Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি বোঝাপড়ায় গেম থিওরি

‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’ মুভির কথা বলতেই আপনার দৃষ্টিতে কার ছবি ভেসে ওঠে? স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত এক প্রফেসর, যিনি একাকী বসে নানা আঁকিবুঁকি করেন বলে শিক্ষার্থী ও ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা তাকে পাগল বলে ডাকত? হ্যাঁ, সেই প্রফেসরের কথাই বলা হচ্ছে। তার আসল নামটা মনে আছে নিশ্চয়ই? জন ফোর্বস ন্যাশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ন্যাশের জীবনের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে অস্কারজয়ী ‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’ সিনেমাটি।

কতটা বিচক্ষণ ও মেধাবী ছিলেন জন ন্যাশ, তা একটা বিষয় বললেই আপনি অনুমান করতে পারবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই যখন পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো এক নতুন গতিপথে চলতে শুরু করেছে (বিশ্বায়ন ও স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা), সে সময় মাত্র ২১ বছরের ন্যাশ এমন এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন, যা পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানতাত্ত্বিকের চিন্তার সমুদ্রে ঢেউ তুলল। আলোড়িত করে গেল পূব থেকে পশ্চিমের ঝানু সব গণিতবিদের ভাবনার ক্যানভাস।

আপনি ভাবছেন, নিশ্চয়ই দুই হাজার পৃষ্ঠার ইয়াব্বড় এক গবেষণা ছিল সেটা? নাহ্। মাত্র ২৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট কলেবরের একখানা গবেষণা তাকে শেষমেশ নোবেল বিজয়ী করল।

তবে মজার ব্যাপার হলো, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগপর্যন্ত কেউ তেমনভাবে জানতই না যে একা একা কথা বলা, ছোট্ট বাচ্চার মতো মাটিতে কীসব আঁকাআঁকি করা ন্যাশের মাঝে এতসব প্রতিভা লুকিয়ে আছে; এমনকি ন্যাশ নিজেও জানতেন না।

আজকের আয়োজনে আমরা আলোচনা করবো নোবেলজয়ী এই প্রফেসরের দেওয়া বিখ্যাত গেম থিওরি নিয়ে। ও হ্যাঁ, তার সেই গবেষণাপত্রের নামটাই তো বলা হলো না। তার গবেষণার নাম ছিল ‘নন কো-অপারেটিভ গেম’, যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। আর তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এই গবেষণার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর, ১৯৯৪ সালে।

http://freehdw.com/wallpaper/john-nash-scientist-celebrity-death-2015-146722.html
অধ্যাপক জন ফোর্বস ন্যাশ; Image Source: India Times

গেম থিওরিকে বাংলায় বলা যায় ক্রীড়াতত্ত্ব। মূলত তিনি এই তত্ত্বটি দিয়েছেন গণিত ও অর্থনীতির ‍দৃষ্টিকোণ থেকে। পরবর্তী সময়ে সেটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, কম্পিউটার বিজ্ঞান, এবং অধুনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবারনেটিক্সে দারুণভাবে প্রয়োগ হচ্ছে।

গেম থিওরির প্রস্তাবনা

গেম থিওরি এমন দুজন খেলোয়াড়কে নিয়ে আলোচনা করে, যারা সমমানের দুটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ করতে চায়। এটা হতে পারে দুটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা অন্য কিছু। এই দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিপরীত চিন্তার মানুষ বা প্রতিষ্ঠানকে একটা সূক্ষ্ম লুপে আটকে পড়ে একে অপরের মাঝে নেগোশিয়েশন করতে হয়; উভয়কেই পরস্পরের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ক ও খ দুটি অনলাইন বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি বইয়ে ক এবং খ উভয় প্রতিষ্ঠানই ১০০ টাকা করে ডেলিভারি চার্জ নেয়। একদিন ক ভাবল, আমি যদি ডেলিভারি চার্জ ৫০ টাকা কমিয়ে আনি, তাহলে তো আমার বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে। খরচে কম পেয়ে খ-এর অনেক ক্রেতা আমার কাছে চলে আসবে। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। ক এই ঘোষণা প্রচার করে দিল।

এবার কিন্তু ঠিকই কাজ হলো। ৫০ টাকা ছাড় পেয়ে খ-এর অনেক ক্রেতা ক-এর কাছে চলে এল। বাস্তবেও এটাই হওয়ার কথা, সস্তায় পেলে কোন যুক্তিতে বেশি দিয়ে কিনবে?

যা-ই হোক, ক্রেতা ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে দু’দিন বাদে খ-ও ডেলিভারি চার্জ ৫০ টাকা করে কমিয়ে দিলো। একটা বিষয় দেখুন, দিন শেষে দুই প্রতিষ্ঠানই ডেলিভারি চার্জ ৫০ টাকা কমিয়ে দিল, এতে উভয়েরই অবশ্য নতুন কিছু ক্রেতা জুটল; এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাবসোলিউট প্রফিট আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ল, কিন্তু তুলনামূলক লাভ (রিলেটিভ প্রফিট) আগে যা ছিল, তা-ই থাকবে। ফলে পুরো ব্যবস্থাটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এই অবস্থাকে বলে ন্যাশ সাম্যাবস্থা (Nash equilibrium)।

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পুরো বাজারকাঠামোই কিন্তু চলে এ তত্ত্বের উপর। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজার-কাঠামোতে আপনি চাইলেই পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়ে বেশি আয়ের চিন্তা করতে পারেন না। একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করতে হয়।

এটাই হলো ক্রীড়াতত্ত্বের সরলীকৃত একটা বয়ান। মূলত তাত্ত্বিকভাবে এটা আরো জটিল। আজকের আলোচনায় যেহেতু গেম থিওরির রাজনৈতিক দিকটি ফোকাস করা হবে, তাই আর সেই জটিল গাণিতিক আলাপে যাওয়া হবে না।

গেম থিওরির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে একটা মজার ধাঁধা বলে নেয়া যাক।

প্রিজনার্স ডিলেমা

ব্যাংকলুটের মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেল একটি গোয়েন্দা দল। আসামী দুজন। ধরা যাক, তাদের নাম মাইলস ও জ্যাক; দু’জনই মাফিয়া ওয়ার্ল্ডের সদস্য। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থেকে উভয়ই ‘লজিক’ ধারণ করে। প্রচণ্ড চতুর। কে সম্ভাব্য চোর, এটা বের করার কোনো ক্লু নেই গোয়েন্দা দলের হাতে। এবার সত্যিকারের চোর বের করতে তাই গোয়েন্দারা তাদেরকে ডেকে কিছু শর্ত শুনিয়ে দিল:

১) মাইলস যদি জ্যাককে দোষী বলে, আর জ্যাক যদি এতে চুপ থাকে, তাহলে মাইলস ছাড়া পাবে; আর অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় জ্যাককে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। বিপরীতক্রম প্রযোজ্য। (একজনের বিশ্বাসঘাতকতা, অপরজনের সহায়তা)

২) জিজ্ঞাসাবাদে যদি দুজনই দুজনকে দোষারোপ করে, অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজেকে নির্দোষ আর অপরজনকে দোষী বলে, তাহলে তাদের উভয়কে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হবে। (পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা)

৩) যদি তারা কেউ কাউকে দোষারোপ না করে, অর্থাৎ উভয়ই এ ব্যাপারে চুপ থাকে, তবে প্রত্যেকের ২ বছর করে কারাদণ্ড হবে। (পরস্পর সহযোগিতা)

গেম থিওরি দাবি করে, এই তিন শর্ত একযোগে চিন্তা করে আসামীরা একধরনের উভয় সংকটে পড়ে যাবে। কীভাবে?

প্রথমেই মাইলস চিন্তা করল, আমি যদি জ্যাককে দোষী বানিয়ে দিতে পারি, আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারি, তাহলে তো বেশ হয়। আমি মুক্তি পেয়ে যাবো, জ্যাককে ৬ বছরের সাজা পেতে হবে। বাহ! কী বুদ্ধি আমার মাথায়। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…

কিন্তু পরক্ষণেই তার মাথায় এলো, জ্যাকও যদি একইভাবে আমাকে দোষী প্রমাণ করে নিজে খালাস পেতে চায়, আদতে চাইবেও তা-ই, তাহলে তো দুজনই দুজনকে দোষারোপ করা হয়ে যাবে। শর্ত ২-এর আওতায় পড়ে দুজনকেই ৪ বছর করে কারাভোগ করতে হবে।

এভাবে পুরো খেলাটা একটা লুপের মতো করে চলতে থাকবে। ফলে আসামী দুজনের মাঝে একধরনের সহযোগিতার (Cooperative) মনোভাব তৈরি করবে। তারা যেহেতু নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করতে পারছে না, তাই পরস্পরের মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করবে। তারা মনোযোগ দেবে শর্ত তিনের দিকে। অর্থাৎ, কেউ কারো ব্যাপারে কোনো তথ্য দেবে না, উভয়ই চুপ থাকবে। এতে অন্য দুই শর্তে দেওয়া সাজার চেয়ে কম সাজা ভোগ করতে হচ্ছে।

মূলত প্রিজনার্স ডিলেমার কথা বিবেচনা করেই কিন্তু মাফিয়া বা অন্যান্য প্রশিক্ষিত অপরাধ চক্রের সদস্যরা পরস্পরের ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। যতই রিমান্ড দেওয়া হোক, তারা কেউ কারো ব্যাপারে মুখ খুলবে না।

এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলে নন-জিরো-সাম-গেইম; দুজনই দু’জনের জায়গা থেকে সন্তুষ্ট থাকবে। যেখানে হার-জিতের কোনো ডাইকোটমি তৈরি হবে না। বলা যায়, খানিকটা উইন-উইন অ্যাপ্রোচ। বিপরীতে জিরো-সাম-গেইম হলো, একজন জিতবে, অপরজন হারবে; কিন্তু গেমটা অবশ্যই বিদ্যমান থাকবে।

https://www.pinpng.com/picture/iTbxJJx_its-actually-a-classic-game-theory-problem-that/
প্রিজনার্স ডিলেমার সম্ভাব্য ফলাফল; Image Credit: crossbeam

ভূরাজনীতি গেম থিওরি

ক্রীড়াতত্ত্বে যে কনস্ট্যান্ট খেলার কথা বলা হয়েছে, এ প্রক্রিয়া হাজার বছর আগের অঞ্চলভিত্তিক রাজাদের শাসনামলেও দেখা যেত। প্রাচীন রাজনীতিতে ব্যবহৃত গেম প্ল্যানই মূলত গেইম থিওরির আদি রূপ। কোনো রাজ্যের সাথে কখন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, কখন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করতে হবে, কখন কোন রাজ্য আক্রমণ করতে হবে, আবার কখন নিজ রাজ্য টিকিয়ে রাখতে শত্রুর সাথেও সহাবস্থানে যেতে হবে, এই সবকিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে তৈরি হয়েছে গেম থিওরি।

কৌটিল্যের বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের কথা কম-বেশি আমরা অনেলেই জানি। মূলত ‘অর্থশাস্ত্র’-এর পুরো ভিতটাই গড়ে উঠেছিল গেম থিওরির উপর ভর করে। কৌটিল্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমীকরণ টেনে জনরোষ ও বহিরাগত শত্রুর ষড়যন্ত্র থেকে রাজাকে হেফাজতের কৌশল বের করতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন ফরেন পলিসিতে এই তত্ত্বটি ছিল প্রধান নিয়ামক। মার্কিন নৌ-বাহিনীর ফান্ডিংয়ে পরিচালিত র‌্যান্ড কর্পোরেশন সর্বপ্রথম মার্কিন রাজনীতিতে গেম থিওরির ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তাব করে। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টা মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ র‌্যান্ডের প্রস্তাবিত গেম থিওরির আদলে চলে।

বর্তমান সময়েও ভূরাজনৈতিক সমীকরণে এ তত্ত্বের প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো। চলুন কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক:

ভারত-চীন সঙ্কট

ভারত-চীনের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা ও যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব এখন মিডিয়ার হট-টপিক। নিয়মিতই এ বিষয়ে নানা ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ উঠে আসছে গণমাধ্যমে। লাদাখ ইস্যুতে চীনের হার্ডলাইনের পরিণতিতে একটি বহুপাক্ষিক যুদ্ধকেই সম্ভাব্যজ্ঞান করছেন অনেকে। মূলত লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল কখনোই মেনে নেয়নি চীন। জনসন লাইন, ম্যাকডোনাল্ড লাইন, এবং সর্বশেষ ম্যাকমোহন লাইন (১৯১৪)- এর কোনোটিকেই স্বীকৃতি দেয়নি দেশটি। লাদাখকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আকসাই চীনের সাথে যুক্ত করাই বেইজিংয়ের একমাত্র লক্ষ্য।

এখন প্রশ্ন হলো, লাদাখ ইস্যুকে কেন্দ্র করে কি দুই দেশ আসলেই যুদ্ধে জড়াবে? এই প্রেডিকশনকে মূলত গেম থিওরি জাস্টিফাই করবে।

http://welcomeqatar.com/news/qatar-news/india-china-clash-20-indian-troops-killed-in-ladakh-fighting/attachment/_112941279_gettyimages-1220444788/
লাদাখ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করছে দু’পক্ষ; Image Credit: Getty Images

গত জুনে সংঘর্ষে ভারতের ২০ সৈন্য নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে নয়াদিল্লির কাছে পরিষ্কার বার্তা এসেছে, চীন এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলতেও পিছপা হবে না। এদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও নাজুক। বন্যা, করোনা-পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক মন্দা, জিডিপি গ্রোথ নেগেটিভে, কৃষকরা করছেন আত্মহত্যা, অপরদিকে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সাথে শীতল সম্পর্ক- এসব কিছু মোদিকে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়াতে কোনোভাবেই সায় দেবে না।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিক সমাধানের দিকে ছুটছে নয়াদিল্লি। মস্কোতে দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠক হলো কিছুদিন আগেই। এছাড়াও ভারত সম্ভাব্য সবধরনের কূটনীতি প্রয়োগে এ বিবাদ মীমাংসা করতে চাচ্ছে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা বরাবরের মতোই ব্যর্থ হয়েছে। বেড়েছে দোষারোপের মাত্রা, অব্যাহত থেকেছে এ অঞ্চলের সামরিকীকরণ। এমতাবস্থায় ভারতের সর্বশেষ হাতিয়ার হলো গেম থিওরি।

দক্ষিণ চীন সাগর। জাতিসংঘের সংস্থা UNCTAD-এর তথ্যমতে, সারা বিশ্বে সমুদ্র পথে যে বাণিজ্য হয়, তার ৭০ ভাগই হয় এই সাগরের বুক চিরে। আর এককভাবে চীনের মোট বাণিজ্যের ৬৫ শতাংশ হয় এখান দিয়েই। দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে চলছে চীনের বিবাদ। চীনের দাবিকৃত নাইন-ড্যাশ-লাইন নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের সাথে উত্তেজনা চলছে। সুদূর আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই উত্তেজনায় যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। দক্ষিণ চীন সাগর চীনের জন্য এমন এক প্রাণভোমরা, যদি এখানকার বাণিজ্যিক পথ কোনোভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে সেটা চীনের অর্থনীতিতে হঠাৎ ধ্বস এনে দেবে। মূলত চীনের পুরো বাণিজ্যিক কাঠামোই দক্ষিণ চীন সাগরনির্ভর।

২০০ নটিক্যাল সীমার বাইরে গিয়ে কৃত্রিম দ্বীপে মিলিটারি বেজ নির্মাণ করছে চীন; Image Credit: Philippine Daily Inquirer

ইউরোপ-আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশের পথ হলো মালাক্কা প্রণালী। বিশ্বে সমুদ্র পথে যত পণ্য পরিবহন করা হয়, তার ৬০ ভাগ হয় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। এই প্রণালীকে বলা হয় ভারত-চীনের ভবিষ্যৎশক্তি পরিমাপের থার্মোমিটার।

এর একেবারে প্রবেশমুখেই ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুযায়ী, সীমান্তরেখা বা বেসলাইন হতে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রের আঞ্চলিক সমুদ্র বা টেরিটোরিয়াল সি। সেই হিসেবে মালাক্কায় প্রবেশের পুরো জলভাগই ভারতের মালিকানায় পড়ে। এমতাবস্থায় আন্দামানে থাকা ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক বেজ যদি মালাক্কার প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয়, তবেই চীনের সাথে ভারতের সব হিসেব চুকে গেল। মালাক্কা হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটির এত বেশি নির্ভরশীলতা, যে একদিনের জন্যও এ পথ ধরে বাণিজ্য বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় লাদাখ বিষয়ে একধরনের সহাবস্থানে বা সমাধানে আসার চেষ্টা করবে চীন। একধরনের সাম্যাবস্থায় ফিরে আসবে বিপরীত চিন্তার প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দেশ। এটিই মূলত ‘ইফেক্ট অভ গেম থিওরি’।

মালাক্কা প্রণালী; Image Credit: Travelmarg

চীন অবশ্য এই গেম-লুপ থেকে বের হয়ে আসার জন্য সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে নির্ভরশীলতা কমানোর নীতি বাস্তবায়নে কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশটি। এই প্রকল্পের অধীনে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে করাচি-ইসলামাবাদ হয়ে পাকিস্তানের গাদার বন্দর পর্যন্ত বাণিজ্যিক সড়ক নির্মাণ করবে চীন। এতে পাকিস্তানের গাদার বন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকায় নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করবে দেশটি। প্রকল্প-ব্যয়ে ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বেইজিং। দক্ষিণ চীন সাগরে ট্রান্সপোর্ট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলেছে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০৩৫ সাল নাগাদ। আর ততদিন পর্যন্ত চীনের সাথে হওয়া যেকোনো বিবাদে গেম থিওরির আশ্রয় নেবে ভারত।

তুরস্ক-গ্রিস সঙ্কট

সাম্প্রতিক সময়ে ভূমধ্যসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে তুরস্ক-গ্রিস সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ভূমধ্যসাগর-গর্ভে থাকা ১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট একটি দ্বীপ নিয়েই এই বিরোধের সূত্রপাত। তুরস্কের জনগণের কাছে এটা মেইজ আইল্যান্ড নামে পরিচিত, আর গ্রিসে পরিচিত কাস্তেলোরিজো নামে।

বিরোধপূর্ণ কাস্তেলোরিজো আইল্যান্ড; Image Credit: globalsecurityreview

মজার ব্যাপার হলো, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দ্বন্দ্বটাকে তুরস্ক-গ্রিসের মধ্যকার দেখানো হলেও এখানে তৃতীয় এক শক্তির সরব উপস্থিতি আছে। আর সেটা হলো ফ্রান্স। আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। তাছাড়া ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্বটাও ঐতিহাসিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির সাথে পর্যায়ক্রমে দুটি চুক্তি সই করতে বাধ্য হয়: সেভ্রেস চুক্তি এবং লুজান চুক্তি। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে মূলত অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং তুরস্কের শক্তি চরমভাবে খর্ব হয়। আর ফ্রান্স ছিল তৎকালীন এই চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে।

লিবিয়া ইস্যুতে ফ্রান্সের তুরস্কবিরোধী অবস্থান এ শত্রুতায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। কুর্দিদের উস্কানি দিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে সহায়তা করছে ফ্রান্স, এমন শক্ত অভিযোগও আছে। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে জোটভুক্ত হয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্কের হম্বিতম্বি মোকাবেলায়ও কাজ করে যাচ্ছে ফরাসি প্রতিরক্ষা বিভাগ।

মূলত চলমান এ সংকটে গ্রিসের চেয়ে ফ্রান্সকেই বেশি আগ্রাসী মনে হয়েছে। ‘অতি উৎসাহী’ ফ্রান্স তার বিমানবাহী রণতরী ‘শার্ল দ্য গল’কে ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধ-প্রস্তুতি দিয়ে পাঠিয়েছে।

তো, তুরস্ক-গ্রিস (আদতে তুরস্ক-ফ্রান্স) দ্বন্দ্বের এই অবস্থাকে আমরা গেম থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। গেম থিওরির একটা মডেল হলো ‘চিকেন মডেল’।

চিকেন মডেল যুদ্ধ-যুদ্ধ সম্পর্কের দুই দেশকে বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুটি গাড়ির সাথে তুলনা করে। এর মধ্যে একটি গাড়ির ব্রেক নষ্ট এবং চালকের চোখে কাঠের চশমা। অর্থাৎ, এই ড্রাইভার তার সামনের কিছুই দেখতে পায় না (মূলত দেখতে চায় না)। এই গাড়িটির তুলনা হলো শক্তিশালী দেশটির সাথে। আর বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িটির ড্রাইভার সবকিছু দেখে-শুনে পথ চলে। রাস্তার বাঁকে বাঁকে প্রয়োজনে ব্রেক কষে। এই গাড়িটি তুলনামূলক কম শক্তিশালী দেশ।

এমতাবস্থায় গাড়ি দুটির মধ্যে সম্ভাব্য মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে দ্বিতীয় গাড়ির চালকের উপর। এক্ষেত্রে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে:

১) দ্বিতীয় গাড়ির চালক পাশ কাটিয়ে চলে গিয়ে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে পারে।

২) নিজের গতিপথে অটল থেকে প্রথম গাড়ির সাথে সংঘর্ষে জড়াতে পারে।

এক্ষেত্রে একটা বিষয় খুবই মজার। শক্তিশালী রাষ্ট্রটি যদিও নানা হম্বিতম্বির মাধ্যমে তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ করে, কিন্তু যুদ্ধ বাধুক, এটা তারাও আসলে চায় না। তারা ভাবে, তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যাবে। এতে প্রতিপক্ষ কার্যত হেরে গেলেও অসন্তুষ্ট থাকবে না। শক্তিশালী রাষ্ট্রটিও নিজের শক্তিমত্তার জানান দিয়ে গেল ফাঁকে।

কার্যত হয়েছেও তা-ই। ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরী ‘শার্ল দ্য গল’ ভূমধ্যসাগরে নামার পর তুরস্ক কিছুটা পেছনে সরে আসে। হঠাৎই এরদোয়ান প্রশাসন কূটনীতিক আলাপে বসার আহ্বান জানায় গ্রিসকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্বর নমনীয় হয়ে আসে।

মূলত ফ্রান্স-তুরস্ক, কেউই এক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের চিন্তা করছিল না। ফ্রান্স চাচ্ছিল কাঠের চশমা পরে ড্রাইভ করতে, তুরস্ক যাতে নমনীয় হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এতে উত্তেজনাও কমল, আবার ফ্রান্সও শক্তিমত্তার জানান দিতে পারল। সবমিলিয়ে একটা উইন-উইন অ্যাপ্রোচ তৈরি হলো।

গেম থিওরির কার্যকারিতা

গেম থিওরির কল্যাণে আন্তর্জাতিক অনেক বড় বড় সংঘাত আপনা-আপনিই সাম্যাবস্থায় ফিরে এসেছে। সম্প্রতি ইরানের উপর পুনরায় বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে দ্য সিউল টাইমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাঙ্গেরিতে ইরানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আগা বনিহাশেমি স্পষ্টতই বলেছেন, চলমান নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি গেম থিওরির আশ্রয় নেবে তেহরান; বরং এক্ষেত্রে গেম থিওরিকেই প্রাধান্য দিবে তেহরান প্রশাসন, এমনটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে ইরানের সেই সম্ভাব্য গেম থিওরির ধরন-প্রকৃতি এখনও আঁচ করতে পারেননি বিশ্লেষকেরা।

গেম থিওরিকে আন্তর্জাতিক শক্তি-সাম্যের এক কার্যকরী প্রভাবক বলা যায়। এই তত্ত্বের প্রয়োগে যদি পৃথিবীতে আরও কিছুদিন শান্তি বজায় থাকে, যুদ্ধ-বিগ্রহ কিছুটা হলেও কমে যায়, তাতে কল্যাণ বৈ অকল্যাণ তো নেই। তবে এর অপপ্রয়োগ যে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের মতো ঘটনার জন্ম দিতে পারে, ইরানের প্রভাব রোধে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্ত্রের বাজারে পরিণত করার মাধ্যমে আঞ্চলিক সংঘাতও ছড়িয়ে দিতে পারে, সেই সত্যও অস্বীকার করার অবকাশ নেই।

Related Articles