Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১৯৮৪-র দাঙ্গায় কংগ্রেসের ভূমিকা অস্বীকার: রাহুল গান্ধী একটি রাজনৈতিক সুযোগ হারালেন

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী সম্প্রতি লন্ডনে বসে একটি বোমা ফাটালেন। যুক্তরাজ্যের সাংসদ এবং নেতাদের সঙ্গে এক কথোপকথনে বললেন, ১৯৮৪ সালে দিল্লি এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঘটিত ভয়ানক শিখনিধন যজ্ঞে কংগ্রেস দলের কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর হওয়া সেই দাঙ্গা নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক এবং তিনি চান যে অপরাধীদের শাস্তি হোক; কিন্তু তিনি এটা মানতে নারাজ যে তার দলের সেই দাঙ্গায় কোনো ভূমিকা ছিল।

রাহুলবাবুর কথায় অবধারিতভাবে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। কংগ্রেস অধ্যক্ষকে বিপক্ষ দল বিজেপি এবং শিরোমণি অকালি দল ছাড়াও আক্রমণ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম; তার কড়া সমালোচনা করেছেন প্রাক্তন কূটনীতিক এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী। স্বাভাবিকভাবেই বলা হচ্ছে যে, রাহুল গান্ধী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজের দলকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার বিজেপির থেকে নৈতিক লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে।

সম্প্রতি ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী; Twitter handle of Rahul Gandhi @RahulGandhi

রাহুলের এই অস্বীকার বুমেরাং হয়ে ফিরল

রাহুল গান্ধী হয়তো ভেবেছিলেন যে যেহেতু ১৯৮৪ আজ অতীত এবং বর্তমান ভারতের এক বড় অংশের ভোটার সেই সময়ে জন্মায়নি, তাই তিনি “কংগ্রেস দায়ী নয়” বলেও হয়তো পার পেয়ে যাবেন। দলের এই ঘোর দুর্দিনে বিলেতের মাটিতে বসে তিনি তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু আটচল্লিশ বছর বয়সী রাহুলের এই স্ট্রোকটি বুমেরাং-এর মতো ফিরে এল তারই দিকে। অথচ একটি সুবর্ণ সুযোগ কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন বেশ জবরদস্ত রাজনৈতিক চাল দেওয়ার।

রাহুলের আগেকার বক্তব্যের সঙ্গে এবারের বক্তব্যের সঙ্গতি নেই

১৯৮৪ সালের দাঙ্গার স্মৃতি ও নথি ভারতের লোকজীবনে আজ এতটাই গ্রথিত যে সেই ইতিহাসকে নিমেষে বদলে দেওয়া সম্ভবপর নয় কারও পক্ষেই। রাহুল গান্ধী নিজেও অতীতে এই বিষয়টির উপরে অন্য মত প্রকাশ করেছেন। অতীতে যখন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং দলের প্রাক্তন সভাপতি সোনিয়া গান্ধী সেই দাঙ্গার ব্যাপারে ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছেন; খেদ প্রকাশ করেছেন, তখন এই রাহুল গান্ধীই বলেছেন যে তিনি ওই দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে সহানুভূতিশীল। এরপর ভারতের একটি বড় চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাহুল বলেছিলেন, চুরাশির দাঙ্গার সঙ্গে কিছু কংগ্রেস নেতা জড়িত এবং তাদের শাস্তিও হয়েছে। তাহলে আজকে তিনি আবার অন্য কথা বলছেন কেন?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: TwoCircles.net

ঝুঁকি নিতে চাইছেন না রাহুল গান্ধী?

আসলে রাহুল আর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না এই সময়ে। লোকসভা নির্বাচন ছাড়াও আরও বেশ কিছু রাজ্যেও ভোট আগামী কয়েকমাসের মধ্যে। আর রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে এখনও কিছু করে উঠতে না পারা কংগ্রেসের কাছে এ এক বড় কঠিন সময়। প্রচণ্ড চাপে থাকা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে এখন মহারাজা হরিশচন্দ্রের মতো উদারতা দেখানো বেশ কঠিন কাজ। বিশেষত, গত কয়েকটি বারে যখন ক্ষমাপ্রার্থনা, আফসোস জ্ঞাপন বা ঘুরিয়ে কংগ্রেসের দিকে আঙ্গুল তোলা বিশেষ সুবিধা এনে দেয়নি।

কিন্তু, এবারেই রাহুল দাঙ্গার বিষয়টিকে হাতিয়ার করতে পারতেন

অথচ এবারেই কিন্তু রাহুল চাইলে ১৯৮৪-র দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে হিসেবি রাজনৈতিক চাল চালতে পারতেন। রাহুল গান্ধী যদি লন্ডনের সভায় কবুল করতেন যে ইন্দিরা হত্যার পর সেই দাঙ্গাতে তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের সমর্থন ছিল এবং তার পরে পরে যদি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চ্যালেঞ্জ করতেন ২০০২ সালের গুজরাটের মুসলমান-বিরোধী দাঙ্গাতে তার ভূমিকার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে তাহলে বিজেপি নেতৃত্ব কিছুটা হলেও চাপে পড়ে যেত। অতীতে রাহুল গান্ধীর “আরএসএস মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল” মন্তব্যে যেমন গেরুয়া শিবির রে-রে করে তেড়ে এসেছিল, তেমনই চুরাশির দাঙ্গায় কংগ্রেসের ভূমিকা স্বীকার করার পরেও যে তারা রাহুল ও তার দলকে লক্ষ্যমাত্রা করত, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু রাহুল গান্ধী পরিকল্পনামাফিক তখন গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে মোদীকে পাল্টা লক্ষ্যমাত্রা করতে পারতেন।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী; ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টবর নয়াদিল্লিতে নিজের শিখ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতেই খুন হন তিনি এবং তারপরেই শুরু হয় শিখনিধন যজ্ঞ; Source: Dutch National Archives, The Hague, Fotocollectie Algemeen Nederlands Persbureau (ANEFO); Wikimedia Commons

কিন্তু তা না করে রাহুল হয়ে গেলেন রক্ষণাত্মক। আর তাতে তার লাভের চেয়ে লোকসানই হল বেশি। প্রতিকূল অবস্থাতেও সততাকে আঁকড়ে ধরতে পারলে তাও না হয় তার কিছু বন্ধু যোগ হতো। কিন্তু এমন একটা মন্তব্য তিনি করলেন যাতে নিজে তো বটেই, পুরো দলটাকেই হাসির এবং ক্রোধের খোরাক করে ফেললেন।

রাহুল গান্ধী হয়তো এখনও বুঝতে পারেন না বা চান না যে রাজনীতিতে সোজাসাপ্টা বুদ্ধির চেয়ে কূটবুদ্ধির গুরুত্ব অনেক বেশি দরকারি। ২০০৪ সালে তার মা সোনিয়া গান্ধী যখন ‘অন্তরের ডাক’-এর কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রত্যাখ্যান করে বিজেপির সমস্ত আক্রমণ ব্যর্থ করেছিলেন, তাতে তার ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির সম্যক পরিচয় ছিল। রাহুল মায়ের হাত থেকে দলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন প্রায় বছর ঘুরতে চলল কিন্তু এখনও সেই ক্ষুরধার মগজাস্ত্র ব্যবহার করে বিজেপিকে চাপে ফেলতে পারেননি।

রাহুল এবং তার উপদেষ্টাদের বোঝা উচিত ছিল যে কংগ্রেসের কাছে যেমন ১৯৮৪-র দাঙ্গা একটি অভিশপ্ত অধ্যায়, তেমনই মোদী এবং বিজেপির কাছে ২০০২-র দাঙ্গাও একটি অস্বস্তিকর ঘটনা। তাই নিজে যখন দাঙ্গার প্রসঙ্গটির মুখোমুখি হচ্ছেন, রাহুল মোদীর জন্যও সেটি উত্থাপন করতে পারতেন। তাতে মোদী যেমন একটি অস্বস্তির মুখে পড়তেন তেমনি রাহুলও কংগ্রেসের দিক থেকে সমালোচনার তীরটি ঘুরিয়ে দিতে পারতেন প্রতিপক্ষের দিকে। জয় হয়তো বিরাট কিছু আসত না, কিন্তু সামান্য হলেও বিজেপিকে একটু নাড়া তিনি দিতে পারতেন।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী; ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর শিখনিধন দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, বড় কোনো গাছের পতন হলে মাটি তো একটু কাঁপবেই; Source: Twitter handle of Rahul Gandhi @RahulGandhi

২০০২ নিয়ে মোদীকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে বলে রাহুল এটা বুঝিয়ে দিতে পারতেন যে হারের মুখেও তিনি জমি ছাড়তে রাজি নন। মোদীর সামনে সে প্রশ্ন রাখলে প্রধানমন্ত্রীর দল তাকে রক্ষা করতে আসরে নেমে পড়ত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না; পাল্টা মেরুকরণের রাজনীতিতেই তারা হাঁটত, কিন্তু মেরুকরণের তো আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই। বরং তাতে যদি কংগ্রেস একটু হলেও মাটির তলায় জমি পেত তাহলে আখেরে লাভ রাহুলেরই হতো। ২০১৯-এ মোদী হাজার হলেও একটি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন আর তাকে আরও সমৃদ্ধ করাটাই হওয়া উচিত ছিল কংগ্রেসের লক্ষ্য।

রাহুল গান্ধীকে লড়তে হবে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই

বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতির যা পরিস্থিতি, সেখানে মোদীকে বেকায়দায় ফেলতে গেলে রাহুল গান্ধীকে যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখাতে হবে। মনস্তাত্ত্বিক খেলায় মনোনিবেশ করতে হবে। শুধুমাত্র বিজেপির বিরুদ্ধে সোজাসাপ্টা অভিযোগ এনে চিঁড়ে বিশেষ ভিজবে না কারণ এখনও দেশের একটি বড় অংশ মোদীর দিকে ঝুঁকে। এই শ্রেণীর মানুষের কাছে নোটবন্দি বা সংখ্যালঘু নিপীড়ন বা অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের বিষয়গুলি সেভাবে আবেদন রাখে না। এই মানুষগুলির মন জেতা রাহুল গান্ধীর কাছে অসম্ভব না হলেও কার্যত ভীষণই কঠিন। আর তাই কংগ্রেস সভাপতিকে আজ নতুন কিছু ভাবতে হবে; নতুন করে রাজনীতিকে সাজাতে হবে।

তিনি কি পারবেন? আগামী নির্বাচনগুলোতে বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে বা জোটকে আপাতত এর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

Featured Image Source: DNA India

Related Articles