Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গেম অফ থ্রোন্সের রাজনৈতিক শিক্ষা

এইচবিওর জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অফ থ্রোনসকে একটি ফ্যান্টাসি সিরিজ হিসেবে উপভোগ করাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। এই সিরিজে আকাশে ড্রাগন ওড়ে, দৈত্যাকার মানুষেরা অবলীলায় সাধারণ মানুষদের সাথে চলাফেরা করে, মৃত মানুষেরা জীবিত হয়ে ওঠে, বহু বছর পরপর আসা শীতকাল টানা কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং হোয়াইট ওয়াকার নামের এক অদ্ভুত জাতি জীবিত মানুষকে ধরে ধরে হোয়াইটে রূপান্তরিত করে।

কিন্তু বাস্তবে এগুলো গেম অফ থ্রোনসের একটা মাত্র দিক। যে জটিল সিংহাসনের খেলা নিয়ে সিরিজটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে, তাতে এটি কোনো অংশে বাস্তব রাজনীতির চেয়ে কম বৈচিত্র্যময় না। এর ফ্যান্টাসি অংশগুলোকে অগ্রাহ্য করলে কিংবা রূপক হিসেবে গ্রহণ করলে সহজেই একে বর্তমান বিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে তুলনা করা সম্ভব।

সেই চেষ্টা অনেকেই করেছেন। কেউ একে তুলনা করেছেন আমেরিকার রাজনীতির সাথে, কেউ তুলনা করছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সাথে, কেউ আবার তুলনা করেছেন প্রাচীন মিসর কি‍ংবা আধুনিক লিবিয়ার রাজনীতির সাথে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো এলাকার রাজনীতির সাথে তুলনা না করতে চাইলেও গেম অফ থ্রোনসের প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই কিছু না কিছু মূল্যবান রাজনৈতিক শিক্ষা আছে।

চলুন জেনে নিই এরকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষা, যা গেম অফ থ্রোনস আমাদেরকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তবে সাবধান, আপনি যদি গেম অফ থ্রোনস না দেখে থাকেন, তবে সামনে আপনার জন্য স্পয়লার আছে!

১. ক্ষমতা অর্জনের চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন

চিরন্তন এ সত্যটি গেম অফ থ্রোনস আমাদেরকে আটটি সিজন জুড়ে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। গেম অফ থ্রোনসের জগতে বিভিন্ন সময় অনেকেই বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতায় বসেছে। কিন্তু যত সহজভাবে তারা রাজ্যের দখল পেয়েছে, তত সহজভাবে সেটা ধরে রাখতে পারেনি।

Image Source: Game of quotes

সবচেয়ে বড় উদাহরণ নিঃসন্দেহে ডেনেরিস টারগারিয়ান। ড্রাগনের কল্যাণে কিংস ল্যান্ডিংয়ের জয়টা তিনি তুলনামূলকভাবে সহজেই পেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য শাসন করার সৌভাগ্য তার হয়নি। যে সিংহাসনের জন্য এত ধ্বংসযজ্ঞ, সেটাতে বসার আগেই তাকে প্রাণ দিতে হয় তারই ভ্রাতুষ্পুত্র এবং প্রেমিকের হাতে।

ডেনেরিসই অবশ্য একমাত্র উদাহরণ না। জন স্নো নিজেও যোগ্যতাবলেই নাইটস ওয়াচের লর্ড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ এক গার্ড থেকে ধীরে ধীরে লর্ড কমান্ডার হওয়াটাও যত সহজ ছিল, লর্ড কমান্ডার হিসেবে একইসাথে সবার মন যুগিয়ে চলা, আবার অন্যদিকে হোয়াইট ওয়াকারদেরকে মোকাবেলা করা ততটা সহজ ছিল না। ফলে তাকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল তারই অনুগত নাইটস ওয়াচদের হাতে।

রাজা রবার্ট ব্যারাথিয়নকে অবশ্য সে হিসেবে তুলনামূলকভাবে সফল বলা যায়। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু যে বীরত্বের সাথে তিনি লড়াই করে টারগারিয়ানদেরকে পরাজিত করেছিলেন, সেরকম বীরত্ব বা সাফল্যের সাথে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতে পারেননি। রাজ্য পরিচালনার চেয়ে তিনি বরং শিকার, মদ্যপান এবং গণিকালয়ে গমনেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তার অকালমৃত্যুর পেছনে এগুলোও পরোক্ষভাবে দায়ী।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

বাস্তব জীবনেও আমরা অহরহ এ ধরনের উদাহরণ দেখতে পাই। এর কারণটাও পরিষ্কার। রাজ্য জয় বা দখল করতে যে ধরনের দক্ষতা বা গুণাবলী লাগে, রাজ্য শাসন করার সময় তা কাজে আসে না। তখন প্রয়োজন হয় ভিন্ন গুণাবলীর এবং ভিন্ন বিষয়ের উপর দক্ষতার। ড্রাগন দিয়ে কিংবা মিসাইল হামলা চালিয়ে দেশ জয় করা যায়, কিন্তু সফলভাবে শাসন করা যায় না। এজন্যই আরব বসন্তের বিপ্লবের ফলে ক্ষমতায় এসেও মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছেন না। আবার অস্ত্রের জোরে আফগানিস্তান দখল করেও আমেরিকাকে এখন পালানোর পথ খুঁজতে হচ্ছে।

২. মিত্রদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে নেই

ক্ষমতায় থাকলে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে। মিত্রদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, কিংবা পূর্বে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। অথচ তারা এটা ভেবে দেখে না যে, নতুন করে কোনো সংকট শুরু হলে এই মিত্ররাই পারবে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করতে, অথবা শত্রুপক্ষের সাথে যোগ দিয়ে তাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে।

গেম অফ থ্রোনসে অনেকেই এই শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু স্টার্ক পরিবারের মতো মূল্য কাউকে দিতে হয়নি। রব স্টার্ক যখন যুদ্ধে যাচ্ছিলেন, তখন তার সম্ভাব্য প্রতিটি মিত্রের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই তার মা ক্যাটলিন স্টার্ক জেইমি ল্যানিস্টারকে মুক্ত করে দিয়ে একসময়ের শক্তিশালী মিত্র হাউজ কার্স্টার্কের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

অন্যদিকে রব স্টার্ক নিজেও ওয়াল্ডার ফ্রের কন্যাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তালিসা মাইগারকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এবং যুদ্ধে জেতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাউজ ফ্রের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলাফলই ছিল সেই কুখ্যাত রেড ওয়েডিং হত্যাকাণ্ড, যার মাধ্যমে তাকে এবং তার পুরো পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।

মূল্য দিতে হয়েছিল জন স্নোকেও। তিনি সবার ভালোর জন্যই ওয়াইল্ডলিংদেরকে ওয়ালের দক্ষিণে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার নাইটস ওয়াচের সঙ্গীরা এটাকে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে একের পর এক ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে তারা।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

বিশ্ব রাজনীতিতেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। আফ্রিকার দরিদ্র কিছু রাষ্ট্র ছাড়া গাদ্দাফীর সেই অর্থে কোনো মিত্র ছিল না। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি পরাশক্তির সাথেই তার সম্পর্ক খারাপ ছিল। সেজন্য ২০১১ সালে তার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি একসময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, এরকম লিবিয়ান সামরিক কর্মকর্তারাও সে সময় তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য লিবিয়াতে ফিরে এসেছিল।

অন্যদিকে আরব বসন্তের বিশৃঙ্খলা থেকে যারা বেঁচে গেছে, তারা মূলত তাদের শক্তিশালী মিত্রদের কারণেই রক্ষা পেয়েছে। সিরিয়াকে রক্ষা করেছে রাশিয়া এবং ইরান। বাহরাইনকে রক্ষা করেছে সৌদি আরব। এমনকি যে আল-জাজিরা প্রতিটি দেশের আন্দোলন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা প্রচার করছিল, তারাও বাহরাইনের আন্দোলন প্রথম কয়েকদিন প্রচার করেনি, যেহেতু বাহরাইন কাতারের মতোই গালফ কর্পোরেশন কাউন্সিলের সদস্য ছিল।

৩. অধিকাংশ মানুষের চরিত্রই ভালো-মন্দের মিশ্রণে গঠিত

রূপকথার গল্পে বা সুপারহিরো কমিক্স জগতেই কেবল সকল প্রকার দোষত্রুটি থেকে মুক্ত শুদ্ধতম নায়ক এবং তার বিপরীতে সকল দোষে দুষ্ট খলনায়কের দেখা পাওয়া যায়। অধিকাংশ চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকেও প্রধান চরিত্রগুলোকে এভাবেই সরলীকরণ করা হয়। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার চরিত্রগুলো অনেক বেশি জটিল। এখানে ভালো মানুষের মধ্যেও অনেক খারাপ দোষ থাকে, আবার খারাপ মানুষের মধ্যেও অনেক ভালো গুণ থাকে।

গেম অফ থ্রোনসের জফ্রি ব্যারাথিওন এবং রামসি বোল্টনের মধ্যে হয়তো কোনো গুণ খুঁজে বের করা কঠিন হবে। কিন্তু এরা নিতান্তই ব্যতিক্রম। এদের বাইরে এখানের অধিকাংশ চরিত্রই বাস্তব দুনিয়ার মানুষদের মতো অত্যন্ত জটিল। স্যান্ডর ক্লিগেন তথা হাউন্ড রুক্ষ স্বভাবের একটি চরিত্র। সে ঠাণ্ডা মাথায় আরিয়ার বন্ধুকে খুন করে। কিন্তু সে-ই আবার লোরাস টাইরেলের জীবন বাঁচায়, সানসাকে রক্ষা করে, আরিয়াকে সাহায্য করে।  

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

বিপরীত দিকে আরিয়া সবার প্রিয় চরিত্র। কিন্তু হাউন্ডের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার পরেও সে তাকে ধীর, কষ্টদায়ক মৃত্যুের মুখে ফেলে চলে যায়। জন স্নো অত্যন্ত সৎ, কর্তব্যপরায়ণ। কিন্তু ডেনেরিস স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে, গণহত্যা চালাতে যাচ্ছে বুঝতে পেরেও তিনি তাকে বাধা না দিয়ে সেই হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। ডেনেরিস মমতাময়ী মা, ব্রেকার অফ চেইন্স, কিন্তু তিনিও উন্মাদ হয়ে ওঠার আগেই ঠাণ্ডা মাথায় স্যামুয়েল টার্লির বাবা ও ভাইকে পুড়িয়ে হত্যা করেন।

গেম অফ থ্রোনসের আরো জটিল কয়েকটি চরিত্র হলো জেইমি ল্যানিস্টার, স্ট্যানিস ব্যারাথিয়ন এবং থিওন গ্রেজয়। জেইমি ব্র্যানকে হত্যা করতে চেয়েছিল, নেড স্টার্কের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সে-ই আবার ব্রিয়েন অফ টার্থকে রক্ষা করেছিল, নাইট কিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উইন্টারফেলে ছুটে এসেছিল। কিন্তু শেষে আবার সে ব্রিয়েনকে পরিত্যাগ করে সার্সির কাছেই ছুটে গিয়েছিল।

অন্যদিকে থিয়ন সারা জীবন স্টার্কদের ভালোবাসা পেয়েও তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কিন্তু পরে সে-ই আবার হোয়াইট ওয়াকারদের হাত থেকে  ব্র্যানকে রক্ষা করেছিল। স্ট্যানিস ব্যারাথিয়ন একদিকে জনকে বাঁচিয়েছিল, কিন্তু অন্যদিকে নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। এখন জেইমি, স্ট্যানিস বা থিয়ন সম্পর্কে কেউ যদি এককথায় বলে যে, তারা ভালো বা খারাপ, তাহলে সেটা তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

বাস্তব জীবনেও যারা সিংহাসনের খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাদেরকে এককথায় ভালো বা মন্দ উপাধি দেয়াটা কঠিন। সময়ের প্রয়োজনে তারা অনেক সময় অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক অন্যায় করে, কিন্তু পরবর্তীতে আবার সেখান থেকে ফিরেও আসে। নির্বাচনে দু’টি দল দাঁড়ালে এক দলকে সবদিক থেকে ভালো, অন্য দলকে সবদিক থেকে খারাপ বলে প্রচার করাটা তাই অধিকাংশ সময়ই পক্ষপাতমূলক অবস্থান হয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আমেরিকা খারাপ, রাশিয়া ভালো, অথবা রাশিয়া খারাপ, তুরস্ক ভালো- এরকম সিদ্ধান্ত বেশি সরলীকরণ হয়ে যায়। গাদ্দাফী, সাদ্দামসহ এককালের জনপ্রিয় এবং পরবর্তীতে পতিত স্বৈরাচারদেরকেও এককথায় ভালো-খারাপ উপাধি দেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। গেম অফ থ্রোনসের চরিত্রগুলোর মতোই এরাও দীর্ঘ শাসনামলে প্রচুর ভালো কাজ করেছে, আবার প্রচুর খারাপ কাজও করেছে। যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো এদের প্রত্যেকের জীবন এবং কর্মকাণ্ডের উপর বিস্তারিত আলোচনা এবং বিশ্লেষণ।

৪. সততা সবসময় সর্বোত্তম ফলাফল দেয় না

সততাই সর্বোত্তম পন্থা- বাক্যটি প্রবাদ হিসেবে চমৎকার হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিশেষ করে রাজনীতিতে সততা খুব সময়ই পুরস্কৃত হয়। এখানে সৎ প্রার্থীরা অধিকাংশ সময়ই অসৎ প্রার্থীদের হাতে পরাজিত হয়। স্থানীয়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনীতি- সব ক্ষেত্রেই আদর্শবান রাজনীতিবিদদেরকে সবাই প্রশংসা করে ঠিকই, কিন্তু খুব কম সময়ই তারা ভোটে জিততে পারে, বা জিতলেও শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী এখন উগ্র ডানপন্থী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর জয়জয়কার। অনেক দেশে এখন শুধু নামেই গণতন্ত্র, বাস্তবে তার আড়ালে সামরিক স্বৈরতন্ত্র। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও অনেক দেশের রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতা হারাতে হচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে। জাতিসংঘও জন্মের পর থেকেই জিম্মি হয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর হাতে।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

গেম অফ থ্রোনসের প্রথম সিজনে সবচেয়ে সৎ এবং আদর্শবান নেতা ছিলেন নেড স্টার্ক। অথচ সিজন শেষে তিনি তার কুটিল বুদ্ধির অভাবের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন নিজের গর্দান দিয়ে। যদিও পিটার বেইলিশ এবং সার্সি ল্যানিস্টারের ষড়যন্ত্রেই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, কিন্তু কিংস ল্যান্ডিংয়ের জনগণও তার মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

জন স্নোকে তার মহৎ কাজের মূল্য দিতে হয়েছিল দুবার। প্রথমবার মৃত্যুবরণ করে, এবং দ্বিতীয়বার নির্বাসনে গিয়ে। লর্ড ভ্যারিস জীবনের বিভিন্ন সময় অসৎ রাজাদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করেছেন। কিন্তু শেষ সিজনে যে-ই না তিনি জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন, তখনই তাকে প্রাণ দিতে হয়। এসব কোনো ক্ষেত্রেই সততা বা মহত্ত্ব তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি।

৫. কিছু কৌশল শেষ মুহূর্তের জন্য গোপন রাখা ভালো

যুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেজন্য যুদ্ধের পূর্বেই নিজেদের শক্তিমত্তা প্রচারের প্রয়োজন আছে, যেন শত্রুপক্ষ আক্রমণ করারই সাহস না করে। কিন্তু তাই বলে সকল শক্তি কিংবা সব ধরনের সক্ষমতা প্রকাশ করা উচিত না। চমক হিসেবে কিছু শক্তি গোপন রাখা ভালো, যেন শেষ মুহুর্তে সেটা প্রকাশ করে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়া যায়। অথবা যদি যুদ্ধ বেঁধেই যায়, তাহলে যেন সেটা ব্যবহার করে সহজই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।

ব্ল্যাকওয়াটার যুদ্ধে ওয়াইল্ড ফায়ারের ব্যবহার; Image Source: HBO

গেম অফ থ্রোনসের ব্ল্যাক ওয়াটারের যুদ্ধে স্ট্যানিস ব্যারাথিয়ন যখন তার বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে কিংস ল্যান্ডিং আক্রমণ করেন, তখন রাজা জফ্রির পরাজয় প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু টিরিয়নের বুদ্ধি অনুযায়ী ওয়াইল্ড ফায়ার দিয়ে স্ট্যানিসের বাহিনীর ওপর আচমকা আক্রমণ করার ফলে তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। স্ট্যানিস যদি আগে থেকেই জানতেন যে, এই যুদ্ধে ওয়াইল্ড ফায়ার ব্যবহার করা হবে, তাহলে তার প্রস্তুতি ভিন্নরকম হতো এবং তাকে পরাজিত করাও আরো কঠিন হতো।

তবে শুধু যুদ্ধে না, রাজনীতিতেও এই কৌশল বেশ কার্যকর। নির্বাচনের পূর্বে প্রার্থীরা বিভিন্নভাবেই প্রচার-প্রচারণা চালায়। কিন্তু কারো কাছে যদি প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থী সম্পর্কে এমন কোনো গোপন তথ্য থাকে, যা প্রকাশ পেলে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে, তাহলে সেটা আগে প্রকাশ না করে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। রাজনীতির ভাষায় এটা ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ নামে পরিচিত।

৬. ধর্মীয় চরমপন্থীদেরকে বেশি সুযোগ দিতে নেই

ধর্ম স্পর্শকাতর বিষয়। মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু একইসাথে ধর্মব্যবসায়ী এবং ধর্মীয় চরমপন্থীদের কাছ থেকেও সাবধান থাকা উচিত। গেম অফ থ্রোনসের রেড ওম্যান মেলি-সান্দ্রের চরিত্রটি আমাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তার প্ররোচনায় ভ্রান্ত আশ্বাসে স্ট্যানিস ব্যারাথিয়ন নিজের স্ত্রী এবং শিশুকন্যাকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলি-সান্দ্রের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়নি।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

অন্যদিকে কিংস ল্যান্ডিংয়ের ফেইথ মিলিট্যান্ট আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় আল-কায়েদা, আইসিস কিংবা এ জাতীয় অন্যান্য ধর্মীয় চরমপন্থী সংগঠনগুলোর কথা। সার্সি ল্যানিস্টার নিজের স্বার্থে হাই স্প্যারো এবং তার বাহিনীকে ক্ষমতায়ন করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকেও এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।

ইয়েমেন, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো রাষ্ট্রও শুরুর দিকে নিজেদের স্বার্থে আল-কায়েদার সদস্যদেরকে অবাধে চলাচল করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এরপর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের জটিলতায় এই আল-কায়েদা থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে যখন আইএস গঠন করে, তখন তারা নির্বিচারে সবার বিরুদ্ধেই ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চালাতে শুরু করে।

৭. স্বৈরশাসকদের উত্থান হয় ধীরে ধীরে, তার অনুগতদের নীরবতার সুযোগে

গেম অফ থ্রোনসে ডেনেরিস টারগারিয়ানের চরিত্রটি সম্ভবত সবচেয়ে জটিল চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি। যদিও তাড়াহুড়ার কারণে অষ্টম সিজনে তার ম্যাড কুইনে রূপান্তরিত হওয়ার দৃশ্যটি দর্শকদের খুব একটা পছন্দ হয়নি, কিন্তু ডেনেরিসের মধ্যে যে হিংস্রতা ছিল, সেটা শুরু থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। ডেনেরিস অতীতে বারবার হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি তার সিংহাসনের অধিকার আদায় করেই ছাড়বেন। তার জন্য প্রয়োজনে তিনি শহরের পর শহর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিবেন।

ডেনেরিস তার হিংস্রতার উদাহরণও দেখিয়েছেন বারবার। অতি তুচ্ছ অপরাধেও তিনি তার শত্রুদেরকে ড্রাগনের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছেন। তিনি তাদেরকে বন্দী করতে পারতেন, অন্য কোনো শাস্তি দিতে পারতেন, কিন্তু সেটা না করে অবলীলায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার মতো নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করেছেন তিনি। কিন্তু তারপরেও তার উপদেষ্টারা, তার সঙ্গীরা সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলেনি। কারণ শত্রুদের বিরুদ্ধে কী আচরণ করা হচ্ছিল, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।

Image Source: gameofquotes.blogspot.com

কিন্তু সেই ডেনেরিস যখন রাজধানী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই সবাই নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের চোখের সামনে, তাদের সম্মতি এবং সহায়তায়ই ডেনেরিস ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এখন সবাইকেই অস্ত্রের জোরে ‘মুক্ত’ করে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছেন। তাকে বাধা দেয়ার এখন আর তেমন কেউ নেই।

বাস্তব দুনিয়াতেও ডেনেরিসের মতো চরিত্রের কোনো অভাব নেই। বিশ্বের অনেক স্বৈরশাসকই প্রথমে ক্ষমতায় আসেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে, অথবা জনগণের সমর্থনে সামরিক অভ্যুত্থান বা বিপ্লব করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারাই জেঁকে বসেন জনগণের উপর। মুখে সব সময় গণতন্ত্রের কথা বললেও এরপর হঠাৎ একদিন গণভোট দিয়ে বা নির্বাচনে কারচুপি করে যখন ক্ষমতায় পাকাপাকি বসে যান, তখন মানুষের আর কিছু করার থাকে না।

এর কারণও গেম অফ থ্রোনসের মতোই। এই শাসকরা যখন অপরাধীদেরকে বা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে বা দেশের নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীকে শত্রু আখ্যা দিয়ে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার হরণ করেন, তাদেরকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেন, তখন শাসকদের আশেপাশের ক্ষমতাসীনরা এবং সাধারণ মানুষরা সেটার প্রতিবাদ করে না বলেই তারা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখল করার সাহস পান। ডেনেরিসের মতোই তাদের ভ্রম হয় যে, দেশটা তাদেরই সম্পত্তি। দেশ নিয়ে যা খুশি করার অধিকার তারা রাখেন।

৮. শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে না দেয়া পর্যন্ত সিংহাসন নিরাপদ না

অনেকসময়ই দেখা যায়, মূল আন্দোলন দমন করে ফেলার পরেও ক্ষমতাসীনরা শান্ত হয় না। আন্দোলনের সাথে জড়িত একেবারে নিচের দিকের সদস্যদের বা সমর্থকদের বিরুদ্ধেও তারা অভিযান অব্যাহত রাখে। অথবা কোনো অভ্যুত্থান যখন সংগঠিত হয়, তখন দেখা যায় শুধুমাত্র রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করেই অভ্যুত্থানকারীরা নিষ্ক্রান্ত হয় না। অনেক সময়ই তারা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। এমনকি পরিবারের শিশুদেরকেও রেহাই দেয় না।

এর কারণটা পরিষ্কার। শত্রুপক্ষের নিরীহ সদস্যদেরকেও বাঁচিয়ে রাখলে একদিন তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফিরে আসতে পারে। ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য শত্রুপক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেটা যত নিষ্ঠুর পদ্ধতিতেই হোক না কেন। গেম অফ থ্রোনস আমাদেরকে বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দেয়।

ওবেরিন মার্টেল গ্রেগর ক্লিগেন তথা মাউন্টেনকে পুরোপুরি হত্যা না করেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। তার প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। রাজা রবার্ট ব্যারাথিয়ন চেয়েছিলেন ডেনেরিস টারগারিয়ানকে হত্যা করতে। সেটা পারেননি বলেই পরবর্তীতে তার স্ত্রী সার্সির মৃত্যু হয়েছিল এবং তার রাজ্য পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল।

জফ্রির মতো খামখেয়ালি শাসকও বুঝতে পেরেছিলেন, সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। সেজন্যই তিনি খুঁজে খুঁজে রবার্টের সম্ভাব্য জারজ সন্তানদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রামসি বোল্টন থিওনের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন করার পরেও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীতে সেই থিওনের সাহায্যেই সানসা তার হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এবং এই সানসার হাতেই শেষপর্যন্ত রামসির করুণ মৃত্যু ঘটেছিল।

সার্সি ল্যানিস্টার ঠিকই বলেছিলেন, সিংহাসনের খেলায় আপনি হয় জিতবেন, অথবা মৃত্যুবরণ করবেন। এখানে মাঝামাঝি কোনো ব্যাপার নেই।

This article is in Bangla. It's about the political lessons learned from the TV Series Game of Thrones. All the references are hyperlinked inside the text.

Featured Image: Esquire

Related Articles