২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ১৬টি বগি নিয়ে দিল্লি থেকে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী স্টেশন আত্তারির দিকে রওনা হয় 'আত্তারি এক্সপ্রেস'। বিশেষ এই ট্রেনটির অপর নাম সমঝোতা এক্সপ্রেস। এই ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন পাকিস্তানি। এদের প্রায় সবাই ভারতে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে দেশে ফিরছিলেন। ট্রেনটি যখন ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথে এসে পৌঁছায় তখন বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রেনের দুইটি বগি আগুন ধরে যায়।
পরবর্তীতে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) এর তদন্ত থেকে জানা যায়, বিস্ফোরণ হওয়া বস্তুগুলো ছিল ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)। ভারতের সরকার সমঝোতা এক্সপ্রেসের হামলাকে তাদের দেশের 'ঐক্য, অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব' এর উপর বড় আঘাত বলে উল্লেখ করেন। এই ভয়াবহ বোমা হামলায় মোট ৬৮ জন প্রাণ হারান। যাদের মধ্যে ৪৩ জন পাকিস্তানি এবং ১০ জন ভারতীয়। বাকি ১৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হরিয়ানার পুলিশ শুরুতে একটি এফআইআর করে। এবং সেখানকার রাজ্য পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু ২০১০ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলার সাথে কারা জড়িত সেটি খুঁজে বের করার জন্য জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএকে দায়িত্ব দেয়। ২০১১ সালের জুনে এই মামলার প্রথম চার্জশিট প্রদান করে এনআইএ। পরবর্তীতে ২০১২ সালের আগস্ট এবং ২০১৩ সালের জুনে সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করা হয়। এই হামলার বিচারের জন্য হরিয়ানায় বিশেষ আদালত বসায় এনআইএ। তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেশ কয়েকজন কট্টর হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীর নাম উঠে আসে। তাদেরকে আটকও করে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু দুঃখজনকভাবে শুধুমাত্র উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান সন্দেহভাজন জঙ্গিরা।
তদন্ত প্রতিবেদনে কী উঠে এসেছিল?
প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, আত্তারি এক্সপ্রেস পানিপথের দিওয়ানা স্টেশন ছাড়ার পর রাত ১১টা ৫৩ মিনিটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে এবং দুইটি বগিতে আগুন ধরে যায়। সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে বোমার পাশাপাশি দাহ্য পদার্থের ব্যবহার করেছিল, ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ট্রেনের ১৬টি বগির মধ্যে দুইটি বগিতে মোট চারটি আইইডি স্থাপন করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে দুইটি আইইডি অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। নয়তো হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়ার সম্ভাবনা ছিল।
পরবর্তীতে এনআইএ তাদের অনুসন্ধানে মোট ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে তারা বিচারের সম্মুখীন করতে সক্ষম হয়। এই চার জনের মধ্যে স্বামী অসীমানন্দ ওরফে নবকুমার সরকার ছিলেন হামলার অন্যতম প্রধান আসামী। কিন্তু তিনি ২০১৫ সাল থেকে জামিন নিয়ে জেলের বাইরে ছিলেন। অন্য সাত অভিযুক্তের মধ্যে কামাল চৌহান, রাজেন্দর চৌধুরী এবং লোকেশ শর্মা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত আম্বালার কেন্দ্রীয় জেলখানায় আটক ছিলেন।
অন্য চার আসামীর মধ্যে অমিত চৌহান, রামচন্দ্র কালসাংরা এবং সন্দ্বীপ ডাঙ্গে এখনো পলাতক রয়েছেন। এই হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সুনীল জোশি। তিনি ২০০৭ সালে মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসে খুন হন। তবে এই হামলার জন্য প্রধান আসামী হিসেবে স্বামী অসীমানন্দকে অভিযুক্ত করে এনআইএ। তিনি হামলার জন্য অন্য আসামীদের প্ররোচিত করেন এবং যাবতীয় অর্থের যোগান দেন। অসীমানন্দ এই হামলা ছাড়াও মক্কা মসজিদ হামলা ও আজমীর শরীফে হামলার সাথেও জড়িত ছিলেন।
কেন সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলা?
বিচারিক আদালতে এনআইএ-র দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে ইসলামী জিহাদী গ্রুপ হামলা করায় স্বামী অসীমানন্দ কিছুটা ক্ষিপ্ত ছিলেন। সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার আগে গুজরাটের অক্ষরধাম, জম্মুর রঘুনাথ মন্দির এবং বেনারসের সঙ্কটমোচন মন্দিরে হামলা হয়। এর ফলে অসীমানন্দ ও তার সহযোগীরা পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেন।
অসীমানন্দ বোমের বদলা বোম দিয়ে নেওয়ার জন্য মনস্থির করেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযুক্তদের সাথে বৈঠক করেন। তারা মসজিদ, মুসলমানদের বড় জমায়েত এবং সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার জন্য পরিকল্পনা করেন। সমঝোতা এক্সপ্রেস পরিকল্পনার মধ্যে রাখার কারণ হলো এই ট্রেনে সাধারণত মুসলমানরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভ্রমণ করে থাকেন।
২০০৬ সাল থেকে হামলার জন্য রাজেন্দর চৌধুরী, সুনীল জোশী, রামচন্দ্র কালসাংরা, লোকেশ শর্মা, কামাল চৌহান, অমিত চৌহান এবং আরো বেশ কয়েকজন মধ্যপ্রদেশের বাঘলি জঙ্গলে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। তারা শক্তিশালী 'টাইম বোম' তৈরি করা এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া তারা বন্দুক দিয়ে হামলা করার জন্যও প্রশিক্ষণ নেন। সবশেষে চূড়ান্ত হামলা করার জন্য অভিযুক্তরা 'সমঝোতা এক্সপ্রেস' ট্রেনকে বেছে নেন। এর পেছনে বড় কারণ ছিল পুরাতন দিল্লি স্টেশনে নিরাপত্তার অভাব। পরিকল্পনা মোতাবেক কামাল, লোকেশ, রাজেন্দর ও অমিত ইন্দোর থেকে পুরাতন দিল্লি স্টেশনে আসেন এবং হামলার আগে তারা বোমাসহ সেখানেই অবস্থান করে। এরপর তারা ট্রেনের মধ্যে বোম ভর্তি স্যুটকেস রেখে সরে পড়েন।
মামলার রায়ে অভিযুক্তদের মুক্তি
২০১০ সাল থেকে হরিয়ানার পাঁচকুলায় এনআইএ-র বিশেষ আদালতে সমঝোতা এক্সপ্রেস হামলার বিচারকার্য চলমান ছিল। এনআইএ এই মামলায় মোট ২৯৯ জনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করে, যাদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন পাকিস্তানি। কিন্তু এই মামলায় পাকিস্তানের কোনো সাক্ষীকে হাজির করা হয়নি। ২৯৯ জনের মধ্যে মোট ২২৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। অনেকে ২০১৩ সালের পর এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা বেশ উদাসীন ছিলেন। তারা শুনানির জন্য ধার্য করা দিনে মাত্র এক থেকে দুই জন সাক্ষীকে হাজির করে বিচারকার্যকে বিলম্বিত করে। যা সাধারণত আসামী পক্ষের আইনজীবীরা করে থাকেন।
এই মামলায় মোট আটজন বিচারকের পরিবর্তন ঘটে এবং সবশেষে বিশেষ এই আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান সিবিআইয়ের বিশেষ বিচারক জগদ্বীপ সিং, যিনি ভারতের আলোচিত গুরু রাম রহিম সিংকে সাজা দেন। কিন্তু সাহসী এই বিচারক স্বামী অসীমানন্দ ও অন্যান্য আসামীদের সমঝোতা হামলার জন্য সাজা দিতে পারেননি। কারণ রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা আসামীদের সাজা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন। ফলে 'বেনিফিট অব ডাউট' এর সুযোগে চার অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যান। তবে রায় প্রকাশের সময় বিচারক এনআইএ এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন। কারণ তাদের ব্যর্থতার কারণেই অভিযুক্তরা আলোচিত এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
সন্ত্রাসীদের সাজা না পাওয়ার পেছনের কারণ
২০০৭ সালে সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার সময় ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। সেই হামলার পরপরই তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপি এই হামলার জন্য পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায়ী করে বিবৃতি প্রদান করে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার এই হামলাকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নের পথকে রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালীন এই হামলার অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের বিপক্ষে লড়াই চালানো যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য বেশ কঠিন। কেননা ভোটের রাজনীতিতে এসব সন্ত্রাসীরা বড় প্রভাবক। সেই কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো সরকারই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখায় না।
কংগ্রেসের আমলে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার জন্য মোট ৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট প্রদান করে। প্রধান আসামী স্বামী অসীমানন্দও শুরুতে তার দোষ স্বীকার করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বলেন শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে এসব কথা বলেছেন। ২০১৪ সালে তিনি ক্যারাভান ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন হামলার সাথে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। একই সাথে এসব হামলার সাথে বিজেপির অঙ্গ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এর নেতা মোহন ভাগবত এবং ইন্দ্রেস কুমারের যোগসাজশ থাকার কথাও বলেন।
স্বামী অসীমানন্দ গত বছরের এপ্রিলে 'মক্কা মসজিদ হামলা' থেকে খালাস পেয়েছেন। সেখানেও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। তখন থেকেই তার সমঝোতা এক্সপ্রেস হামলায় শাস্তি না হওয়ার বিষয়টি আন্দাজ করা যায়। মূলত ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। যার ফলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
সমঝোতা এক্সপ্রেস হামলার মামলা থেকে অভিযুক্তদের খালাসের বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক বলা চলে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বামী অসীমানন্দকে মামলা থেকে খালাস প্রদানের মাধ্যমে একদিকে বিজেপি সরকার হিন্দুদের প্রতি সহনশীল থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অন্যদিকে, তারা হিন্দুত্ববাদীদের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। যাতে করে নির্বাচনের মাঠে তারা ফায়দা লুটতে পারেন। গত ২০ মার্চ সমঝোতা এক্সপ্রেস মামলার রায়ের পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আবারো এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছেন। এর কারণ তারা নির্বাচনের সময় পাকিস্তান বিরোধী জুজুকে টিকিয়ে রাখতে চান।
যাতে ভোটাররা জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে বিজেপিকে ভোট প্রদান করে। এই হামলায় নিহতের মধ্যে সিংহভাগ ছিলেন পাকিস্তানি। সেই কারণেই ভারতের সরকার হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করেনি। এমনকি রায় ঘোষণার পরপরই তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন না বলেও জানিয়ে দেন। রাষ্ট্রপক্ষের এমন আচরণই প্রমাণ করে তারা রাজনৈতিক কারণে হামলাকারীদের খালাস নিশ্চিত করেছেন। তবে এ ধরনের হামলায় মূল অভিযুক্তরা শাস্তি না পেলে ভবিষ্যৎে ভারতকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে।
This Bangla article is about "Samjhauta Express Blast Verdict." Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image Source: AP