Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীন ও রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় মঙ্গোলিয়ার কৌশল

এশিয়া মহাদেশের পূর্বদিকে অবস্থিত মঙ্গোলিয়া আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। জাতিগতভাবে মোঙ্গলদের দ্বারা অধ্যুষিত প্রায় ১৫,৬৪,১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রটির উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণে চীন অবস্থিত। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, মঙ্গোলিয়ার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র দুজন, যা বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খানের প্রতিকৃতি; চিত্রসূত্র: Shutterstock

ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে বর্তমান মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণচারণ ভূমি বিভিন্ন যাযাবর গোত্রের মধ্যে বিভক্ত ছিল। এরপর ১২০৬ সালের দিকে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে যাযাবর গোত্রগুলো সংগঠিত হয়ে ‘মঙ্গোল সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করে, এবং একসময় এটি ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়ে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অবিচ্ছিন্ন স্থল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এই সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং ১৬৩৬ সালের দিকে চীনের চিং সাম্রাজ্যের আক্রমণে মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যদুস্ত হয়। ১৯১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বর্তমান মঙ্গোলিয়া অঞ্চল চিং সাম্রাজ্যের নিকট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এরপর ১৯২১ সালে মার্চে দেশটিতে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মির সমর্থনে ‘মঙ্গোলীয় বিপ্লব’ সংগঠিত হয়। এই বিপ্লবের ফলে মঙ্গোলিয়া একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’-তে পরিণত হয়, এবং দেশটি কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

বৈশ্বিক মানচিত্রে মঙ্গোলিয়ার অবস্থান; চিত্রসূত্র: Worldometer

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বিশ্বের তিন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন কৃষ্ণসাগরের তীরে সোভিয়েত রিসোর্টের শহর ইয়াল্টায় আলোচনায় অংশ নেন। ইয়াল্টা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গোলিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব বজায় ছিল। ১৯৪৫ সালের ২০ অক্টোবর মঙ্গোলিয়াতে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গণভোটে প্রায় শতভাগ ভোটার দেশটির স্বাধীনতার পক্ষে ভোট প্রদান করেন। এই ফলাফলের পর চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৪৯ সালের ১৬ অক্টোবর চীন এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

১৯৯০ সালে মঙ্গোলিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়; চিত্রসূত্র: Richard Ellis

১৯৬৩ সালের ১৫ জুলাই মঙ্গোলিয়ান পিপলস রেভ্যলুশনারি পার্টির কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরো কমিটি স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত সম্মিলিত প্রতিরক্ষা জোট ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’–এর সদস্য হওয়ার জন্য একটি রেজল্যুশন পাস করে; যদিও পরবর্তীতে দেশটিকে ওয়ারশ প্যাক্টের পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা লিওনার্ড ব্রেজনেভ মঙ্গোলিয়ার উলানবাটার সফর করেন। সেই সফরে দেশ দুটোর মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালের মাঝে মঙ্গোলিয়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ১৯৭৩-৮১ সালের মধ্যে চীনের সাথে মঙ্গোলিয়ার কূটনীতিক সম্পর্কে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এই সময় মঙ্গোলিয়া চীনের বিরুদ্ধে ‘সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ড’ পরিচালনার অভিযোগ তুলে দেশটি থেকে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য চীনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুলাই ভ্লাদিভস্টক শহরে দেয়া ভাষণে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ মঙ্গোলিয়া থেকে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, এবং ১৯৯২ সালের মাঝে মঙ্গোলিয়া থেকে দেশটির সেনা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯০ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙনের পরস্থিতি তৈরি হলে মঙ্গোলিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে গণআন্দোলন শুরু হয়। তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলন একটি সফল বিপ্লবে পরিণত হয়, এবং মঙ্গোলিয়াতে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালের জুনে দেশটির পার্লামেন্ট ‘থুরাল’-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং ১৯৯২ সালের ১৩ জানুয়ারি দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।

ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যস্থলে অবস্থিত মঙ্গোলিয়া এই দুটো ঐতিহাসিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির মধ্যকার একটি ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সাধারণত, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রসমূহের মাঝে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। একটি বাফার রাষ্ট্র এর অস্তিত্ব টিকে রাখতে বিভিন্ন কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করে:

(১) কোনো বাফার রাষ্ট্র পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অধিকতর নিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে;

(২) একটি বাফার রাষ্ট্র পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি পরাশক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারে;

(৩) সেই বাফার রাষ্ট্র তৃতীয় কোনো পক্ষের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে পারে।

স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাফার রাষ্ট্র মঙ্গোলিয়া রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনীতিক সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়ার নেতারা অংশগ্রহণ করেন; চিত্রসূত্র: Russian Presidential Press and Information Office

বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান মঙ্গোলিয়ার জন্য একইসাথে সম্ভাবনা এবং আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০২ সালের ৫ নভেম্বর চীনের অধিকৃত তিব্বতের নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা মঙ্গোলিয়া সফরে পৌঁছালে চীন দেশটির এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বহুল আলোচিত চীনের উদ্যোগে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় একটি প্রকল্প চীন থেকে মঙ্গোলিয়া এবং রাশিয়া হয়ে পূর্ব ইউরোপকে যুক্ত করবে। এর ফলে মঙ্গোলিয়ার খনিজসম্পদ রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টির সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। বর্তমানে চীন দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এবং মঙ্গোলিয়ার রপ্তানি খাতের শতকরা প্রায় আশি ভাগ চীনের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, রাশিয়া মঙ্গোলিয়ার সাথে দেশটির অর্থনৈতিক বন্ধন পুনরায় শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছে। মঙ্গোলিয়াতে সরবরাহকৃত জ্বালানি তেলের শতকরা প্রায় আশি ভাগ রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়, এবং দেশ দুটোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ১৯৫৫ সালের মধ্যে মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে চীন এবং রাশিয়াকে সংযুক্ত করে ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে মঙ্গোলিয়ার শান্তিরক্ষীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; চিত্রসূত্র: Amanda Voisard/UN Photo

১৯৯২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া মঙ্গোলিয়ার বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দেশটি জাতীয় নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রেখে চলেছে। একইসাথে, দেশটি রাশিয়া ও চীনের সাথে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। এছাড়াও, মঙ্গোলিয়া জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যহত রেখেছে। ১৯৬১ সালের ২৭ অক্টোবর মঙ্গোলিয়া জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করে এবং দেশটি ২০০২ সালে সর্বপ্রথম জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। সেই বছর দেশটি জাতিসংঘ মিশনের অধীনে পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে সামরিক পর্যবেক্ষক প্রেরণ করে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, এবং ইতোমধ্যে দেশটির বিশ হাজারেরও বেশি সংখ্যক সামরিক বাহিনীর সদস্য এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন। জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫২টি রাষ্ট্রের সাথে মঙ্গোলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে পারলে মঙ্গোলিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাশিয়া এবং চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং অন্যান্য দেশে সম্প্রসারিত হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব রুখতে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বৈরিতা দূরে ঠেলে রাশিয়া এবং চীন একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। যদি রাশিয়া এবং চীনের এই সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে থাকে, সেক্ষেত্রে বাফার রাষ্ট্র হিসেবে মঙ্গোলিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে পারে।

Related Articles