জাপান ও চীন– এশিয়ার এই দুটি দেশেরই অর্থনীতি প্রচণ্ড শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময়। আমেরিকার পরেই বর্তমানে চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জিডিপির দেশ, অপরদিকে জাপান চীনের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে জায়গা হারিয়েও পৃথিবীর তৃতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। দুটি দেশের সাথেই বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। জাপান আমাদের বৈদেশিক অনুদানের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা, অপরদিকে চীন আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশগুলোর একটি।
বিভিন্ন শিল্পপণ্যের জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত দিক থেকে এগিয়ে থাকা চীন-জাপানের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুটি দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক পররাষ্ট্রনৈতিক দিক থেকে অনেক উত্থান-পতনের স্বাক্ষী হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় কখনও ছেদ ঘটেনি।
চীন ও জাপানে দুটো আলাদা রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত। চীন যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত হওয়া একটি দেশ, সেখানে জাপান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। এশিয়ার পুঁজিবাদী শক্তিশালী দেশ হিসেবে জাপান প্রশংসা পেয়ে আসছে সবসময়, অপরদিকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও 'মুক্ত বাজার অর্থনীতি' গ্রহণ করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া দেশের নাম চীন। দুই দেশের রাজনৈতিক ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো, কিন্তু অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাদের মধ্যে ভীষণ মিল। এই বিষয়গুলোই তাদের দ্বিপাক্ষিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত ২৮ আগস্ট পদত্যাগ করেন। জাপানে করোনাভাইরাসের আগ্রাসন শুরু হওয়ার সময় থেকেই জনসম্মুখে আসা থেকে বিরত ছিলেন এই প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তার পদত্যাগের ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
তিনি এমন একটি সময়ে পদত্যাগ করলেন, যেসময়ে তার প্রবর্তন করা 'অ্যাবেনোমিক্স' এর অর্জনগুলো করোনাভাইরাসের কারণে বিলীন হয়ে যেতে শুরু করেছে, জনগণের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমেছে। তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যেসব বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, সেসব নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এসবের চেয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা হলো, চীন-জাপান সম্পর্ক কি আগের মতো থাকবে? নাকি এতদিন নমনীয় থাকলেও আবের উত্তরসূরী এসে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাবেন?
শিনজো আবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০১২ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন চীন-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে নেমে এসেছিল। বিতর্কিত সেনকাকু দ্বীপ কিনতে জাপান সরকার তৎপরতা চালালে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন সেটি নিজেদের দাবি করে সংঘাত অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু আবে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চাননি, আবার চীনের আধিপত্য মেনে নিতেও রাজি ছিলেন না। তার বাস্তববাদী পদক্ষেপগুলো সেসময় চীনের সাথে সংঘাত থেকে জাপানকে দূরে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী আবে সেই সময়ের তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্ক থেকে ধীরে ধীরে চীনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছেন, আবার আমেরিকাকে খুশি রাখতে সময়ের প্রয়োজনে চীনের সমালোচনাও করেছেন।
জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের বছরগুলোতে চীনের তুলনায় সামরিক খাতে আড়াইগুণ বেশি ব্যয় করছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বর্তমানে চীন সামরিক খাতে জাপানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ব্যয় করে। সামরিক খাতে এত বেশি ব্যয় করার মানে হলো, চীন অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাপানকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, তাই সামরিক খাতে এত ব্যয় করার অর্থ চীনের হাতে এসেছে। অর্থনীতি শক্তিশালী করা ছাড়া কোনোভাবেই সবকিছু ঠিক রেখে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো সম্ভব না। চীনের অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে যাওয়া তো কোনো গালগল্প নয়, নিখাদ বাস্তবতা। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে চীন নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতার কথাই জানান দিচ্ছে।
চীনের বিপক্ষে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নতুন পরিকল্পনা করে এগিয়েছেন। তার প্রশাসনের নেয়া নতুন পরিকল্পনা ও সংস্কারের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাবার মতো সামরিক সক্ষমতা হয়তো জাপানের সামরিক বাহিনী হয়তো অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু তারপরও চীনের আধিপত্যবাদী নীতিকে জাপানের বিরুদ্ধে সংযত হতে বাধ্য করেছে। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তার এ পদক্ষেপ সবচেয়ে সফল কাজগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয় এবং সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের সংস্কার ও নীতিগুলো জাপানের জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। যেকোনো সামরিক সংঘাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার জাপানের শান্তিকামী জনগণ টোকিওর রাস্তায় আবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।
জাপানের অর্থনীতি ঠিক রাখার জন্য চীনের সাথে কোনোপ্রকার দ্বন্দ্বে না জড়ানোটাই সবচেয়ে ভালো উপায় জাপানের জন্য। চীন অনেক শিল্পপণ্য জাপানে রপ্তানি করে, যেগুলো অন্য দেশ থেকে চীনের চেয়ে কম দামে পাওয়া সম্ভব নয়। জাপানে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে চীনও অনেক মুনাফা অর্জন করছে। এক রিপোর্টে দেখা যায়, জাপানের ২০ শতাংশ বাণিজ্য সম্পন্ন হয় চীনের সাথে, চীনই জাপানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।
তাই চীনের সাথে অর্থনৈতিক সংঘাত শুরু হলে জাপানের দিক থেকেই বেশি ক্ষতি হবে, যেহেতু জাপানকে অনেক কিছুর জন্য নির্ভর করে থাকতে হয়। এদিক থেকে জাপান ঠিকভাবেই চীনের সাথে সমঝোতা-সহাবস্থান করে চলেছে। শিনজো আবের প্রায় আট বছরের সময়ে কখনোই চীনের সাথে জাপানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়নি। খুব দ্রুত সম্পর্কের পরিবর্তন হবে বলেও মনে হয় না।
আমেরিকা-চীনের যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ, সেটি জাপানের চীন-নীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে। জাপানের সাথে চীনের যতই গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকুক না কেন, দিনশেষে আমেরিকা জাপানের দীর্ঘদিনের মিত্র। শিনজো আবের নীতি ও সংস্কারের মাধ্যমে জাপানের সামরিক বাহিনীর বদলে যাওয়ার পেছনে আমেরিকার অবদান রয়েছে। আমেরিকা ও চীনের স্নায়ুযুদ্ধ যদি বেড়ে যায়, তাহলে হয়তো চীনের সাথে জাপানের সম্পর্ক কিছুটা তলানিতে নামবে, কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে একেবারে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, জাপান এখনও অর্থনীতিতে চীনের বিকল্প তৈরি করতে পারেনি।
নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি বিশাল ঘটনা হতে যাচ্ছে চীন-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। বর্তমান ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রতি যেসব নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তাতে শুধু মার্কিন-চীন সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিতই হয়েছে। এতদিন রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্টরা চীনের প্রতি অর্থনৈতিকভাবে হার্ডলাইনে যাওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু ট্রাম্প সে প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আরেক মেয়াদে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীনের প্রতি যে আরও কঠোর হবেন, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এক্ষেত্রে আমেরিকার মিত্র হিসেবে জাপান বেশ বেকায়দায় পড়ে যাবে। আমেরিকার চাপে চীনের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে যাবে, আবার অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে চীনকে হাতছাড়া করাও বোকামি হয়ে যাবে জাপানের জন্য।
সম্প্রতি চীন হংকংয়ে যে জাতীয় নিরাপত্তা আইন তৈরি করেছে, সেটির তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু জাপানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পশ্চিমা বিশ্বের মতো সরাসরি চীনের সমালোচনা না করে শুধু সাদামাটা নিজেদের শঙ্কা ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হয়েছে। জাপানের বর্তমান সরকারি দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক তোশিহিরো নিকাই জানিয়েছেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সঠিক কাজ নয়। এ থেকেই বোঝা যায়, চীন-জাপান সম্পর্ক নির্বিঘ্ন ও নির্বিবাদী রাখতে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, যদিও মার্কিন চাপ ছিল।
দুই দেশের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশের জনগণ একটি বড় বিষয়। জাপান-চীনের যৌথ জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৪৫ শতাংশ চীনা নাগরিক জাপানের প্রতি বর্তমানে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। আগের চেয়ে এটি অনেক বেশি এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে জাপানের ক্ষেত্রে মাত্র ১৫ শতাংশ নাগরিক চীনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন, চীনের তুলনায় অনেক কম। জাপানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে জনগণের কথা মাথায় রেখে নীতিনির্ধারণ করতে হয়। জাপানে গণবিরোধী চীন-নীতি গ্রহণ করলে তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তাই চীনের উচিত, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বিভিন্ন খাতে দু'পক্ষের যৌথ সহযোগিতার পরিসর বৃদ্ধি করে জাপানের জনগণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
শিনজো অ্যাবের পর কে পরবর্তী জাপানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নির্ধারণ করবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, আবের পথ থেকে রাতারাতি সরে আসাটা অসম্ভব হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চীনের প্রতি এতদিন ধরে যে নমনীয় অথচ বাস্তবিক নীতি অনুসরণ করছিল জাপান, তা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে আবের উত্তরসূরীকে। পাশাপাশি বিশাল ঋণের বোঝা, আগের প্রধানমন্ত্রীর সময়ে চলা কেলেঙ্কারিসহ যেসব বিতর্কিত বিষয় রয়েছে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সেসব বিষয়ে আরও বিচক্ষণ থাকতে হবে, দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় সতর্ক হতে হবে। চীনের প্রতি অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে, বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, চীনের প্রতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে ভিত্তি শিনজো আবে দাঁড় করিয়েছেন, তা ভেঙে ফেলা তার কোনো উত্তরসূরীর পক্ষে এত সহজ হবে না।
This article is in Bengali language. It is about the resignation of Shinzo Abe, the PM of Japan and its impact on China-Japan relation.
References:
1. Why Japanese Prime Minister Shinzo Abe’s resignation is unlikely to change approach to China
2. What will Japan’s China policy be post-Abe?
3. Abe Shinzo’s Resignation and Its Impact on Japan-China-US Relations
Featured Image: The Diplomat