Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দক্ষিণ কোরিয়ার স্যাম্পো জেনারেশন

বর্তমান বিশ্বে দক্ষিণ কোরিয়া মানে উন্নত বিশ্বের কোনো এক দেশের প্রতিচ্ছবি- শিক্ষা, গবেষণা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সমরাস্ত্রে ভূয়সী অগ্রসর হওয়া এক দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৫০ এর কোরীয় যুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বর্তমানের মিল খুঁজতে গেলে তাই বেগ পেতে হবে। ‘মিরাকল অব দ্য হান রিভার’ কথার সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত, যার দ্বারা কোরীয় যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বোঝানো হয়। কিন্তু সেই মিরাকল পরবর্তী সময়ের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ঢাকা পড়ে যায় প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক চাকচিক্যের চাদরে।

১৯৬০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া কৃষিজ অর্থনীতির দেশ থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে বদলে যেতে শুরু করে। ‘মিরাকল অব দ্য হান রিভার’ কথার প্রবর্তন করেন দেশটির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী চ্যাং মিওন, ১৯৬১ সালে। তারপরের পঞ্চাশ বছর দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লাগাম কেউ ধরে রাখতে পারেনি। তাদের স্যামসাং, হিউন্দাই, ও এলজি ইলেক্ট্রনিক্সের মতো কোম্পানিগুলো টক্কর দিতে থাকে জাপানের টয়োটা, সনি, ও হোন্ডার মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাথে।

সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া; Image source: Reuters

কিন্তু তিন দশকের লাগাতার গড় প্রবৃদ্ধি ৭ এর উপরে থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই এখন দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ! একাডেমি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সিনেমা ‘প্যারাসাইট’ (২০১৯) এর জনপ্রিয়তার পর সেই বৈষম্যের কথা উঠে আসে পপুলার মিডিয়াতে। দক্ষিণ কোরিয়ান পরিচালক বং জুন হোর বিশেষত্ব- তিনি চলচ্চিত্রে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের গল্প চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপট ধরা পড়ে। বং-এর সিনেমা ‘মাদার’ (২০০৯) এ দেখা যায়, নিম্নবিত্ত পরিবারের এক অসহায় মায়ের গল্প। মূলত, সেই সময় ধরেই দক্ষিণ কোরিয়ার বৈষম্যপীড়িত সমাজ প্রতীয়মান হয় সবার কাছে।

স্যাম্পো জেনারেশন (Sampo Generation)

স্যাম্পো জেনারেশন ধারণার উদ্ভব ২০১১ সালে। মূল শব্দটি samposedae, যার অর্থThree giving-up generation’। দেশটির তরুণ প্রজন্ম অধিক জীবনযাপন ব্যয় ও বেকারত্বের কারণে বিয়ে, সন্তানগ্রহণ, এবং সঙ্গী নির্বাচনে অপারগ হয়। স্যাম্পো জেনারেশনের ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার এখন ১ এর নিচে। বর্তমানে দেশটির জন্মহার প্রতি হাজারে ০.৯। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবীণ জনসংখ্যা ২০৫০ সালে বিশ্বে হবে সর্বোচ্চ। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রবীণ জনসংখ্যার চাপ ঠিক কতগুলো দেশের অর্থনৈতিক দীনতার কারণ হবে তা বলা সময়ের ব্যাপার।  

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে, অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও চাপ এবং চাকরির বাজারে তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে একে Hell Joseon বলা হয়ে থাকে। Joseon দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্বনাম। তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষা, এবং চাকরির ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতা এবং সামগ্রিক হতাশাগ্রস্ত অবস্থার কারণে দক্ষিণ কোরিয়াকে নরকের সাথে তুলনা করে এ নাম দেয়া হয়। পড়ালেখার চাপ ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আচরণের দরুন দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। জাপানের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও আত্মহত্যা, এবং অসুখী সূচকে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি। ন্যাশনাল ইয়ুথ পলিসি ইন্সটিটিউটের করা ২০১৯ সালের এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৩৪% শিক্ষার্থী শিক্ষাক্ষেত্রের চাপের ফলে আত্মহত্যার কথা ভেবেছে।

Image Courtesy: aimeetxt.com

কর্পোরেট সেক্টরে কাজের চাপ, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও কম বেতনের কারণে দক্ষিণ কোরীয়দের আয় খরচের তুলনায় কম। এ কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ঋণের বোঝা বইছে। বহুজাতিক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় বলা হয় Chaebols, যার অর্থ ধনী পরিবার। যেসব মাল্টিন্যাশনাল কংগ্লোমেরাট কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, সেসব কংগ্লোমেরাটদের এখন দায়ী করা হয় অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ হিসেবে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় বড় কোম্পানিগুলো মূলত বেশিরভাগ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলো বেশি বিস্তৃত হতে পারে না। এতে কর্মসংস্থানও বড় বড় কোম্পানির হাতে থাকে যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে চাকরির সুযোগ কম থাকে। অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা প্রবল। জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি ও বেকারত্বের ফলে বিয়ে ও সন্তানগ্রহণ চায় না দক্ষিণ কোরিয়ান বর্তমান প্রজন্ম। বিশেষ করে, নারীরা চায় না চাকরি ছেড়ে সন্তান নিতে। সন্তান পালনের ব্যয়ও এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে জরিপে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নিলেও এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় এখনও বের হয়নি।

এপার্টমেন্টে ঠাসা সিউল শহর; Image Source: The WashingtonPost

বিপুল পরিমাণ দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক এখন বহুসদস্যবিশিষ্ট পরিবার থেকে একক পরিবার হিসেবে বসবাস করছে। সিউলের ছোট্ট এপার্টমেন্ট কালচার যাকে ‘The culture of living alone’ বা Honjok-ও বলা হয়ে থাকে। অবিবাহিত থাকা, ও পরিবার গঠনে অনিচ্ছাই Honjok রীতির মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়।

সামাজিক প্রতিযোগিতার রীতি

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই রয়েছে তুমুল প্রতিযোগিতার রেওয়াজ। একবিংশ শতাব্দীতে সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ব্যাপার নতুন নয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে তা সামাজিক রীতি। ‘Winner Takes it all’ মনোভাবের ফলে অতিভোগের মতো সমস্যাও বাড়ছে। একেবারে শিশুকাল থেকেই প্রতিযোগিতার এ রীতি যেমন চাপ ফেলছে শিক্ষাক্ষেত্রে, ঠিক তেমনি চাকরিক্ষেত্রেও। 

সর্বক্ষেত্রে এই মানসিকতা একে তো বৈষম্যের মনোভাব সৃষ্টি করছে, সেই সাথে চাপ সৃষ্টি করছে সৃজনশীল মানসিকতা গঠনে। ফলে তরুণ প্রজন্ম সামাজিকক্ষেত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। বাড়ছে মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহল গ্রহীতার সংখ্যা। এই মনোভাব দক্ষিণ কোরিয়ার ‘জুয়া মহামারির’ জন্যও দায়ী। বিশেষ করে, ঋণগ্রহীতারা সহজে বিপুল অর্থলাভের আশায় গ্যাম্বলিং বা জুয়ার ফাঁদে, এবং পরবর্তীতে ঋণদাতা চক্রের ফাঁদে পড়ে। সামগ্রিকভাবে, এর ফলে সর্বস্ব হারিয়ে দেউলিয়া হয় অনেকে।

উন্নয়নশীল এবং উন্নত বিশ্বের জন্য ভবিষ্যতে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষ্যমের প্রশমন যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি ভাল থাকা এবং নিত্য নৈমিত্তিকভাবে সুখী থাকার ব্যাপারও সমান জরুরি। জাপানসহ ইউরোপের বাল্টিক দেশগুলো অর্থনৈতিক সচ্ছলতার ফলে যে সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন অনেক আগেই হয়েছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়াও নতুন নয়।

দেশটির প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তরুণ প্রজন্মের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিযোগিতার চাপ, ও এর ফলে সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির সমাধান করার কথা বলেছিলেন। তার মতে, Chaebol বা বড় কোম্পানিগুলোর বাজার দখলের অধিক ক্ষমতা হ্রাস, কর্মঘণ্টা হ্রাস ও কর্মীদের ওপর চাপ কমানোর মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার আশাবাদী প্রবীণ জনগোষ্ঠী মনে করে, ‘স্যাম্পো জেনারেশন’ এর বিয়ে ও সন্তানগ্রহণ না করার এ রীতি সাময়িক। তাদের মতে, তরুণ প্রজন্ম খুব জলদিই এ অবসাদ ও বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠবে।

Related Articles