Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক চরিত্র

মানবসমাজ বৈচিত্র্যপূর্ণ। মানুষে মানুষে শিক্ষা, সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বৈচিত্র্য তৈরি হয়, বৈচিত্র্য তৈরি হয় গোষ্ঠীগত পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করেও। আবার, জাতিগত পরিচয়, লিঙ্গ, ভাষা, রাজনৈতিক আদর্শ, সামাজিক মূল্যবোধ, সক্ষমতা বা অক্ষমতাও মানুষে মানুষে বৈচিত্র্য তৈরি করে, ভিন্ন মানুষকে তৈরি করে ভিন্ন রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে।

এর বাইরে, মানুষের বয়স, জাতিরাষ্ট্রের যুগে জাতীয়তা, বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা, জন্মস্থানের পরিচয়ের ধারণাগুলো মানুষের রাজনৈতিক আচরণগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে, রাজনৈতিক পরিবেশকে করে তুলেছে জটিল। জাতিরাষ্ট্রের যুগে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে তারাই।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি কারা?

রাজনীতিতে সামাজিক শ্রেণিগুলোর নির্ণায়ক ভূমিকা রয়েছে, ভূমিকা রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবাহ নির্ধারণে। সুদূর অতীত থেকেই, রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব রাষ্ট্রচিন্তকদের আলোচনাতে এসেছে। প্রাচীন গ্রিসের ধ্রুপদী রাষ্ট্রচিন্তকেরা রাজনীতিতে সকল ক্লাসের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কাঠামো বলেছেন।

রাজনীতির মূল প্রভাব হিসেবে কাজ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি; Image Source: Journal of Political Inquiry. 

বর্তমানে শ্রেণি নির্ধারণের জন্য দুটি প্রধান মতের উপস্থিতি রয়েছে। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে দুটি অর্থনৈতিক শ্রেণি রয়েছে; প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়া। এর বাইরে সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে শ্রেণি নির্ধারণের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্ধারণের জন্য বেশ কিছু মানদণ্ড ব্যবহার করা যায়। এগুলো আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক অবস্থান বুঝতে সাহায্য করবে, রাজনৈতিক স্বার্থগুলোকে আলোকপাত করা সহজ করবে, রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।

প্রথমত, মধ্যবিত্ত শ্রেণি সাধারণত তাদের ব্যক্তিগত আয়ের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে। কিন্তু, ঠিক কতটুকু আয় করলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ হওয়া যাবে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে স্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের একটা অংশ অর্থনৈতিক পিরামিডের সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকা ২০ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক পিরামিডের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা ২০ শতাংশকে বাদ দিয়ে বাকি ৬০ শতাংশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর ১০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের কম, ৫১ শতাংশ মানুষ ২ থেকে ১০ ডলার আয় করেন, ১৭ শতাংশ মানুষ আয় করেন ১০ থেকে ২০ ডলারের মধ্যে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ২০ ডলারের বেশি, তার একটি ক্ষুদ্র অংশের দৈনিক আয় ৫০ ডলারের বেশি।

অর্থনীতি সচল রাখার কাজ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই; Image Source: BloombergQuint. 

সাধারণভাবে, দৈনিক ১০-২০ ডলার আয় করা মানুষদের প্রকৃত মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, দৈনিক ২-১০ ডলার আয় করা মানুষদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাদের সামনে বাস্তবিক সম্ভাবনা থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণের।

দ্বিতীয়ত, সম্পদের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিহ্নিত করা যেতে পারে। অনেক মানুষের দৈনিক আয় হয়তো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের মতো না হতে পারে, কিন্তু তাদের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ভূসম্পত্তির মালিকানা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে, সম্পদের মালিকানার উপর ভিত্তি করে অনেক বিশ্লেষকই মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরেছেন। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড ওলফ অর্থনৈতিক পিরামিডের মধ্যে থাকা দুই-তৃতীয়াংশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তৃতীয়ত, শিক্ষা সামাজিক অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে, ভূমিকা রাখে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্ধারণে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। সাধারণত, শিক্ষার সাথে মানুষের বিচার, বিবেচনাবোধের পরিবর্তন আসে, অর্জিত হয় জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন দক্ষতা। এই প্রভাবকগুলো শিক্ষিত সমাজের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে, সুশীল সমাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

শিক্ষা সামাজিক শ্রেণি নির্ধারণ করে দেয়; Image Source: UC Berkeley.

চতুর্থত, শিক্ষার মতো পেশাও সামাজিক অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সাধারণত, প্রতিটি রাষ্ট্রেই নিরাপত্তার সাথে জড়িত মানুষদের সামাজিকভাবে শ্রদ্ধা করা হয়, রাষ্ট্রের সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা হয়। এ কারণেই, গত শতাব্দীতে রাজতন্ত্র আর উপনিবেশ শাসন সমাপ্তির পরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থানগুলো রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করতে পেরেছে। আবার, আমলাতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রশাসনে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ ব্যাপক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা উপভোগ করেন।

রাজনৈতিক চরিত্র

নগররাষ্ট্র আর সাম্রাজ্যবাদের যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অধিকাংশ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ছিলো রাজতান্ত্রিক, শাসক নির্ধারিত হতো উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা নগর বিজয় করে। রাজতন্ত্রের যুগেও, শাসকদের নাগরিকদের সমর্থন অর্জন করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়েছে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা জারি রাখতে হয়েছে। সমর্থন অর্জনের এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

এই শ্রেণি বাইরের আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শাসকের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে, আবার শাসকের সাথে অভিজ্ঞতা খারাপ হলে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে সহযোগিতা করে পরিবর্তন ঘটিয়েছে শাসকের। ফলে, রাজতন্ত্রে রাজা কতিপয় অভিজাতের স্বার্থরক্ষায় সবসময় সচেষ্ট থাকলেও, মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। জাতিরাষ্ট্রের যুগে শাসক পরিবর্তন প্রক্রিয়া অনেক মসৃণ এবং সহজ হয়েছে, বেড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকা।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নির্ধারণ

যেকোনো রাজনৈতিক কাঠামোর ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিথস্ক্রিয়া নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর। আমন্ড ও ভার্বা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে তিন ভাগে ভাগ করেছন। রাজনৈতিকভাবে অসচেতন ও সহিংসতাপ্রবণ দেশগুলোকে প্যারোকিয়াল পলিটিক্যাল কালচার বা সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সীমিত রাজনৈতিক অধিকার ও  চর্চার সুযোগ থাকা দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সাবজেক্ট পলিটিক্যাল কালচার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যেসব দেশের নাগরিকেরা রাজনৈতিক অধিকারগুলোর ব্যাপারে সামষ্টিকভাবে সচেতন, নাগরিক স্বাধীনতা উপভোগ করেন, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ভোগ করেন, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সুশীল সমাজ কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেগুলোকে তারা চিহ্নিত করেছেন পরিপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নির্ধারণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি; Image Source: CTGC.

ড্যানিয়েল জে. এলজার আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভিন্ন দিক থেকে তিনভাগে ভাগ করেছেন- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক, নৈতিকতাবাদী ও  ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন বা অবনমন নির্ধারিত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক আচরণ দ্বারা, রাজনৈতিক প্রাধান্য দ্বারা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে গুরুত্ব দেন, নাগরিক অধিকারগুলোর জন্য ক্রমাগত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকেন, নাগরিক স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে একটি দেশ গণতান্ত্রিক হবে। আবার, মধ্যবিত্ত শ্রেণি যদি স্বৈরতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদের অধীনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফাঁদে আটকা পড়ে যান, তাহলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান ক্রমাগত কমতে থাকবে, বাড়তে থাকবে সংঘাতের সম্ভাবনা।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ

যেসব দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্যান্য দেশের চেয়ে দ্রুত হয়, দ্রুত বৃদ্ধি পায় নাগরিকদের কর্মদক্ষতা, গড়ে ওঠে বিভিন্ন কাজে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত শ্রেণি। সফট স্কিলের বিকাশ ঘটে দ্রুতগতিতে, তৈরি হয় তুলনামূলভাবে বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তা। নাগরিকদের সঞ্চয় বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে অর্থের প্রবাহ, অর্থনীতির আকার, বাড়ে ক্রয়ক্ষমতাও। দেশের মোট সম্পদের বড় অংশ অতিধনীদের হাতে পুঞ্জীভূত থাকলেও, অর্থনীতির চরিত্র নির্ধারণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ, তারা একইসাথে পণ্যের গ্রাহক এবং প্রাথমিক পণ্যের উৎপাদক।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক বিবেচনা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোকে সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করে; Image Source: TBS

আবার, রাজনীতি রাষ্ট্রের অপরাপর সকল বিষয়ের নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। ফলে, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত করলে তার প্রভাব মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক পছন্দের উপর পরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক পছন্দ অর্থনৈতিক বিবেচনাবোধের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই রাজনৈতিক চরিত্র কাজে লাগিয়ে হাইব্রিড রেজিম প্রতিষ্ঠা করছে, চর্চা করছে অনুদার গণতন্ত্রের। গত শতাব্দীতে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করত, তখনও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থগুলোকে ব্যবহার করতো রেজিমের রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করতে, সামরিক শাসন টিকিয়ে রাখতে।

This article is written in Bangla. It is about the political role of middle class behind differnt political developments. 

All the necessary links are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Quartz. 

Related Articles