তবে প্রাচীনকালে নৌপথের সংঘর্ষগুলো শুরু হতো পণ্য পরিবহণ কিংবা মোটামুটি দূরের পথে যাতায়াতকে কেন্দ্র করে। তারও বহু সময় পরে বড় পরিসরে নৌযুদ্ধের ধারণা তৈরি হয়। আধুনিকতম নৌযুদ্ধগুলো বিশ্ব রাজনীতির চিত্র মুহূর্তেই পাল্টে দিতে সক্ষম। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোও তাদের সাম্রাজ্যগুলো বিস্তার করতে পেরেছিল শক্তিশালী নৌবাহিনী দিয়েই।
তাই সামরিকভাবে সক্ষম দেশগুলো প্রতিনিয়ত ভূ-ভাগের মতো জলপথেও সমান শক্তিশালী হতে সদা তৎপর। আর এসব তৎপরতায় প্রযুক্তির বিকাশ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তাদের জন্য। যার ফলশ্রুতিতে অত্যাধুনিক সব রণতরী যুক্ত হচ্ছে তাদের বহরে।
বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকটি দেশের নৌবাহিনীর কথাই থাকছে আজকের লেখায়, যেখানে উঠে আসবে এসব বাহিনীর রসদ-সক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের প্রভাব।
১. যুক্তরাষ্ট্র
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমেরিকানরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। তার বদলে তারা নতুন কৌশলে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
নয়া কৌশল অনুসারে অঞ্চলকেন্দ্রিক যুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করে তারা। ফলে নিজেদের নৌসীমায় যেকোনো ধরনের আক্রমণের হুমকি থেকে মুক্তি পায় আমেরিকা।
কৌশল পরিবর্তনের ফলে বড় বড় সব রণতরীর প্রয়োজনীয়তা কমে যায় তাদের। তার বদলে তারা মনযোগ দেয় আকারে ছোট, কিন্তু কার্যকরী রণতরী প্রস্তুতে। ফলে নিজেদের ব্যয় কমানোর পাশাপাশি, এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করাও সহজসাধ্য হয় তাদের নৌবাহিনীর কাছে।
মার্কিন নৌবাহিনীতে ১১টি বৃহৎ বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। যার প্রায় সবগুলো অত্যাধুনিক নিমিজ সিরিজের। এগুলো মূলত বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হয়। জাহাজগুলোর প্রতিটিতে ৭০-৮০ টি করে বিমান সহজেই জায়গা করে নিতে পারে। যা অনেক দেশের বিমান বাহিনীর চেয়েও বড় পরিসরের!
বিমানবাহী রণতরীগুলো যুদ্ধজাহাজের সহযোগী হিসেবে সহজেই মানিয়ে নেয় নিজেদের। তার সঙ্গে সাবমেরিন বিধ্বংসী সকল ব্যবস্থা মজুদ থাকে সবসময়। ফলে এই রণতরীগুলো যেকোনো দিক থেকে আসা সকল আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে।
তারপরও বাড়তি নিরাপত্তার জন্য ২২ টি টিকোনডেরোগা শ্রেণির মিসাইল ক্রুজার রয়েছে। এদের বিধ্বংসী ক্ষমতার বদৌলতে আমেরিকান নেভি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত বিমান-প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে।
বর্তমানে ৬৪টি আর্লি বার্ক শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার রয়েছে আমেরিকানদের কাছে। পরবর্তীতে আরও ৩টি জুমওয়াল্ট শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার যুক্ত করে হবে তাদের বহরে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে যেগুলো হবে সবচেয়ে আধুনিক এবং চরম বিধ্বংসী। এগুলো মূলত স্থল আক্রমণকে উদ্দেশ্য করে তৈরি করা হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক নৌবাহিনীর কাছে ফ্রিগেড থাকলেও, মার্কিন নৌবাহিনীতে কোনো ফ্রিগেড নেই। এগুলোর বদলে তারা বিশেষায়িত জাহাজ ব্যবহার করে। পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের সাহায্যে মার্কিন নৌবাহিনী বিশ্বের যেকোনো স্থানে দ্রুত আক্রমণ করতে পারে।
এই সাবমেরিনগুলো পুরো পৃথিবীব্যাপী নিয়মিত টহলের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে এ বাহিনীতে তিন লক্ষ বিশ হাজার সেনা রয়েছে, যারা এই বিশাল বহরটিকে দুর্ভেদ্য এক দেয়ালে পরিণত পরিণত করেছে!
২. রাশিয়া
আমেরিকার হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে, সোভিয়েত নৌবাহিনীও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। নাম বদলে সোভিয়েত নৌবাহিনী রাতারাতি রাশিয়ান নৌবাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তবে সোভিয়েত যুগে তাদের যে আকার আর সক্ষমতা ছিল, তার সঙ্গে বর্তমানের তেমন মিল নেই। তারপরও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবাহিনী হিসেবে টিকে রয়েছে রাশিয়ানরা। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সেনা, অসংখ্য যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনের কল্যাণে তারা নৌ-পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের গরিমা পৃথিবীর সামনে জানান দিচ্ছে।
রাশিয়ানদের বহরে একটিমাত্র বিমানবাহী রণতরী রয়েছে, যেটি আমেরিকানদের যেকোনো ক্যারিয়ারের চেয়ে দুর্বল। তাছাড়া রণতরীটি খুব বেশি সংখ্যক বিমান বহনেও সক্ষম নয়। প্রায়ই জাহাজটি দুর্ঘটনার কবলে পতিত হয়।
দুর্ঘটনার জন্য অবশ্য জাহাজটির দুর্বল নেভিগেশন-ব্যবস্থা দায়ী। তবে একমাত্র ক্যারিয়ারটি রাশিয়া এখনই হাতছাড়া করতে ইচ্ছুক নয়। খুব শীঘ্রই নতুন বিমানবাহী রণতরী বানানোরও পরিকল্পনা নেই তাদের।
ছোট-বড় মিলিয়ে রাশিয়ান নৌবহরে ৪টি মিসাইল ক্রুজার রয়েছে। যেগুলো একই সাথে জল, স্থল এবং আকাশপথের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। রাশিয়ান নৌবাহিনীতে বারো হাজারের মতো পদাতিক সৈন্য রয়েছে, যারা রপুচ-১ এবং রপুচ-২ সিরিজের উভচর রণতরীর দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। সবমিলিয়ে তাদের কাছে ২০টি উভচর জাহাজ রয়েছে।
অন্যান্য দিক থেকে কিছুটা দুর্বল হলেও, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের জন্য রাশিয়া এখনো অনন্য। আকুলা শ্রেণির পারমাণবিক বোটগুলো সাবমেরিন বহরের বড় একটা জায়গা দখল করে আছে। যেগুলো আমেরিকান নৌবহরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য তৈরি করা।
এছাড়াও ডিজেলচালিত টহল-সাবমেরিনও রয়েছে রাশিয়ানদের। বর্তমানে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র-ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ বাড়িয়ে চলেছে রাশিয়া। যা বর্তমানে আমেরিকার মাথাব্যথার অন্যতম কারণ!
৩. চীন
চীনা নৌবাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম 'পিপল্স্ লিবারেশন আর্মি নেভি'। নব্বইয়ের দশক থেকে রাশিয়া আর আমেরিকা যেখানে নিজেদের নৌবহর গুটিয়ে আনছে, চীন সেখানে বিপরীত আচরণ করছে! প্রতি মুহূর্তে তারা বিধ্বংসী সব যুদ্ধজাহাজ আর সাবমেরিন তৈরি করছে। চীনা নৌবাহিনীতে দুই লক্ষ ৫৫ হাজার সৈনিক রয়েছে, যা সংখ্যার দিক থেকে রাশিয়ার চেয়ে বেশি।
২০১৮ সালে চীন সর্বপ্রথম বিমানবাহী রণতরী তৈরি করে। যেটি মূলত প্রশিক্ষণের জন্য বানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে আরও একটি বিমানবাহী রণতরী নিজেদের বহরে সংযুক্ত করে তারা।
চীনের কাছে বর্তমানে ৬৮টি সাবমেরিন রয়েছে। যাদের ভেতর ৪ টি জিন শ্রেণির পারমাণবিক শক্তিচালিত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। সংখ্যার দিক থেকে বেশি হলেও চীনের তৈরি সাবমেরিনগুলো এতটা কার্যকরী নয় এখন পর্যন্ত। ফলে সাবমেরিন বহরকে উন্নত করতে হলে তাদের আরও বহুদূর যেতে হবে।
চীনা নৌবাহিনীতে মধ্যম ও অধিক দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম ৭০০-এর মতো বিমান রয়েছে। যেগুলো তাদের আকাশসীমা নিরাপদ রাখার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছে। সামুদ্রিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য যে এইস-৭ সিরিজের বিমান তাদের নৌবহরে বাড়তি নিরাপত্তা দিয়েছে।
তাছাড়া এইস-৬ সিরিজের ৩০টিরও বেশি স্বল্পপাল্লার বোমারু বিমান প্রয়োজনের মুহূর্তে বাড়তি সুবিধা দান করবে। আমেরিকার সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন চীনকে নৌসমরে এগিয়ে যেতে হলে নিজেদের সক্ষমতার দিকে আরও নজর বাড়াতে হবে।
৪. জাপান
সাবমেরিন তৈরির প্রতিযোগীতায় নাম লেখানো আরেকটি দেশের নাম জাপান। তবে তাদের নৌবাহিনী প্রথাগত নৌবাহিনীগুলোর চেয়ে ভিন্ন। মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্স (এমএসডিএফ) বাস্তবে কোনো সামরিক বাহিনীর কাতারে পড়ে না! কারণ এখানকার সৈনিকরা মূলত নাবিক নয়, তারা বেসামরিক কর্মচারী! কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার, শৃঙ্খলা আর মানসিকতার দিক থেকে তারা সেরাদের কাতারে উঠে এসেছে।
জাপানী নৌবাহিনীর ১১৪ টি জাহাজ এবং ৪৫ হাজারের মতো কর্মী রয়েছে। জাপানী নৌবাহিনীর মূল শক্তি তাদের ডেস্ট্রয়ারগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেদের ভুল শুধরে নিতে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। মূলত উত্তর কোরিয়াকে জাপান বর্তমানে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। ফলে তাদের আক্রমণ ঠেকাতে সম্ভাব্য সবরকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজিয়েছে তারা।
জাপানের কাছে একটি উভচর জাহাজ রয়েছে, যা ৩টি ট্যাঙ্ক এবং ৩০০ জন পদাতিক সৈনিক পরিবহণে সক্ষম। নাগাসাকিতে অবস্থিত নৌ ঘাঁটি থেকে তাদের হেলিকপ্টারগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রয়োজনের মুহূর্তে পরিবহণ হেলিকপ্টারগুলো পর্যাপ্ত রসদ যোগান দেয়। আর এপাচি হেলিকপ্টারগুলো আকাশ থেকে তাদের নৌবাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
তাছাড়া জলের তলায় ১৬টি সাবমেরিন মোতায়েন করেছে তারা। যেগুলো সোরিউ সিরিজের সর্বশেষ সংস্করণে তৈরি। রাশিয়া কিংবা চীনের চেয়ে জাপানের সাবমেরিনগুলো বেশি সময় ধরে জলের তলে থাকতে পারে। ফলে এদিক থেকে জাপানের নৌবাহিনী বেশি সুবিধা ভোগ করবে। নৌবাহিনীতে আরও ২২ টি নতুন সাবমেরিন যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে জাপান সরকার। যার মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতিতে জাপান নীরবে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।
৫. যুক্তরাজ্য
ব্রিটিশদের পানিতে পা রাখার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। নিজেদের ঐতিহ্য ছেড়ে তারা বর্তমানে বাহিনীতে কাটছাঁটের চিন্তাভাবনা করছে। বিপরীত চিত্র দেখা যায় নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর বেলায়। ফলে সুসংঘটিত একটি চৌকস বাহিনী গড়ে তোলাই তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ।
সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর দুটি বিমানবাহী রণতরীকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তার সঙ্গে নৌবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বিমানের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে পারমাণবিক সক্ষমতার অসংখ্য সাবমেরিন তাদের বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে তারা।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ৩৩ হাজার সৈনিক রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে ৩টি উভচর জাহাজ, ১৯টি ফ্রিগেড এবং ডেস্ট্রয়ার, ৭টি পারমাণবিক আক্রমণযোগ্য সাবমেরিন এবং ৪টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রযুক্ত সাবমেরিন রয়েছে। রয়্যাল নেভির কাছে বর্তমানে ১৪৯টি হেলিকপ্টার আছে।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভূমিতে আক্রমণযোগ্য গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারগুলো। উন্নত রাডার ব্যবস্থার কারণে এরা ভূমিতে কিংবা আকাশপথের যেকোনো দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তাছাড়া ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা পারমাণবিক হামলার দিকে জোর দিচ্ছে। পুরনো সাবমেরিনের বদলে সেখানে দখল করে নিচ্ছে প্রতাপশালী সব ডুবো জলযান।
ভবিষ্যতে বিমান বহনে সক্ষম জাহাজের সংখ্যা বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বিমানবাহী রণতরী পানিতে ভাসানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যেগুলো পরিবহণ-হেলিকপ্টারসহ যথেষ্ট বোমারু-বিমান বহন করতে পারবে। আধিপত্য তৈরির খেলায় ব্রিটিশরা এভাবেই নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
This is a Bengali article. It is about top 5 Navy in the world.
Necessary references are hyperlinked in the article.
Featured Image: CG Mag Online