মার্চ, ২০১৫। সৌদি আরবের নেতৃত্বে পশ্চিম এশিয়া আর উত্তর আফ্রিকার নয়টি দেশ মিলে সামরিক আক্রমণ শুরু করে ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে। সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করে সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনের মনসুর হাদি সরকারকে। প্রথম চার সপ্তাহ ধরে চলে 'অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম', এরপর শুরু হয় 'অপারেশন রিস্টোরিং হোপ'। সৌদি আরবের সাথে যুক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, মিশর, জর্ডান, মরক্কো, সেনেগাল, সুদান। এসব দেশের আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। বিপরীত দিক থেকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য নিয়ে হাজির হয় ইরান, এডেন বন্দরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় হুতিদের পাশে দাঁড়ায় রাশিয়াও।
ফলে, ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ সংকট পরিণত হয়েছে আঞ্চলিক সংকট হিসেবে, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলো। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যে সংকট সমাধান করতে পারবে ভেবে সৌদি আরব সরাসরি জড়িয়েছিল, সেই সংকট পেরিয়েছে অর্ধযুগেরও বেশি সময়। এ সময়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট বিশ হাজারেরও অধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের যোদ্ধাদের পাশাপাশি নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে হাজারো বেসামরিক মানুষ, নিহত হয়েছে হাজারো শিশু।
গৃহযুদ্ধের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, বাস্ত্যচ্যুত হয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ। প্রায় ২ কোটি মানুষ পাচ্ছে না স্বাস্থ্য সুবিধা, সমসংখ্যক মানুষ আছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। প্রায় সাড়ে তিনলাখ শিশু ভুগছে চরম পুষ্টিহীনতায়, অর্ধেকের বেশি মানুষের কাছে নেই পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ। অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর পাশাপাশি অনেকগুলো আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ইয়েমেনের এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে, বাড়িয়েছে ইয়েমেনিদের দুর্ভোগ আর দুর্দশা।
মধ্যপ্রাচ্যের স্নায়ুযুদ্ধ
অতীত থেকেই নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে, ছিল একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতাও। কিন্তু, সেই প্রতিযোগিতা শত্রুতায় রূপ নেয়নি গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত। ইরান বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আয়াতুল্লাহ খোমেনি, শুরু করেন সৌদি আরবকে সরিয়ে আঞ্চলিক নেতৃত্বের স্থানে ইরানকে বসানোর প্রচেষ্টা। আদর্শিকভাবে, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মক্কা ও মদীনার দুই মসজিদের সেবক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। প্রথাগতভাবে, সৌদি আরব এই দুই মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়, এমনকি নিয়ন্ত্রণ করে আঞ্চলিক রাজনীতিও।
এই দুই দেশের সংঘাতের প্রথম প্রকাশ ঘটে আশির দশকেই, ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধে সৌদি আরব স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দেয় ইরাককে, দেয় সামরিক সাহায্যও। দুই দশকের সম্পর্কের তিক্ততা সময়ের সাথে বেড়েছে, সাম্প্রতিক সময়েও সৌদি আরব আর ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্রন্টে রয়েছে মুখোমুখি অবস্থান। সিরিয়াতে ইরান টিকিয়ে রেখেছে বাশার আল আসাদের সরকারকে, সৌদি আরবের সমর্থন পেয়েছে বিদ্রোহীরা। লেবাননে ইরানের সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে হিজবুল্লাহ, সৌদি আরবের সমর্থন ছিল সাদ হারিরির প্রতি।
ছায়াযুদ্ধে দুই দেশের এই মুখোমুখি অবস্থানের আরেকটি রূপ দেখা গেছে ইয়েমেনে। মনসুর হাদির সরকারের সমর্থনে সামরিক হামলা চালিয়েছে সৌদি আরব, ইরান সমর্থন দিয়েছে বিদ্রোহী হুতিদের। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে বিপুল সামরিক ব্যয় করেছে, চেষ্টা করেছে কৌশলগত অবস্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে। দুই পক্ষের এই মুখোমুখি অবস্থান দীর্ঘায়িত করেছে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধকে, বাড়িয়েছে গৃহযুদ্ধের পরিসর।
সৌদি আরবের ভূ-রাজনীতি
হরমুজ প্রণালী পৃথিবীর তেল সরবারহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলোর একটি। জলপথে বাণিজ্য হওয়া তেলের ৩০ শতাংশই পরিবাহিত হয় এই জলপথ দিয়ে, অপরিশোধিত তেলের ৮৫ ভাগ পরিবাহিত হয় এই পথে। প্রতিদিন পরিবাহিত হওয়া মোট তেলের পরিমাণ প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল। এই তেল রপ্তানি হয় জাপান, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে, যেগুলো পরিচিত তেলের বড় আমদানিকারক দেশ হিসেবে। হরমুজ প্রণালীর উপর নির্ভরশীল সৌদি আরবের তেল রপ্তানি, এ প্রণালীর উপর নির্ভরশীল সৌদি আরবের অর্থনীতি।
প্রণালীটির অপর পাড়ে রয়েছে ইরান, যারা প্রণালীকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যেকোনো সময় ইরান হরমুজ প্রণালীতে অস্থিরতা তৈরি করলে সৌদি আরবকে তেল সরবারহের বিকল্প পথ হিসেবে ঝুঁকতে হবে লোহিত সাগরের দিকে। এই বিকল্প রাস্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হলো এডেন বন্দর, যেখানে দুই পাড়ের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার।
ফলে, ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ সবসময়ই দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এডেন বন্দরে হুতিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে ইরান দুই দিক থেকে সৌদি আরবের তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারবে, ধ্বসিয়ে দিতে পারবে সৌদি অর্থনীতিকে। এই সমীকরণকে মাথায় রেখে উভয় পক্ষই বিপুল বিনিয়োগ করেছে ইয়েমেন সংকটে, ইরান চেষ্টা করছে সৌদি আরবকে ঘিরে ধরতে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উচ্চাশা
২০১৫ সালে যখন সালমান ইবনে আব্দুল আজিজ সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে মনোনীত হন, তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে। সৌদি আরবের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তুলনামূলকভাবে নতুন এই প্রিন্স শুরু থেকেই চেষ্টা করতে থাকেন সৌদি আরবের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার, তিনি চাইছিলেন নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে। নিজেকে দাদা আবদুল আজিজ ইবনে সউদের যোগ্য উত্তরসূরি প্রমাণের চেষ্টাও ছিল তাতে।
সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সউদ বেশ কয়েকবারই হস্তক্ষেপ করেছিলেন ইয়েমেনের রাজনীতিতে, সামরিক অভিযান চালিয়েছেন বেশ কয়েকবার, নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন আসির, তিহামার মতো শহরগুলো। নিজেকে দাদার যোগ্য উত্তরসূরি প্রমাণের তাড়না থেকেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ইয়েমেনে আক্রমণ।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই অভিযান শেষ হবে, এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেও ইয়েমেনের এই যুদ্ধ অর্ধযুগ পেরিয়ে গেছে। সৌদি আরবের অর্থনীতির উপর চাপ তৈরি করছে ইয়েমেনের যুদ্ধ, সৌদি আরবে আসছে হাজারো শরণার্থী, সীমান্তে বাড়ছে চোরাকারবার। এসবের পরেও ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে সৌদি আরব নিজেদের প্রত্যাহার করতে পারছে না, কারণ মোহাম্মদ বিন সালমান এই যুদ্ধটাকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন, বেপরোয়া এই প্রিন্সের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্যও ইয়েমেন যুদ্ধে জয় প্রয়োজন। এ কারণেও দীর্ঘায়িত হচ্ছে ইয়েমেন যুদ্ধ।
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা
যেকোনো সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো, স্বাভাবিক করতে পারে বিভিন্ন দেশের মধ্যে চলমান অবস্থা। ইয়েমেনে চলা বর্তমান সংকটকে জাতিসংঘ আখ্যায়িত করেছে ‘বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট’ হিসেবে। হাজারো বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, শিশুদের চরম অপুষ্টিতে ভোগা, আর জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সংকটে ইয়েমেনিদের জন্য প্রয়োজন ছিল সংকট সমাধানে বৈশ্বিক উদ্যোগ। কিন্তু, এ মানবিক সংকটে ক্রিয়াশীল প্রভাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু কারণে ইয়েমেন সংকট সমাপ্তিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেননি। তার পেছনে নানাবিধ কারণ আছে।
প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের, স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আবির্ভূত হয় একক পরাশক্তি হিসেবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ আবর্তিত হয় সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকও সৌদি আরব। ফলে, নিজেদের আধিপত্যবাদ বজায় রাখতেই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয়ত, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের অংশগ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। ওবামা প্রশাসনের শেষ সময় থেকেই বিপুলভাবে বেড়েছে সৌদি আরবের অস্ত্র ক্রয়, সৌদি আরব হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। নিজেকে সেরা প্রেসিডেন্টদের কাতারে নিয়ে যেতে অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রয়োজন ছিল বারাক ওবামার, তাই তিনি সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেননি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে। ট্রাম্প প্রশাসনের নজর নিবদ্ধ ছিল ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে বৈধতা দেওয়ার দিকে, সেই কাজে সৌদি আরব সঙ্গী হওয়ায় আড়ালেই পড়ে যায় ইয়েমেন সংকট।
কবে সমাপ্ত হবে এ সংকট
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে উদ্যোগ নিয়েছেন ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টানার, সাম্প্রতিক সময়ে হুতিদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ যতদিন সবগুলো পক্ষকে লাভবান করবে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ততদিন পর্যন্ত সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
This article is written in Bangla, about the external factors, responsible for the civil war in Yemen.
All the necessary links are hyperlinked inside.
Feature Image: Middle East Monitor