Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাশিয়ান বিমান বিধ্বস্তের পরেও পুতিনের কেন নরম সুর?

গত ১৭ সেপ্টেম্বর, সোমবার রাত এগারোটার দিকে সিরিয়ার লাতাকিয়া প্রদেশের আকাশে একসাথে অনেকগুলো ঘটনা ঘটতে শুরু করে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সিরিয়ার একটি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করতে থাকে। সিরিয়ান সেনাবাহিনী তাদের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট সিস্টেম থেকে যুদ্ধবিমান এবং মিসাইলগুলো লক্ষ্য করে পাল্টা মিসাইল এবং গুলিবর্ষণ করতে থাকে। একই সময় ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের একটি যুদ্ধবিমান লাতাকিয়ার আকাশে নজরদারি করার লক্ষ্যে উড়তে থাকে, একটি ফরাসি যুদ্ধজাহাজ থেকে লাতাকিয়ার আকাশ লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করা হতে থাকে। আর এ সবকিছুর মাঝে লাতাকিয়ার নিকটবর্তী আকাশসীমায় ১৫ জন ক্রুসহ নিখোঁজ হয়ে যায় রাশিয়ান বিমানবাহিনীর একটি প্লেন।

যে পথে বিধ্বস্ত হয়েছিল রাশিয়ান প্লেনটি; Image Source: BBC

রাশিয়ান বিমানবাহিনীর Ilyushin Il-20 প্লেনটি সম্ভাব্য শত্রু ঘাঁটি পরিদর্শন শেষে যখন লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়া হিমাইমেম বিমান ঘাঁটিতে অবতরণের উদ্দেশ্যে সিরিয়ার সীমান্তে প্রবেশ করছিল, তখন সমুদ্র তীর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায়ই এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঠিক সে সময় বা তার অব্যবহিত পূর্বে ইসরায়েলের চারটি এফ-১৬ বিমান লাতাকিয়ার আকাশ সীমায় প্রবেশ করে সিরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল। ইসরায়েলের ভাষায়, ঐ ঘাঁটি থেকে ইরানের পক্ষ থেকে লেবাননে হেজবুল্লাহ’র কাছে মারণাস্ত্র প্রেরণের কথা ছিল বলেই তারা সেখানে আক্রমণ করেছিল।  এছাড়াও একই সময় ফ্রান্সের একটি যুদ্ধ জাহাজ থেকেও লাতাকিয়ার আকাশে রকেট নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটেছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে ইসরায়েল এবং ফ্রান্সকে দায়ী করা হয়।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাশিয়ান বিমান বিধ্বস্তের পেছনে কে দায়ী, তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আসতে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চপদস্থ মার্কিন সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএন দাবি করে, সিরিয়ার অ্যান্টি এয়ারক্রাফটই ইসরায়েলি বিমান মনে করে রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করেছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে ঘটনার পেছনে ইসরায়েল অথবা ফ্রান্স দায়ী বলে সন্দেহ প্রকাশ করে। ইসরায়েল সিরিয়ার উপর আক্রমণের কথা স্বীকার করলেও রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার পেছনে সিরিয়া, ইরান এবং হেজবুল্লাহকে দায়ী করে। অন্যদিকে ফ্রান্স রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও মিসাইল নিক্ষেপের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।  

টুইটারে পাওয়া ছবি অনুযায়ী রাশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ছবি; Image Source: Haaretz

ইসরায়েলকে সরাসরি নিজেদের বিমান ভূপাতিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত না করলেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ১৫ জন রাশিয়ান ক্রুর মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েলের দায়িত্বহীন পদক্ষেপকে দায়ী করা হয়। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ফোন করেন এবং দুর্ঘটনার দায় সম্পূর্ণ ইসরায়েলের বলে অভিযোগ করেন। মন্ত্রণালয়ের দাবী অনুযায়ী, ইসরায়েলের এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানগুলো রাশিয়ার আইএল-২০ বিমানটির আড়ালে থেকে সিরিয়ার উপর আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে রাশিয়ান বিমানটিকে সিরিয়ার প্রতি-আক্রমণের মুখে ফেলে দেয়, যার ফলে তাদের বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিবৃতিতে এটাও জানানো হয় যে, রাশিয়া ইসরায়েলের এ শত্রুভাবাপন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অবশ্য ঘটনার ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আইডিএফ রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত হওয়ায় এবং তাদের ক্রু নিহত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে, কিন্তু এর জন্য সরাসরি সিরিয়াকে দায়ী করে। আইডিএফের পক্ষ থেকে  দাবি করা হয়, তারা সিরিয়াতে হামলা করেছিল ঠিকই, কিন্তু রাশিয়ান বিমানটিতে যখন আঘাত লাগে, তার আগেই তারা ইসরায়েলের সীমান্তে ফিরে এসেছিল। দুর্ঘটনার জন্য তারা সরাসরি সিরিয়ার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট সিস্টেমের অদক্ষতাকে দায়ী করে। আকাশে রাশিয়ান কোনো বিমান আছে কি না, সেটা চিনতে না পেরে কিংবা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা না করে এলোপাথাড়ি অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল নিক্ষেপ করার ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতি থেকে যখন মনে হচ্ছিল দুই দেশের মধ্যে হয়তো একটি কূটনৈতিক সংকট আসন্ন, ঠিক তখনই দুই পক্ষের মুখ থেকেই শোনা যেতে থাকে সমঝোতার সুর। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন, যদিও তিনি আবারও স্মরণ করিয়ে দেন, ঘটনার জন্য সিরিয়াই দায়ী এবং ইসরায়েল সিরিয়াতে ইরানের অবস্থানকে প্রতিহত করার জন্য যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণে পিছপা হবে না। নেতানিয়াহু তদন্তে সহায়তা করার জন্য রাশিয়াকে তাদের হাতে থাকা সকল তথ্য দেওয়ার এবং ইসরায়েলের বিমানবাহিনীর প্রধানকে মস্কোতে পাঠানোরও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে মঙ্গলবার বিকেল বেলা, যখন ভ্লাদিমির পুতিন সকাল বেলা তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে দাবি করেন, রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার জন্য ইসরায়েল দায়ী নয়। তার ভাষায়, এটি ছিল কতগুলো করুণ দুর্ঘটনামূলক ঘটনার ফলাফল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিকে পুতিন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সিরিয়াতে অবস্থিত রাশিয়ান সৈন্য এবং স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করাই হবে এই মুহূর্তে নেওয়া যথাযথ ব্যবস্থা।

যদিও পুতিনের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, ইসরায়েল প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ান প্লেন বিধ্বস্তের জন্য দায়ী না, কিন্তু তারপরেও এই ঘটনায় ইসরায়েলের কিছুটা হলেও দায় আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য ইসরায়েলের সাথে রাশিয়ার সরাসরি হটলাইন আছে। এমনকি ইসরায়েলি বিমান বাহিনীতে রাশিয়ান ভাষা জানা কর্মকর্তাও আছে, যারা যেকোনো আক্রমণের আগে রাশিয়ানদের সাথে আলোচনা করে নেয়। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী সোমবারে ইসরায়েল সিরিয়াতে আক্রমণের মাত্র এক মিনিট আগে রাশিয়াকে অবহিত করেছিল, যার ফলে রাশিয়ার পক্ষে তাদের প্লেনকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কিন্তু তারপরেও পুতিন কেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত বক্তব্য দিলেন না? এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, যখন এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আক্রমণটি ইসরায়েল করেনি, বরং রাশিয়ার দেওয়া অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার মিত্র সিরিয়াই করেছে, তখন পুরো ব্যাপারটিই রাশিয়ার জন্য কিছুটা অবমাননাকর হয়ে পড়েছে । ফলে এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে দোষারোপ করার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। তবে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অপ্রকাশ্যে রাশিয়া হয়তো সিরিয়া এবং ইসরায়েল উভয়ের বিরুদ্ধেই সাময়িক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, সিরিয়াতে ইরান রাশিয়ার মিত্র হলেও ইসরায়েল রাশিয়ার শত্রু না। ইসরায়েলে বিপুল সংখ্যক রাশিয়ান বংশোদ্ভূত ইহুদীর বসবাস এবং রাশিয়াতেও ইসরায়েলি লবি অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে রাশিয়ার পক্ষে যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া খুব একটা সহজ না। এছাড়াও সিরিয়াতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকে নেতানিয়াহুর সাথে পুতিনের এ পর্যন্ত অন্তত দশ বার সরাসরি বৈঠক হয়েছে। ইসরায়েল যে সিরিয়াতে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে, তার একটিতেও রাশিয়া বাধা সৃষ্টি করেনি।

ইসরায়েল বিভিন্ন সময়ই দাবি করেছে, বাশার আল-আসাদের সাথে তাদের কোনো শত্রুতা নেই। গত চল্লিশ বছরে সিরিয়ার সাথে সীমান্তে তাদের একটি গুলিও আদান-প্রদান হয়নি। কিন্তু তারা সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান শক্তিশালী হতে দিতে চায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাশিয়াও ইসরায়েলের এ দাবি মেনে নিয়েছে। ফলে যতদিন পর্যন্ত ইসরায়েল সরাসরি বাশার আল-আসাদের বাহিনীর উপর কিংবা রাশিয়ান বাহিনীর উপর আক্রমণ না করে শুধুমাত্র ইরানী স্থাপনার উপর কিংবা ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর উপর আক্রমণ করবে, ততদিন পর্যন্ত হয়তো সিরিয়াতে সব পক্ষের মধ্যে মোটামুটি একটি ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে রাশিয়া ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার ঝুঁকি নেবে না।

ফিচার ইমেজ- AFP

Related Articles