পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমত, শুরুতেই অবর্ণনীয় অত্যাচার করে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ করার ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়া, দ্বিতীয়ত, সময়ের সাথে অত্যাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, জনগণের সামনে প্রতিনিয়ত অত্যাচারের উদাহরণ তৈরি করা। সাধারণত, প্রথম পদ্ধতি যেসব শাসক অনুসরণ করে, তারা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময় টিকে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতি যারা অনুসরণ করে, সময়ের সাথে তারা ঘৃণা উৎপাদন করেন, ঘৃণা থেকে ভয় তৈরি হয়, ভয়কে একসময় পাশ কাটিয়ে মানুষ বিদ্রোহ করে, বিপ্লব করে।

২০১৭ সালে তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যেভাবে বাদশাহ সালমানের নাম ব্যবহার করে রাজপ্রাসাদে ডেকে এনেছিলেন তখনকার ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, রাতভর বিন নায়েফকে বন্দী করে রেখে, পরিচিতিদের মাধ্যমে হুমকি-ধামকি প্রদর্শন করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়েছিলেন, সেগুলোকে হীনপন্থা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে যেহেতু সৌদি আরবে সাধারণতন্ত্র নেই, তাই মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতিকেও এই অধ্যায়ের আলোকে ব্যাখ্যা করা প্রাসঙ্গিক না।

মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হন মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: The Africa Report.com

সাধারণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা আছে দ্য প্রিন্সের নবম অধ্যায়ে, দশম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে, কোনো রাজ্য কতটুকু শক্তিশালী তা নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে। মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থান, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার কার্যাবলি, রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আলোচনায় এই দুটি অধ্যায়ও খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়।

‘দ্য প্রিন্সের’ একাদশতম অধ্যায়

দ্য প্রিন্সের একাদশতম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ধর্মীয় রাষ্ট্রকে শাসনে রাখার ব্যাপারে। ধর্মীয় রাষ্ট্রকে শাসনে রাখা তুলনামূলকভাবে সহজ। রাষ্ট্রনায়কের উত্থান নিজ গুণে হোক, পর-সাহায্যে হোক কিংবা হীনপন্থা অবলম্বন করে হোক, ধর্মীয় ন্যায়নীতির ধারণাকে ব্যবহার করে তিনি খুব সহজেই তিনি শাসনকে স্থিতিশীল করতে পারেন, দৃঢ় করতে পারেন নিজের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে খুব বেশি সফলতা দেখাতে না পারলেও এই ধরনের রাজ্যে প্রজাদের বিদ্রোহ করার আশঙ্কা তেমন একটা নেই, রাজাকে রাজ্যচ্যুত করার চিন্তাভাবনাও এই ধরনের রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে কমই আসে। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে কিংবা রাজাকে রাজ্যচ্যুত করতে যে সাহস আর শক্তির প্রয়োজন হয়, তা সাধারণত ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রজাদের মধ্যে থাকে না। রাজা কেবলমাত্র প্রকাশ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দ্বন্দ্বে না জড়ালেই মসৃণ হয় শাসন।

রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যের বিচারে সৌদি আরবকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। সৌদি আরবের সংবিধান ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন, সৌদির বিচার বিভাগ চলে ইসলামী আইনে, শাসকগণ তাদের কাজকর্মের ধর্মীয় বৈধতার জন্য দায়বদ্ধ থাকেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারসের কাছে। সৌদি আরবের বাদশাহরা নিজেদের পরিচয় দেন মক্কা ও মদীনার দুই মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। সৌদি আরবের নাগরিকেরাও কঠোর রক্ষণশীল, ধর্মের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত।

এরকম একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রের ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে, প্রথা ভেঙে, পর-সাহায্যে ও হীনপন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় আসলেও, মোহাম্মদ বিন সালমানের সামনে সু্যোগ ছিল ধর্মীয় রীতিনীতি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে নিজের শাসনকে মসৃণ করার, শাসক হিসেবে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করার। সেই জায়গায়ও ব্যর্থতাই সঙ্গী হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের।

পবিত্র কাবা শরীফে মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: The Arab News. 

মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ২০১৭ সালেই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান বিন সালমান, বন্দী করেন শীর্ষস্থানীয় দুই ডজন ধর্মীয় নেতাকে। এর মধ্যে আছেন আল্লামা সালমান আল-ওদাহ, আল্লামা আওয়াদ আল-কারনির মতো জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতাও। ধর্মীয় নেতাদের সাথে বিরোধের মধ্যেই যুবরাজ বিন সালমান ক্ষমতা কমিয়েছেন কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারসের, সীমিত করেছেন ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাও। এর সাথে ইরানি গোয়েন্দাদের বদৌলতে জনসম্মুখে আসে বন্ধুদের নিয়ে যুবরাজ বিন সালমানের মালদ্বীপ সফর, দ্বীপ ভাড়া করে পার্টি করা, বারে নাচা, মডেলদের সাথে সময় কাটানোর খবরও। ইসলাম ধর্মের রীতিবিরুদ্ধ এসব কাজও রাজনৈতিকভাবে মোহাম্মদ বিন সালমানের বিপক্ষে গিয়েছে।

‘দ্য প্রিন্সের’ দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়

দ্য প্রিন্সের দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী ও জাতীয় সৈন্যবাহিনীর গঠন, কার্যাবলি ও পরিচালনার ব্যাপারে। দেশরক্ষার ব্যাপারে ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর সহায়তা নিলে তা রাষ্ট্রনায়কের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। কারণ, ভাড়াটে সৈন্যরা যুদ্ধের ব্যাপারে হয় খুব বেশি পারদর্শী, নয়তো একবারেই আনকোরা যোদ্ধা। এই দুটিই রাষ্ট্রনায়কের জন্য ক্ষতিকর। কারণ আনকোরা যোদ্ধারা রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, আর অতিরিক্ষ দক্ষ যোদ্ধারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও একসময় শাসকের জন্যই হুমকি হয়ে ওঠেন।

ফলে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শাসকের সেনাবাহিনীর উপরই ভরসা করা উচিত, তাদেরকেই গড়ে তোলা উচিত যুদ্ধের উপযোগী করে। এই সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সাধারণত শাসকের হাতেই থাকে, সাধারণতন্ত্রেও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতেই থাকে। আর সবসময়ই সেনাবাহিনী ভাড়াটে সেনাবাহিনীর চেয়ে বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে বেশি সফলতা দেখিয়েছে, নিশ্চিত করেছে নাগরিকদের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব।

সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীর আটটি শাখা রয়েছে, এর মধ্যে পাঁচটি বাহিনী পূর্ণ সামরিক বাহিনী, তিনটি আধা-সামরিক বাহিনী। সৌদির বাদশাহের অধীনে থাকা পূর্ণ-সামরিক বাহিনীর অংশ রয়েল সৌদি ল্যান্ড ফোর্স, রয়েল সৌদি নেভাল ফোর্স, রয়েল সৌদি এয়ার ফোর্স, রয়েল সৌদি এয়ার ডিফেন্স এবং রয়েল সৌদি স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ফোর্স। আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে আছে সৌদি আরাবিয়ান ন্যাশনাল গার্ড, সৌদি রয়েল গার্ড রেজিমেন্ট ও সৌদি আরাবিয়ান বর্ডার গার্ডস।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাফল্য সামান্যই; Image Source: Middle East Eye. 

সৌদি আরাবিয়ান ন্যাশনাল গার্ড প্রায় লক্ষাবিধ সৈন্যের এক বাহিনী, যার সদস্যদের রিক্রুট করা হয় সউদ পরিবারের প্রতি অনুগত বিভিন্ন গোত্র থেকে। এই আধা-সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলে মিনিস্ট্রি অব ন্যাশনাল গার্ডের মাধ্যমে সরাসরি রিপোর্ট করেন বাদশাহর কাছে। এই বাহিনী হাউজ অব সউদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ করে, মক্কা-মদীনার নিরাপত্তার দায়িত্বও এদের হাতে। এর পাশাপাশি এরা রাজপরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজও করে, কাজ করে সামরিক বাহিনীতে যেকোনো ধরনের অভ্যুত্থান প্রতিহত করতে।

১৯১০ সালে গঠিত হওয়া এই বাহিনীর সৌদি আরবের বর্তমান রাজপরিবারের প্রতি আনুগত্যের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও, যেহেতু এই বাহিনীর কাঠামো অন্যান্য বাহিনীর মতো নয়, সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়াও কিছুটা ব্যতিক্রম, সেজন্য এর গঠন আর কাজকে ভাড়াটে সেনাবাহিনীর নিরিখে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই হোয়াইট আর্মি খ্যাত এই বাহিনীর ক্ষমতা কমিয়েছেন, ক্ষমতা কমানোকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন গোষ্ঠীর শেখদের সাথেও। বাস্তবিক রাজনীতির হিসাবে এই কাজগুলো খুব একটা লাভজনক না, কিছু ক্ষেত্রে আত্মঘাতী। তারপরও, ভাড়াটে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় তাত্ত্বিক দিক থেকে একটা প্রশংসা মোহাম্মদ বিন সালমান পেতেই পারেন।

সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ডকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও মোহাম্মদ বিন সালমানের আমলেই তৈরি হয়েছে ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদ বিন সালমানের আগ্রহে তৈরি হওয়া এই বাহিনীর সদস্য আসেন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের সদস্যভুক্ত দেশগুলো থেকে। ৪১ দেশের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এই বাহিনীর কাঠামোকে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির বর্ণিত ‘ভাড়াটে সেনাবাহিনীর’ কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে, সন্ত্রাসবাদ দমনে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, এমন ঘোষণা আসলেও, অনেকেই এই বাহিনীকে ব্যাখ্যা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের প্রভাবকে সুসংহত করতে চাওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে। অর্থাৎ, জাতীয় নিরাপত্তা, ইরানকে মোকাবেলা করে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের মতো বিষয়গুলোতে সৌদি আরবের রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ বিন সালমান ভরসা করছেন একটি প্রায় ‘ভাড়াটে সেনাবাহিনীর’ উপর। নিশ্চিতভাবেই, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এই বাহিনী তৈরিও মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য ইতিবাচক হবে না।

ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশন দিয়ে নাচলিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন মোহাম্মদ বিন সালমান; Image Source: Gulg News. 

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কখন একজন শাসক প্রশংসিত হন? রাষ্ট্রনায়কের কৃপণ হওয়া ভাল নাকি রাষ্ট্রনায়ক হবেন উড়নচণ্ডী? রাষ্ট্রনায়ক দয়ালু হবেন, নাকি কঠোর হবেন? ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন কীভাবে ব্যাখ্যা করে এই চিরায়ত দ্বন্দ্বগুলো? ম্যাকিয়াভেলির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার দিয়ে কতটুকু ব্যাখ্যা করা যায় মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতিকে? তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি আভাস দেয় ম্যাকিয়াভেলির দর্শন? এই আলোচনাগুলো হবে তৃতীয় ও শেষ পর্বে।

This article is written in Bangla about the political future of Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman, in the light of  Niccolo Machiavellie's 'The Prince'. (Part-two). 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: Middle East Eye. 

Related Articles