গত অক্টোবরে পশ্চিম ভারতের গুজরাট প্রদেশে নর্মদা নদীর উপরে সর্দার সরোবর বাঁধের কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গৃহমন্ত্রী এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের এক বিরাট লৌহমূর্তি। বিরাট বললেও কম বলা হয়, কারণ এই মুহূর্তে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মূর্তি, উচ্চতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দুইগুণ। স্বাভাবিকভাবেই, মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তার সমর্থকরা উল্লসিত। তাদের দাবি, সর্দার প্যাটেলকে এই প্রথমবার কেউ সত্যিকারের সম্মানপ্রদান করল।
আপাতদৃষ্টিতে এই মূর্তির স্থাপনা সাধারণ জ্ঞানপিপাসুদের উৎসাহিত করলেও ১৮২ মিটার উঁচু এবং প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি এই কাঠামোটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকটাই।
সর্দার প্যাটেল সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে গেরুয়া বাহিনীর কাছে বেশ মূল্যবান এক ব্যক্তিত্ব। এই মুহূর্তে ভারতে যে জাতীয়তাবাদী প্রকল্প বেশ জোরকদমে এগিয়ে চলেছে, তাকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের কাণ্ডারীদের প্রয়োজন অতীতের ব্যক্তিত্বদের। সমস্যা হচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিত্ব গেরুয়া শিবিরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, কারণ সে সময়ে যা করেছে তা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বই। কিন্তু জাতীয়তাবাদের একটি বিকল্প কাঠামো তৈরি করতে প্রয়োজন অতীত থেকে এমন কাউকে, যাকে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র থেকে পৃথক করে দেখা যায়। এক রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, পরিচয়তেও যিনি গুজরাটি। কিন্তু গান্ধীকে কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে পুরোপুরি এক করে ফেলা সম্ভব নয়। এক তো তিনি একজন জাতীয় নেতা আর দুই, তার মতাদর্শের সঙ্গে আজকের শাসকের মিল রয়েছে খুব কম। গান্ধীকে রাজনৈতিকভাবে 'হাইজ্যাক' করা বিজেপির পক্ষে বিশেষ সম্ভবপর নয়।
অতএব, বাকি থাকলেন প্যাটেল। প্যাটেল মোদী এবং বিজেপির রাজনীতির জন্যে অনেক বেশি যুৎসই এবং সেটা দলের বাঘা বাঘা মস্তিষ্করা ভালোই জানেন। যদিও গৃহমন্ত্রী হিসেবে প্যাটেল মহাত্মা হত্যার পরে নিষিদ্ধ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে, কিন্তু সে তো অনেককাল আগে, তার জীবদ্দশায় যখন রাজনীতির গতিপ্রবাহ অন্য ছিল। আজকে সেই প্যাটেলই পদ্মদলের রাজনীতির জন্যে প্রয়োজনীয় বেশ কিছু কারণে।
প্রথমত, প্যাটেল ছিলেন সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা। এবং যেহেতু মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি আজ নেহরুর ইতিহাসকে মুছে দিতে তৎপর, বিশ্বের সামনে এটাই প্রমাণ করতে মরিয়া যে নেহরুর 'ভুলভ্রান্তি' ভরা শাসন নয়, প্রকৃত শক্তিশালী ভারতের নির্মাতা আসলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই, তখন জাতীয় প্রকল্প নির্মাণে প্যাটেলই তাদের কাছে হয়ে দাঁড়ান অতীতের সেই যুগপুরুষ যার থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া যায়। প্যাটেলের গুজরাটি পরিচয়টিও আরেক বড় কারণ তার প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন কিন্তু আসল কারণটি হচ্ছে তাকে গ্রহণ করে, তার কৃতিত্বের ঢক্কানিনাদে নেহরুর উচ্চতাকে খাটো করা।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্যাটেলের সুনাম। যেহেতু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে প্যাটেলের নেতৃত্বেই ভারতের ঐক্যকরণ হয়েছিল, শয়ে শয়ে রাজা-রাজড়ার আখড়াকে এক ছাতার তলায় তিনি এনেছিলেন এক বজ্রকঠিন অবস্থান নিয়ে, তা আজকের হিন্দুবাদী রাজনীতিকদের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ, এর মধ্যে যেমন একদিকে সর্দারের কাঠিন্যের নীতিকে প্রশংসা করে বলা যায় যে, দেশের আসল ঐক্যের রূপকার তিনিই, মিনমিনে অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী নেহেরু নন, অন্যদিকে তার মডেলকে সামনে রেখে আজকের দিনে ফের এক হিন্দুবাদী ঐক্যের পথকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চলার ডাক দেওয়া যায়। যদিও প্যাটেলের সেই জাতীয় ঐক্যকরণের কার্যটি ছিল মূলত ভৌগোলিক আর বিজেপির আজকের জাতীয় ঐক্যকরণের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে এক সাংস্কৃতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং দুইয়ের মধ্যে আছে শতযোজন ফারাক, তবুও কোথাও না কোথাও মোদী আজকে প্যাটেলের সঙ্গে তার রাজনীতিকে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন। নর্মদার ধারে বিশালাকার মূর্তিটিও তারই প্রমাণস্বরূপ।
তৃতীয়ত, প্যাটেলকে নিয়ে উদযাপন করা মানে একদিকে যেমন নেহরুকে আড়াল করে দেওয়া, নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রীকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করা আবার অন্যদিকে ৩১ অক্টোবর প্যাটেলের জন্মদিন ঘটা করে পালন করা মানে ভারতের আরেক প্রধানমন্ত্রী- ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুদিন- অর্থাৎ সেই ৩১ অক্টোবরকেও মানুষের মনে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া। নেহরুর কন্যা ইন্দিরাকে আজও ভারতের এক বড় শ্রেণীর মানুষ ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্ৰধানমন্ত্ৰী হিসেবে মনে করে এবং নিজেরই নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে তার অকালপ্রয়াণ আজও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্যতম কলঙ্কিত দিন হিসেবে দেখা হয়। এ যাবৎ ৩১ অক্টোবরকে প্যাটেলের জন্মদিন থেকে ইন্দিরার মৃত্যুদিন হিসেবেই বেশি দেখা হয়েছে। ধুরন্ধর মোদী এবং তার দল প্যাটেলকে ফের প্রাসঙ্গিক করলেন এবং তাতে ইন্দিরা চলে গেল পিছনের সারিতে। মাস্টারস্ট্রোক আর কাকে বলে!
মোদী নিজে যেহেতু পূর্বে গুজরাট প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেসরকারি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ নজর দিয়েছেন। সরকারে থেকেও তিনি 'ভাইব্র্যান্ট গুজরাট'-এর মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেখিয়েছেন যে তার আমলে, সরকার সম্পূর্ণভাবেই উন্নয়ন-পন্থী এবং বিদেশী বিনিয়োগ, বাণিজ্য ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি রাজ্যের উত্থান চান। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও মোদী সরকার সেই একই ভাবধারা 'মেক ইন ইন্ডিয়া', 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া', 'স্কিল ইন্ডিয়া', 'স্মার্ট সিটি' ইত্যাদি নানা প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন। এই প্রত্যেকটি প্রকল্পই উন্নয়নমুখী, বিনিয়োগ-ভিত্তিক আর সেখানেও মোদী সোজাসুজি নাকচ করেছেন নেহরুবাদী সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারণাকে, যা আজও বিরোধী দল কংগ্রেস পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গেও প্যাটেলের মূর্তিটি প্রাসঙ্গিক কারণ এক দিকে প্যাটেলের নিজস্ব অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা নেহরুর মতো সমাজতান্ত্রিক ছিল না আর দ্বিতীয়ত, প্যাটেলের মূর্তিটি ওই অঞ্চলে পর্যটনশিল্পে জোয়ার আনবে এবং তা আখেরে লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা করবে সরকারি কোষাগারেই। সবমিলিয়ে, প্যাটেলের মাধ্যমে আর্থ-রাজনীতির বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছেন মোদী। গুজরাটে প্রতিষ্ঠিত সর্দার প্যাটেলের বিশালবয়ব লৌহমূর্তিটি প্রকারান্তরে তার রাজনীতিরই এক পূর্ণ প্রতীক।
প্যাটেলকে সামনে রেখে মোদী যেভাবে তার রাজনৈতিক কৌশলটিকে সাজিয়েছেন, তা দেখে চমৎকৃত না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই তিনি এই মূর্তির উন্মোচন করলেন যাতে ফের কংগ্রেসকে খোঁটা দিয়ে দিয়ে জনমানসে প্যাটেলের প্রতি নেহরুর 'অন্যায়-অবিচার'-এর কাহিনীটিকে ফের তাজা করতে পারেন। গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও এটি ছিল মোদী এবং বিজেপির এক অন্যতম বড় পন্থা এবং পরবর্তী ভোটে নেহরুর বংশধর অর্থাৎ কংগ্রেসের বর্তমান অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীকে ফের যাতে কুপোকাত করা যায় এই একই অস্ত্রে, সে ব্যাপারে মোদী সম্পূর্ণ সজাগ।
বিরোধীরা এখন কীভাবে এর মোকাবেলা করেন, দেখার এখন সেটাই।
This article is in Bangla, written on Ballav Patel's statue in India and politics of Narendra Modi.
Featured Image Source: Quartz