করোনা ভাইরাসের তীব্রতা ও ব্যাপকতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বিশ্বে ৫০০ মিলিয়নের মতো মানুষ কার্যত গৃহবন্দী। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো আজ ভূতুড়ে নগরী। পুরো ইউরোপ করোনার প্রকোপে অসহায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক সংখ্যক লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক সংকট হলেও ভূ-রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বৈশ্বিক নেতৃত্বের চালক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ এবং ভূ-রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ভূমিকা-আগামী দিনে বৈশ্বিক নেতৃত্ব কে পুনর্গঠন করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে ফ্রান্স দুর্বল হয়ে যায়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেন একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হয়ে উঠে। সুয়েজ সংকটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ভুল পদক্ষেপ আমেরিকাকে নেতৃত্বের আসনে নিয়ে আসে। করোনা সংকটের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই যে, এটি বাঁক পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভুল
যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ নিজেকে বৈশ্বিক দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। জলবায়ু চুক্তি থেকে একতরফা প্রত্যাহার, টিপিপি থেকে বেরিয়ে আসা, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান, বিশ্বায়নের উল্টো হাঁটা, বাণিজ্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের দূরে ঠেলে দেয়া।
সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পশ্চিমের অংশীদারদের বাকবিতণ্ডা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল পশ্চিমা দুনিয়ার ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। উদ্বোধনী ভাষণে জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্ক ওয়াল্টার স্টাইনমায়ার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করছে। এছাড়া, আফগানিস্তানে তালেবানদের সাথে চুক্তি ভূ-কৌশলগত বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনকেই সহায়তা করবে। সর্বশেষ করোনা মোকাবিলায় মার্কিন সরকারের বিশৃঙ্খলা মূলত দক্ষতা ও সামর্থ্যের অভাবকে স্পষ্ট করেছে।
প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে। পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় কীট, মাস্ক, ভেন্টিলেটর, পিপিই, মেডিসিনের অভাব রয়েছে। অন্যদের কাছ থেকে সহায়তা চেয়ে অ্যাম্বাসিগুলোতে চিঠি দিয়েছে। প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই চীনকে সহায়তা করতে চাইলেও এখন খোদ নিজের দেশেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
করোনা সংকটটি বৈশ্বিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র জোট না করে একাকী চলছে। ইউরোপের মিত্রদের কোনোরকম না জানিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ করেছে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। গত সাত দশক ধরে আন্তর্জাতিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্র যৌথ প্রচেষ্টা ও জোট গঠনকে গুরুত্ব দিত। ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখানেও ব্যর্থ। এই ব্যর্থতাকে পূরণ করছে চীন।
চীন করোনা ঠেকাতে নেয়া পদক্ষেপ ও কার্যকারিতাকে গণমাধ্যমে তুলে ধরছে। একদিকে চীনা মডেলের সফলতা, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাকে নিজস্ব মিডিয়া, আর্টিকেল লেখনী, কূটনৈতিকদের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে প্রচার করছে। যা সংকটে সাড়াদানকারী চীনের বৈশ্বিক অংশীদারিত্বকে দৃঢ় করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা পেতে ব্যর্থ ইতালিও চীনকেই বিপদের বন্ধু মনে করছে।
ইউরোপীয় অখণ্ডতা: রূপকল্প কী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আঞ্চলিকতাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ম্যাস্ট্রিট চুক্তি ও শেনজেন জোনের মধ্য দিয়ে ইউরোপের দেশসমূহের একীভূত অর্থনীতির প্রয়াস নেয়া হয়। ব্রেক্সিট, সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক নীতি, জাত্যভিমান-কেন্দ্রীক জনতুষ্টির রাজনীতি, ফ্রান্স-জার্মান কর্তৃত্ব, গ্রীস সংকট – ইউরোপীয় অখণ্ডতায় বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। করোনা সংকটে ইউরোপের অভিন্ন নীতির বদলে প্রত্যেক দেশ নিজের স্বার্থকে আগে দেখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদের মতো ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশ নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। করোনা পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর এর প্রভাব পড়বে। সংকটে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যার্থতা আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী, অভিবাসন বিরোধী, সংরক্ষণবাদীদের শক্তিশালী করবে। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় সংহতিকে রূপ কথার গল্প বলে খারিজ করে দিয়েছেন এবং বলেন, “চীন একমাত্র দেশ যে আমাদের সাহায্য করতে পারে।”
চীনের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ
প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং করোনাকে বৈশ্বিক সংকট অভিহিত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে একসাথে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প যখন একলা চলো নীতির মাধ্যমে দূরে সরে যাচ্ছেন চীন তখন বিশ্বের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে প্রশংসিত হচ্ছে। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো ইতালিকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হলেও চীন ১,০০০ ভেন্টিলেটর, ২ মিলিয়ন মাস্ক, ১,০০,০০০ শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়ক যন্ত্র, ২০,০০০ প্রতিরক্ষাকারী পোশাক ও ৫০,০০০ টেস্ট কীট পাঠিয়েছে। চীনের এই উদ্যোগকে অনেকে বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন।
চীন ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার বিভিন্ন গ্রুপ ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করছে। ইউরোপে '১৭+১', সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন, আসিয়ান এই প্রক্রিয়ার অংশ। গার্ডিয়ান লিখেছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং চীনের প্রভাবকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, তখন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশ্বের নেতা হয়ে উঠছে বেইজিং।
চলমান সংকট-পরবর্তী বিশ্ব নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। আটলান্টিকের দুই পাড়ের সম্পর্কের তিক্ততা আগামীতে আরো বাড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে, আর রাশিয়ার উপস্থিতি আরো বেশি জোরালো হবে। চীনের বহু-মেরুকেন্দ্রিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা সংস্কারের এজেন্ডা আরো বেগবান হয়ে উঠবে। পশ্চিমা বিশ্ব নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিভক্ত। বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। চীন কি নতুন নিয়মকানুন প্রণয়নের উপযুক্ত বৈশ্বিক নেতৃত্বের দাবিদার হওয়ার দিকে এগোচ্ছে?
References
- The Coronavirus Closes Borders | Geopolitical Futures
- Munich Security Report 2020
- The coming crisis of western powers
- The new world disorder | ORF
- Political illiberalism: A new beast in town | ORF
- China Is Maneuvering for Global Leadership During the Coronavirus Crisis as the United States Falters.
- বিভক্ত পশ্চিমা বিশ্বের সূর্য ডুবছে - Prothom Alo
- করোনা মোকাবিলায় বিশ্বনেতা হয়ে উঠছে চীন? | Bangla Tribune
- করোনাভাইরাসে বিশ্বের ৫০০ মিলিয়ন মানুষ গৃহবন্দী | The Daily Star Bangla