Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাহুল গান্ধীর আচমকা আলিঙ্গন: কৌশলটি মন্দ নয় কিন্তু কংগ্রেসের কাজে আসবে কি?

গত ২০ জুলাই ভারতের রাজনীতিতে একটি বেশ উল্লেখযোগ্য দিন ছিল। সেদিন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থাপ্রস্তাব নিয়ে আসেন- লক্ষ্য ছিল পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের এক বছরেরও কম সময় বাকি থাকতে মোদীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে একটি মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা অর্জন করা।

অনাস্থা প্রস্তাবটি আসলে এনেছিলেন শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যাল্যায়েন্স-এর পূর্ববর্তী সদস্য দল তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)- তাদের শাসিত রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ রাজ্যের তকমা না দেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে। অন্ধ্রপ্রদেশেও আগামী বছর নির্বাচন আর ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত’ তকমার মতো সংবেদনশীল বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতেই যে তাদের এই পদক্ষেপ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যদি টিডিপি নেতৃত্ব এই সময়ে তাদের অনাস্থা প্রস্তাবটি না আনতেন, তাহলে অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষের কাছে তাদের নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন উঠত।

যা-ই হোক, একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে টিডিপির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটি অভিজ্ঞ দল টিডিপির এই পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়ে বসলেন কী ভেবে, সেটি বোঝা গেল না।

পর্যবেক্ষকদের মতে, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে এ হচ্ছে কংগ্রেসের এক মরিয়া প্রয়াস। একের পর এক নির্বাচনে হেরে একটি নৈতিক জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করার কৌশলটির যাই পরিণাম হোক না কেন, কংগ্রেস অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধী এদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেন। পর্যবেক্ষকরা সেটিকেও একটি কৌশল বলেই মনে করেছেন।

লোকসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন রাহুল; Image Source: Firstpost

অনাস্থা প্রস্তাবের আগে রাহুল গান্ধী বিজেপিকে তার সংসদীয় ভাষণে একহাত নেন। প্রথমে তিনি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস নেই। এরপর নিজেকেই তার বক্তব্যের বিষয়বস্তু করে বলেন যে সরকারপক্ষ তাকে যতই ‘পাপ্পু’ বলে ডেকে ছোট করুক না কেন, তিনি তার প্রত্যুত্তরে হিংসা-বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করেন না। রাহুল বলেন,

আমাকে যতই পাপ্পু ডাকুন না কেন আপনারা, তার মানে এই নয় যে আমি আপনাদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে চলব। উল্টো, আমি আপনাদের মনে যত ঘৃণা জমে রয়েছে, তা বের করে ভালোবাসায় পরিণত করব। কারণ আমি কংগ্রেস।

ভারতের প্রাচীনতম দলের এই সভাপতি আরও বলেন,

আপনারাই আমাকে হিন্দু হতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন, কেউ যদি আক্রমণ করে, তাহলেও তার প্রতিদানে ভালোবাসা দেওয়া উচিত।

আর এই কথাটি বলে রাহুল গান্ধী সংসদে সোজা হাঁটা লাগান শাসকদলের আসনের দিকে, এবং এরপর আচমকা জড়িয়ে ধরেন সেখানে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রী মোদীকে।

Image Source: DNA India

মোদী একটু হতভম্ব হয়ে গেলেও তাড়াতাড়ি সামলে উঠে রাহুলকে কিছু বলেন। সংসদে এই নাটক দেখে শাসক, বিরোধী দু’পক্ষই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কেউ বলেন, এটি ছিল রাহুলের মাস্টারস্ট্রোক; কেউ বা বলেন, এই বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন ছিল না কংগ্রেস অধ্যক্ষের। সংসদের স্পিকার সুমিত্রা মহাজন রাহুলের এই কাণ্ড ভালো চোখে নেননি। বিশেষত, প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন করে রাহুল গান্ধী নিজের আসনে ফিরে বসে যে দলের কারও দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মুচকি হাসেন, তাতেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, রাহুল হঠাৎ এই কাজটি করতে গেলেন কেন? আর এটা করে তিনি আদৌ কতটা সমর্থন তার দিকে টানতে পারলেন?

মোদীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়েই পড়ে আর প্রমাণিত হয় যে, রাহুল যতই অন্য কিছু করে দেখতে চান না কেন, ভারতীয় রাজনীতিতে তার প্রভাবের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়।

কী সম্ভাব্য কারণে রাহুল গান্ধী এই পন্থা নিলেন?

অনাস্থা প্রস্তাবের আগে রাহুলের বক্তব্য এবং কার্যের মধ্যে একটি যে বিশেষ লক্ষ্য ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না।

প্রথমত, “আমাকে যতই পাপ্পু ডাকুন, আমি তার প্রতিদানে হিংসা দেখাব না” জাতীয় বক্তব্যের মধ্যে একটি গান্ধীগিরি রয়েছে আর রাহুল দেশবাসীকে দেখাতে চেয়েছেন যে শাসকদল অহোরাত্র কারণে-অকারণে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে থাকে কিন্তু তিনি সেই রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। উল্টো অনাস্থা প্রস্তাব চলাকালীন কেউ যাতে রাহুলকে ‘পাপ্পু’ জাতীয় কটাক্ষ করে রাজনৈতিক বিতর্কের গতিপথ ঘুরিয়ে না দেয়, তার একটি চেষ্টা করেন তিনি।

লোকসভায় মোদী; Image Source: 5 Dariya News

দ্বিতীয়ত, রাহুল গান্ধী হয়তো তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি পরিবর্তনের জন্যও এই কাণ্ডটি করেন। অতীতে দেখা গেছে, রাহুল বড় নির্বাচনের আগে নিজের সৎ ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যে প্রকাশ্যে সরকারি আইনি খসড়া বা বিরোধীপক্ষের সরকারের কর্মসূচিকে ছিঁড়ে ফেলছেন। কিন্তু সেই প্রয়াস অনেক ক্ষেত্রেই হিতে-বিপরীত করেছে। এবার তাই হয়তো কংগ্রেসের ‘সহনশীল রাজনৈতিক মতাদর্শ’কে হাতিয়ার করে তিনি নিজের ভাবমূর্তির নম্র দিকটি প্রতিষ্ঠিত করতে সোজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী মোদীকে।

তৃতীয়ত, রাহুলের এই কাণ্ডে হয়তো বা মোদীকে কটাক্ষ করার প্রচেষ্টাই লুকিয়ে ছিল। তিনি নিজের আসেন ফিরেই যেভাবে চোখ টিপে মুচকি হাসলেন, তাতে সেকথাও মনে হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সব মিলিয়ে এটা হতে পারে শুধু সংবাদমাধ্যমের নজরে পড়ার একটি সাময়িক সাফল্য মাত্র, কারণ কংগ্রেসের কাছে এখন সেটুকুও কম নয়।

রাহুলের এই কাণ্ডে হয়তো বা মোদীকে কটাক্ষ করার প্রচেষ্টাই লুকিয়ে ছিল; Image Source: DNA India

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাহুল গান্ধী তার সঙ্গে মোদী এবং বিজেপির লড়াইটিকে একটি ধর্মযুদ্ধের রূপ দিতে চাইছেন; রাহুলের মতো ভারতের অন্যান্য মোদী-বিরোধী নেতা-নেত্রীরাও সেটাই চাইছেন। কিন্তু সমস্যা হলো আজকের দিনে রাজনীতি শুধুমাত্র নৈতিকতার নিক্তিতে মাপলে চলে না। প্রশাসক, নেতা, পপুলিস্ট শাসক, অর্থনৈতিক সংস্কারের হোতা- মোদীর আজ বিবিধ পরিচিতি ভারতের রাজনৈতিক মহলে। সেদিক থেকে রাহুল গান্ধীর রাজনীতিতে সেরকম কোনো পরিচয় এখনও পর্যন্ত নেই; কেবল এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়া ছাড়া। আজকের ভারতে শুধু এই পরিচয় ভাঙিয়ে মানুষের মন জয় করা কঠিন, আর রাহুলও সেই কাঠিন্যের সঙ্গে ঠোক্কর খাচ্ছেন বার বার। তার কণ্ঠে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের রাজনীতির প্রতিবাদ বেশিরভাগ সময়েই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ‘জয় মোদী’ স্লোগানের আড়ালে।

মোদীকে হারানোর মতো অস্ত্র রাহুলের কাছে নেই এই মুহূর্তে

কংগ্রেস সভাপতির এই উদ্ভট কাজের পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন, তিনি এটুকু বুঝিয়ে দিলেন যে, তার তূণীরে মোদীকে পরাস্ত করার মতো বিশেষ অস্ত্র নেই, অন্তত এই মুহূর্তে। আক্রমণের বদলে তিনি এবারে মোদীকে আলিঙ্গনের কৌশলটি নিলেন, যাতে এই বার্তা দেওয়া যায় যে তিনি বারবার এই লড়াইতে হারলেও আশা হারাননি এবং খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার পরিচয় দিতেও পিছপা নন।

রাহুলের তূণীরে মোদীকে পরাস্ত করার মতো বিশেষ অস্ত্র নেই, অন্তত এই মুহূর্তে; Image Source: DNA India

কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এই ‘সফ্ট স্কিল’-এর কৌশল এবং বার্তা তখনই সফল হবে, যখন রাহুল গান্ধী অন্তত একটি নির্বাচন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়ে দেখাবেন। সেই সর্ববৃহৎ কাজটিই হয়ে ওঠেনি এখন পর্যন্ত, আর এখানেই রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

ভারতের খুব বেশি মানুষ রাহুল গান্ধীকে এখনও ‘পরিণত’ ভাবতে রাজি নন, সম্ভবত একথাই সত্য।

Featured Image Source: DNA India

Related Articles