ঝেলুম নদীর তীরের এক সবুজ উপত্যকা, যেখান থেকে দাঁড়িয়ে বুক ভরে দেখা যায় ভেসে থাকা নীল মেঘ, কিংবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চিনার গাছ, হিমালয়ের কোলে সুসজ্জিত এক রাজকন্যা কাশ্মীর। এই রাজকন্যার গায়ে প্রতিদিন এসে ভোরের আলো পড়ে তবে রাতের অবসান হয় না, কখনো পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর গাড়ির ‘সাইরেন’, কখনো ‘কর্ডন এন্ড সার্চ’, কখনো ‘কারফিউ’, কখনো ‘আজাদীর মিছিল নামে রাস্তায়’। বছরের পর বছর ধরে নিয়ম করেই কাশ্মীরের ডাল লেকের পাড়ে ভেসে উঠে লাশ। প্রতিদিন কাশ্মীরে ‘আজাদী’র স্লোগানে কেঁপে উঠে আকাশ, স্লোগানের সাথে পাল্লা দিয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় মৃত্যুর মিছিল। প্রতিটি কদমে উৎ পেতে থাকে মৃত্যু আর আতঙ্ক। প্রিয়জন হারানোর শোকে কাশ্মীরের বাতাস হয়ে উঠেছে ভারী।
গত এক দশকে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরে যুক্ত হয়েছে এক নতুন আতঙ্ক, ‘প্যালেট বন্দুক’। এই বন্দুকের আঘাতে মৃত্যু না হলেও তীব্র যন্ত্রণা আর পঙ্গুত্ব নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে কাশ্মীরীদের।
‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’ হয়ে উঠলো কেন?
পৃথিবীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্বর্গের একটি ঝেলুম-নীলুম উপত্যকার জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তবে সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই এলাকার প্রতি ইঞ্চি মাটির আছে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। কাশ্মীরের সীমান্তে একদিকে ভারত অন্যদিকে পাকিস্তান, আছে চীনের নজরও।
তবে এই উপত্যকার মানুষ দীর্ঘদিন থেকেই স্বাধীনতা চেয়ে আসছে, তারা চায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। ভারত-পাকিস্তান কিংবা চীন কারো সাথেই যুক্ত হতে চায়নি কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ। তাই কাশ্মীরের ইতিহাসের বয়ান আর স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট আলোচনার সবচেয়ে কঠিন কাজ এর ইতিহাসের পাঠ আমরা শুরু করছি কোন সময় থেকে এবং কোন বিষয়কে মাথায় রেখে।
কাশ্মীরের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় সম্রাট অশোকের আমলে শ্রীনগরের বিকাশ ঘটেছিল। ভারতের মূল সমতল ভূখণ্ড থেকে আলাদা এই কাশ্মীর উপত্যকা। চোখের দেখায় মনোরম এই উপত্যকা কিন্তু জীবনযাত্রার জন্য কঠিন ছিল আদিকাল থেকেই। অশোকের সময়ে এই উপত্যকায় বিস্তার লাভ করেছে বৌদ্ধধর্ম। কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাওয়া যায়, লাদাখে এখনো পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। কুষাণদের সময়েও বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ অব্যাহত থাকে। কুষাণদের পর হুণদের আমল পেরিয়ে কাশ্মীর আসে কার্কোট রাজন্যদের কাছে। কাশ্মীরে হিন্দু ধর্ম রাজ-আনুকূল্য পায় কার্কোটদের সময়ে। এরপরে অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য কাশ্মীরে হিন্দুধর্মের প্রচার করেন। এরপরে কাশ্মীরে অনেক উত্থান পতনের মাঝ দিয়ে গেছে, সিংহাসনের লড়াই, কাশ্মীরকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে অনেকেই শাসন শুরু করেন।
১৩৩৯ সালে কাশ্মীরের একাংশ দখল করে শাহ মির্জা লোহার রাজবংশের সূচনা করেন, কাশ্মীরের সাথে সোয়াত উপত্যকা, আফগানিস্তান, পারস্যের সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। কাশ্মীরে পশুপালন, সেই পশুর চামড়া আর পশমে নির্মিত পোশাক, কার্পেট, শাল, দস্তরখান, জায়নামাজের ব্যবসায়িক মূল্য বাড়তে থাকে পাঞ্জাব পাঠান ছাড়িয়ে পারস্যে।
আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভালো পশুচারণ ভূমির খোঁজে গ্রীষ্মকালে দলে দলে যাযাবরের জাতির আগমন হয়েছে শাহ মির্জার আমলে। গ্রীষ্মে পশুপালন আর বাণিজ্য, হিমালয়ের তীব্র শীতে ঘরে বন্দী হয়ে কাঠের কাজ আর সূক্ষ্ম শাল বুনন কাশ্মীরকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ।
সম্রাট আকবরের সময়ে মুঘল শাসনের অধীনে আসে কাশ্মীর, ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার প্রসার শুরু হয় এখানে। মুঘল থেকে কাশ্মীর যায় আফগানদের হাতে, সেখান থেকে শিখদের হাতে। ১৮৪৬ এ ব্রিটিশদের কাছে হেরে যাওয়ায় শিখদের কাছ থেকে কাশ্মীর চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। জটিল ভূপ্রকৃতি আর রাজস্ব আহরণে সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে ব্রিটিশরা ডোগরা রাজ গুলাব সিংয়ের কাছে এককালীন করের বিনিময়ে হস্তান্তর করে দেয়। গুলাব সিং এর পর বংশানুক্রমে রণবীর সিং, প্রতাপ সিং এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। ভারতের স্বাধীনতার আগেই কাশ্মীরে রাজতন্ত্রের পতন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন চলছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময়ে স্বশাসিত রাজ্যগুলোকে ভারত-পাকিস্তানে যোগ দেওয়া কিংবা নিজের মতো স্বাধীন থাকার পছন্দ দেওয়া হয়। কাশ্মীর স্বাধীন থাকতেই চেয়েছিল, কিন্তু ভারত আর পাকিস্তানের মতো দুই শত্রু ভাবাপন্ন দেশের থাবার মুখে বসে স্বাধীন থাকা ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠে কাশ্মীরের জন্য। একদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য, অন্যদিকে হিন্দু শাসক আর সবাইকে ছাড়িয়ে পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাতাসে রক্তের গন্ধ ভেসে আসছে কাশ্মীরে।
তাই কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীনতার পরেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেলো ভারত-পাকিস্তান। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি রেখা ধরে কাশ্মীর ভাগ হয়ে গেলো দুই দেশের মাঝে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর। কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মাঝে সমস্যা বাড়তেই থাকে। জাতীয়তাবাদের উষ্ণ হাওয়া লাগিয়ে দুই দেশই সমস্যাকে জাগিয়ে রেখেছে, ক্ষমতায় বদল হয়েছে, নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে, কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্বের সমাধান করেনি কেউ। তাই কাশ্মীরে আজও বয়ে চলছে রক্ত।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত সরকার সেনা তৎপরতা জোরদার করেছে, কাশ্মীরের এই অংশকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে বেড়েছে সামরিক স্থাপনা। স্বাধীনতাকামীদেরকে দমন করতে চলেছে দফায় দফায় অভিযান। এই অভিযানে কাশ্মীরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে অস্থিরতা বেড়েছে, অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা পুরো জম্মু-কাশ্মীরের বাতাসজুড়ে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের কান্না
১৯৯০ সালের ৫ জুলাই থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু এবং কাশ্মীরে চালু আছে ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস এক্ট (AFSPA)’ বা সংক্ষেপে যেটি ‘আফস্পা’ নামেও পরিচিত। এই আইনের ক্ষমতাবলেই জম্মু আর কাশ্মীরে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুরো এলাকার যেকোনো জায়গায় অপারেশন চালাতে পারে, গ্রেফতার কিংবা প্রয়োজনে গুলিও করতে পারে। বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তো বটেই ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজ নানা সময় এই আইনের বৈধতা এবং যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই আইনের অপব্যবহার জম্মু-কাশ্মীরে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে তাদের মতামত। কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবী করে আসা সংগঠনগুলোকে দমন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, নিখোঁজ হয়ে গেছেন আর অনেকেই হয়েছেন পঙ্গু।
তবে আন্তর্জাতিক আর দেশীয় বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখেও ভারতীয় প্রশাসনের কাশ্মীর নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি খুব একটা, বলতে গেলে ভারত এই সমালোচনায় খুব একটা ভ্রুক্ষেপই করেনি কোনোকালে, প্রতিদিন নতুন নতুন অস্ত্রের মহড়া চলেছে জম্মু আর কাশ্মীরের আজাদীর মিছিলে।
এমনই এক অস্ত্র হলো ‘প্যালেট গান’। ২০১০ সালে কাশ্মীরের আজাদীর আন্দোলন নতুন রূপ নিয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠে ঝেলুম উপত্যকা, স্বাধীনতাকামী গ্রুপ যাদের ভারতীয় সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে তাদের কার্যক্রমও বেড়ে যায় পাল্লা দিয়ে। কারফিউ আর লকডাউন ভেঙ্গে মানুষের রাস্তায় নামা নিয়ন্ত্রণ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলিতেই মৃত্যুবরণ করেন ১১২ জন প্রতিবাদকারী।
প্রাণহানির হিসাব যদি ১৯৯০ থেকে শুরু করতে হয় তা আরো ভয়াবহ আকার দাঁড়ায়। শুধু ভারতীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী চল্লিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই সময়ে আর স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি তথ্যের বেসরকারি হিসেবে তা দাঁড়িয়েছে পঁচানব্বই হাজারে।
নন-লিথাল ওয়েপন?
২০১০ সালে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় ক্ষমতার গদিতে থাকা কংগ্রেস সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বেসামরিক মানুষ যারা শুধুই তাদের দাবী আর আন্দোলন জানাতে রাস্তায় নামে তাদের লাশের মিছিল ঠেকাতে তাই কংগ্রেস সরকার অনুমোদন দেয় নতুন একটি ‘নন-লিথাল ওয়েপন’ যার নাম ‘প্যালেট বন্দুক’।
‘নন-লিথাল ওয়েপন’ এর বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রাণ সংহারি নয় এমন অস্ত্র’। এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয় জনসমাবেশ কিংবা মিছিল বানচাল করতে। টিয়ার গ্যাস, জল-কামান, পেপার-স্প্রে, উচ্চ শব্দ তৈরিতে সক্ষম যন্ত্র সারাবিশ্বেই জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলার রক্ষার প্রশাসন ব্যবহার করে থাকে।
তবে কাশ্মীরে ব্যবহারের জন্য অনুমতি পাওয়া ‘প্যালেট বন্দুক’ বিশেষ করে পাখি-বন্যপ্রাণী শিকারে কিংবা ক্ষতিকর পতঙ্গ দমনে ব্যবহার করা হয়। মানুষের উপর এই অস্ত্র প্রয়োগের নিদর্শন খুবই কম। কারণ এই বন্দুককে যতটা ‘নন-লিথাল’ বলে প্রচার করা হয়েছে ততটা নয়, মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে পঙ্গু, অন্ধ কিংবা অক্ষম করে দিতে পারে এই বন্দুকের আঘাত।
প্যালেট বন্দুক মূলত একটি ‘পাম্প-একশন শটগান’ ধরনের বন্দুক। এ ধরনের বন্দুকে সাধারণ গুলির পরিবর্তে প্রতিটি গুলির (কার্টরিজ) ভেতরে অসংখ্য সীসা-তামা কিংবা অন্যান্য ধাতব পাত থাকে। এই ধাতব পাত গোলাকার কিংবা অনিয়মিত হতে পারে। বন্দুকের গোলার ভেতরে পাঁচশত ছোট ধাতব পাতের কারণেই একে বলা হয় ‘প্যালেট বন্দুক’।
পাম্প-একশন শটগান থেকে গুলিটি ছুড়ার সাথে সাথে দ্রুতবেগে ধাতব প্যালেট ছড়িয়ে পড়ে। যাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে মারাত্মকভাবে আহত করতে পারে এই ধাতব প্যালেট। বিশেষ করে মাথায় কিংবা চোখে ছোট এই ধাতব ঢুঁকে গেলে তা সরানো বেশ মুশকিল। চোখে ঢুঁকে গেল এই ধাতব প্যালেট স্থায়ী অন্ধত্বের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই বন্দুক থেকে ছোড়া প্যালেটের আঘাতের তালিকায় আছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশু, ঘরে শুয়ে থাকা সত্তর বছরের বৃদ্ধ, রাস্তায় পুলিশের দিকে পাথর ছুড়তে থাকা যুবক কিংবা ঘরের বাইরে নিত্যদিনের কাজ করতে যাওয়া নারী।
এই অস্ত্রের ব্যবহার বিধি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিউর) বলছে, এই অস্ত্র শুধুমাত্র চরম পরিস্থিতিতে পা লক্ষ্য করে ব্যবহার করতে হবে। তবে এই বন্দুকের আঘাতে আহত মানুষদের নব্বই শতাংশের আঘাত কোমরের উপরে। 'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' সহ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই অস্ত্রের নিষিদ্ধের দাবী জানিয়ে আসছে। তবে এই অস্ত্রের মূল প্রয়োগকারী ভারতের ‘সেন্ট্রাল রিসার্ভ পুলিশ ফোর্স’ বলছে এই বন্দুকে ব্যবহার করা কার্টরিজ নন-লিথাল এবং খুব কম ক্ষতিকর।
প্যালেট বন্দুক: কাশ্মীরের নীরব কান্না
প্যালেট বন্দুকের আঘাতে আহতদের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন, বিশেষ করে প্যালেট চোখে আঘাত করলে তা মানুষকে অন্ধ করে দিতে সক্ষম। কাশ্মীরের বারমোল্লা জেলার ২৬ বছরের প্রাণবন্ত যুবক আহমেদ কবির বেগ, প্যালেট বন্দুকের আঘাতে হারিয়েছেন চোখের আলো। সারা ভারতের বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়িয়েছেন, খুব একটা লাভ হয়নি।
কাশ্মীর জুড়ে খুঁজে বেড়ালে পাওয়া যাবে শয়ে শয়ে আহমেদ কবির বেগ, কেউ টাকা পয়সা দিয়ে চিকিৎসা করাতে পেরেছেন, কেউ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে পা বাড়াচ্ছেন। সরকারি সাহায্য কিংবা কার কাছে অভিযোগ জানাবেন তাও জানা নেই হতভাগ্যদের।
শ্রীনগরের বাসিন্দা দানিশ রাজিব ঝাট, চব্বিশ বছরের তরুণ। তার বাম চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা প্যালেট বন্দুক। বাধ্য হয়ে ডাক্তাররা বাম চোখে একটি 'কৃত্রিম অক্ষিগোলক' (artificial eyeball) লাগিয়ে দিয়েছেন, যা দিয়েও তার দৃষ্টি ফেরেনি। এখনো দানিশ নিজের শরীরের ভিতরে বয়ে বেড়াচ্ছেন নব্বইটির মতো প্যালেট, যেগুলো অপসারণ ডাক্তারদের জন্য ভীষণ কঠিন।
২০১৬ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় নেতা 'বুরহান ওয়ানি'র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে। ভারতীয় সরকারের সব অনুশাসন অমান্য করে কাশ্মীরের জনগণ রাস্তায় নামে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্যালেট বন্দুকের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় প্রশাসন। ওয়ানি'র ঘটনার ছয়মাসের মাঝে ছয় হাজার মানুষ এই প্যালেট বন্দুকের আঘাতে আহত হয়, যার মাঝে ৭৮২ জনের চোখে আঘাত করে প্যালেট।
১০ বছরের এক শিশু আসিফ আহমেদ শেখ। প্যালেটের আঘাতের কারণে তার সামনের পুরো জীবনটাই অন্ধকার। ডান চোখে আঘাত করা প্যালেটের কারণে ডান চোখে কিছুই দেখতে পায় না আসিফ।
আঠারো বছরের যুবক সাহিল হামিদ, বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট খেলছিলেন মাঠে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কনভয় পাড় হচ্ছিলো তার মাঠের কাছ দিয়ে। হামিদ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, কোনোরূপ সতর্কবার্তা না দিয়ে তার দিকে ছোড়া হয় প্যালেট বন্দুকের গোলা। কাশ্মীর উপত্যকায় প্রতিটি দিনই দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারে, সাহিলের মতোই হাসতে খেলতে থাকা কোনো একটি যুবকের জীবন নষ্ট হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়াতে পারে, একটি পরিবার এসে দাঁড়াতে পারে খাঁদের কিনারায়।
কাশ্মীরের মানুষ বিশ্বাস করে, এই দুঃস্বপ্নের একদিন শেষ হবে, একদিন ভোরে জেগে উঠে বাইরে গিয়ে তাদের আর বন্দুকের গুলি খেয়ে পঙ্গু হতে হবে না। কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্য, এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কিংবা অর্থনীতি সবই মূল্যহীন হয়ে যায় যখন এই এলাকার বাসিন্দারা ঘরের বাইরে এসে নতুন ভর দেখতে পারেন না। 'আজাদী' শ্লোগানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কাশ্মীর উপত্যকায় স্বাধীনতার আশা হয়ে উঠে তীব্রতর।
প্যালেট বন্দুক কাউকে অন্ধ করে দিচ্ছে, কাউকে পঙ্গু করে দিচ্ছে কারো বেঁচে থাকার সব আশা কেড়ে নিচ্ছে। একটি প্রজন্মের জীবনীশক্তি নিংড়ে নিচ্ছে ভয়ানক এই অস্ত্র। কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যপদের কর্মকাণ্ডের বিচার সাধারণ আদালত করতে পারে না যতক্ষণ না ভারত সরকার এই বিচারের অনুমোদন দিচ্ছে (Armed Forces (Jammu and Kashmir) Special Powers Act-Section 7)। তাই প্যালেট বন্দুক-পুলিশি নির্যাতনের মূলে থাকা এই আইন ক্ষমতা বাতিল দাবী করে আসছেন কাশ্মীরের বাসিন্দারা।
This article is about pellet gun a weapon used in Jammu and Kashir (Indian administered Kashmir). This weapon is decleared as non-lethal weapon, but it takes a hevay toll in Kashmiri population.
Featured Image source: Camillo Pasquarelli/Time