অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা আর বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তৈরি হয় রাষ্ট্র। সময়ের সাথে রাষ্ট্রের কার্যাবলি পরিবর্তন হয়েছে, মানুষও সভ্যতার পুরো সময় জুড়ে ক্রমাগত পরিবর্তন আর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছে রাষ্ট্রকে নিয়ে। এক ব্যক্তির শাসন প্রত্যক্ষ করেছে মানবসভ্যতা, অভিজাতদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালনার অভিজ্ঞতাও রয়েছে মানুষের। আবার রাষ্ট্রগুলো হেঁটেছে গণতন্ত্রের পথেও।
রাষ্ট্রব্যবস্থার এই বিবর্তনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সম্পর্ক। একটি বিশাল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণত, রাষ্ট্র সেই অর্থ সংগ্রহ করে নাগরিকদের কাছ থেকে, বিভিন্ন ধরনের করের মাধ্যমে। যেসকল রাষ্ট্রে নাগরিকদের আয়ের ব্যাপারে আমলাতন্ত্রের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে, তথ্য থাকে উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপারে, সেসব রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। আবার, যেসব রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের কাছে যথেষ্ট তথ্য ছিল না নাগরিকদের ব্যাপারে, তারা তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক আচরণ করেছে, তৈরি করেছে নাগরিকদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি তৈরির প্রথা, যাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ কর রাজস্ব সংগ্রহ করা যায়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি আধুনিক যুগে এসে রাষ্ট্রের সফলতা নির্ভর করে অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতার মতো অর্থনৈতিক সূচকগুলোকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে, প্রতিটি পণ্যেরই তৈরি হচ্ছেন একাধিক উৎপাদক। আবার গড়ে উঠছে অনেকগুলো প্রভাবশালী শিল্প, যারা বাজারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আধুনিক সময়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে লিখেছেন বহু রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ। এই লেখায় আলোচনা হবে এডাম স্মিথ ও অর্মত্য সেনের মতামতগুলো নিয়ে।
এডাম স্মিথ: অর্থনৈতিক সাম্য রক্ষা
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অর্থনৈতিক প্রেরণা জড়িয়ে থাকায় আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, অর্থনীতির আকার বড় করার জন্য ক্রমাগত প্রেরণা দিয়ে যাওয়া। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্র সাধারণত অর্থনৈতিক প্রতিষ্টানগুলোর জন্য বিভিন্ন নিয়ম ঠিক করে দেয়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে মসৃণ করতে বিভিন্ন কাঠামো তৈরি করে, নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম।
এডাম স্মিথ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্র কর্তৃক যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছেন। বরং এই রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ যুক্তি দিয়েছেন, বাজারে উৎপাদক এবং ক্রেতা স্বাধীনভাবে কর্মকান্ড চালাতে পারলেই নিশ্চিত করা যাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। উৎপাদক এবং ক্রেতার পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে বাজার সাম্যাবস্থায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে, তৈরি হবে উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ (এডাম স্মিথ যাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘অদৃশ্য হাত’ হিসেবে) উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করে, নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডগুলো। এডাম স্মিথের অর্থনৈতিক দর্শন পরিচিত ‘বাজার অর্থনীতি’ নামে।
গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয়ের দেশগুলোতে এর ঠিক বিপরীত একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার পরীক্ষা হয়। সোভিয়েত বলয়ের এই দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হতো একজন উৎপাদক কোন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন করবেন, গ্রাহক কোন ধরনের পণ্য ক্রয় করবেন। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলোর এই ধরনের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি ছিল- এর মাধ্যমে তারা নাগরিকদের সাম্য নিশ্চিত করতে পারবে, উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে তৈরি করতে পারবে স্থিতিশীলতা। আদতে সেটি হয়নি। বরং পৃথিবীর যে প্রান্তেই এই ধরনের নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কাঠামোর পরীক্ষা চালানো হয়েছে, কোথাও তা সফল হয়নি, নাগরিকদের দিতে পারেনি রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা।
অমর্ত্য সেন: সামাজিক নায্যতা নিশ্চিতকরণ
সময়ের ক্রমপরিবর্তনে রাষ্ট্রের কার্যাবলিতে পরিবর্তন এসেছে, বেড়েছে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একসময় যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব ছিল নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা, শাসনকাঠামো তৈরি করা, আধুনিক যুগে এসে রাষ্ট্রের এই দায়িত্বের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ধারণা।
এই দর্শন অনুসারে, রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য কমাতে কাজ করবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে কাজ করবে, শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করবে, নিশ্চিত করবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবাও। এর পাশাপাশি রাষ্ট্র নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্প চালু করবে, সংকটকালীন সময়ে আবির্ভূত হবে ত্রাতার ভূমিকায়।
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এই ধারণাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে ‘সামাজিক সংস্কার’ প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পাশ্চাত্যের অনেক দেশই বিংশ শতাব্দীতেই রাষ্ট্রীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পথে হেঁটেছে। সম্প্রতি সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মতো দেশগুলোও এই দর্শনের আলোকেই গড়ে তুলেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো।
This article is written in Bangla, about the role of sate, stated by Adam Smith and Amartya Sen.
All the necessary links are hyerlinked inside.
Feture Image: The Economic Times.