Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতে সমাজকর্মীদের ধরপাকড়: সাধারণ মানুষ এত নির্বিকার কেন?

গত ২৮ আগস্ট, সারা ভারতজুড়ে এক বেনজির ঘটনা ঘটল। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘হত্যা করার ছক’-এর সঙ্গে যোগের সন্দেহে পাঁচটি রাজ্য থেকে বিভিন্ন খ্যাতনামা সমাজকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। আরও অনেকের বাড়িতে তল্লাশিও চালানি হয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। মনে করা হচ্ছে সত্তরের দশকের সেই জরুরি সময় যেন ফের ফিরে এসেছে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন সরকারি এই পদক্ষেপকে। বলেছেন, মহাত্মা গান্ধী আজ বেঁচে থাকলে নিজেই গায়ে উকিলের উর্দি উঠিয়ে এই গ্রেফতার হওয়া সমাজকর্মীদের হয়ে আদালতে সওয়াল তুলতেন। গুহ এও বলেছেন যে, আজ মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকলে তাকেও জেলে পুরে ফেলত সরকার।

২০১৬ এবং ২০১৭ সালে ‘মোদী হত্যার ছক’ নিয়ে প্রেরিত দু’টি চিঠির প্রেক্ষিতে এই রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বলে জানা গিয়েছে। যদিও প্রশ্ন উঠেছে এতদিন পরে কেন এই তৎপরতা, কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট তথ্যের উপরে ভিত্তি করে তারা এগোচ্ছেন। চিঠিগুলি কর্তৃপক্ষের হাতে আসে গত এপ্রিল মাসে মহারাষ্ট্র রাজ্যের গাচিরোলিতে একটি নকশাল-বিরোধী অভিযানের সময়ে।

বামপন্থী সমাজকর্মী ভারাভারা রাও (মাঝখানে); Source: Twitter Shailendra Pandey @shailfilm

সাধারণ মানুষ আজ মুখ ঘুরিয়ে থাকে?

প্রবল বিতর্কিত এই ঘটনাটিতে আইনি-নৈতিক তর্কাতর্কি চলবে-চলুক, কিন্তু অন্য একটি ব্যাপার আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে। আর তা হলো সাধারণ মানুষের নিস্পৃহতা।

আমাদের চারপাশে কী ঘটছে না ঘটছে সেই বিষয়ে আজকাল খুব মানুষকেই গঠনমূলক চর্চা করতে দেখি। ভালো বা খারাপ-এর মতো সাদা-কালোতে বিচার ছাড়া কাউকেই কোনও ঘটনার গভীরে প্রবেশ করতে দেখা যায় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশের সমাজজীবনে এই প্রবণতা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

সমাজকর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনাটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। যেখানে নির্ভীক সাংবাদিক বা যুক্তিবাদী চিন্তাবিদদের নিমেষে হত্যা করা হচ্ছে অথচ ধরা পড়ছে না কেউই, যেখানে পুরোনো বেনামী চিঠির উপরে ভিত্তি করে আচমকা ধরপাকড় শুরু হয়ে যাচ্ছে সুশীল সমাজের সদস্যদের বিরুদ্ধে, সেখানে কেন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ প্রভাব দেখা যায় না? তারা কি সত্যিই সমস্যার ভয়াবহতা বুঝতে অপারগ নাকি তারা এই নিয়ে ভাবিতই নয়?

রাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছেন মানবাধিকার কর্মী সুধা ভরদ্বাজও; Source: Twitter Aruna Chandrasekhar @ @aruna_sekhar

এই নির্বিকার থাকার সমস্যা আজ শুধু ভারতের নয়। পশ্চিমেও দেখা যাচ্ছে এই একই প্রবণতা। মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান বা ব্রিটেনে ব্রেক্সিট-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ মানুষের চর্চার সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ার মতো। তারা হয় হুজুগে মাতছে আর নয়তো গুরুতর সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাদের সচেতনতার চূড়ান্ত দৈন্যদশা। শুধুমাত্র ভালো-খারাপের বিতর্কের মধ্যেই তাদের মতামত সীমিত।

ভারতে এই সমাজকর্মীদের গ্রেফতার এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ। যদি রাজনৈতিকের ক্ষমতার আস্ফালনই গণতন্ত্রের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। মঙ্গলবার গ্রেফতার হওয়া সমাজকর্মীদের অনেকেই অনেক প্রান্তিক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তাদেরকে আইনের চোখে ছোট করা মানে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরটিই সংকুচিত হওয়া।

মেধাসম্পন্ন চর্চা আজ কই?

একপেশে শাসন ব্যবস্থা যখন চলতে থাকে, তখন তার প্রতিশক্তি হিসেবে উঠে আসতে হয় নাগরিক সমাজকেই। মেধাসম্পন্ন চর্চা-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে তুলে আনতে হয় বিকল্প ভাবনাচিন্তাকে। কিন্তু আজকের সমাজব্যবস্থায় সেই প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে কোথায়? মানুষ এখন পপুলিস্ট নেতাদেরকেই জগৎশ্রেষ্ঠ মনে করে তাদের করতলে নিজ প্রাণটি উৎসর্গ করতে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে কোনো বিশ্লেষণ নেই, গভীরে খতিয়ে দেখার ইচ্ছা নেই। শুধু নির্বাচনের সময়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দিয়ে সেলফি তুলে আত্ম-জাহির করেই তারা গর্বিত।

গ্রেফতারের ঘটনার পরে একদিকে যেমন সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে এই ধরপাকড় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে প্রভাব চোখে পড়ল না, পাশাপাশি, অনেককে দেখা গেল নরেন্দ্র মোদী সরকারেরই গুণগান গাইতে। “নকশালগুলোকে জেলে পুরে ঠিকই করেছে সরকার,” ধরনের মন্তব্য হলো দেদার। এই অসহিষ্ণুতা এবং ঘৃণার কারণ কী?

উপভোক্তার সমাজ, গভীরতার অভাব

আসলে উপভোক্তার সমাজ তৈরি হলে বোধহয় এমনই হয়। আজকের ভারতে যে নগরকেন্দ্রিক, শিক্ষিত অথচ আত্মকেন্দ্রিক, টেকনোলজি-নির্ভর অথচ চিন্তাভাবনাহীন এক ধনবান শ্রেণী তৈরি হয়েছে, এরাই দেশের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন এবং এদের চোখে একা এক মোদীই যথেষ্ট দেশের অগ্রগতির জন্যে। দুনিয়াতে আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশের যে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ আজও অন্ধকারে ডুবে রয়েছে; যাদের কাছে একবিংশ শতাব্দীর আলো এখনও পৌঁছয়নি; তাদের জন্যেও যে কাউকে লড়তে হবে, সেই উপলব্ধি আজকের বেশিরভাগ শহুরে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে চোখে পড়ে না। পক্ষপাতী সংবাদমাধ্যম নিমেষে তাদের মতামতও তৈরি করে দিচ্ছে; চিন্তার দিশাই গুলিয়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সংখ্যাগুরুবাদীদের যে পোয়াবারো, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। তারা জানে যে নির্বাচনে জয়টাই আজকের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেষ কথা। তার বাইরেও যে গণতন্ত্রের এক বড় ভূমিকা এবং আদর্শ রয়েছে; বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দেওয়ার এক বড় দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়ে আজকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া আর বিশেষ কাউকে বলতে শোনা যায় না। আর সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনও যখন রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে।

গুজরাটের আহমেদাবাদে গান্ধী আশ্রমে রাজনীতিবিদ জিজ্ঞেস মেভানির সঙ্গে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ; দেশজুড়ে বিদ্বজ্জনদের ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন গুহ; Source; Twitter handle of Jignesh Mevani @jigneshmevani80

আমাদের বহু কষ্টার্জিত গণতন্ত্র যেন উপভোক্তার প্রহসনতন্ত্রে না বদলে যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের কাঁধেই।

আজকে প্রয়োজন কি তবে এপিস্টোক্র্যাসির?

এই পর্যায়ে খুবই প্রাসঙ্গিক এপিস্টোক্র্যাসির কথা। এপিস্টোক্র্যাসি, অর্থাৎ ‘জ্ঞানীজনের শাসন’। আজকের দিনে কথাটি সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও আদতে এই নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাই গণতন্ত্রের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারে। প্রখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক জেসন ব্রেনান গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে ‘এপিস্টোক্র্যাসি’-র সন্ধান দিয়ে বলেছেন যে রাজনীতি বা নির্বাচনী রাজনীতিতে যদি আম ভোটার আরও বেশি জ্ঞানী হয়, তাহলে তারা আরও বেশি বিবেচকের মত তাদের নাগরিকত্বের ব্যবহার করতে পারে। সার্বিকভাবে তাদের বিচার-বুদ্ধি-সিদ্ধান্তে পক্ষপাতিত্বের রেশ কম থাকবে। আর তাতে সুফল পাবে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা।

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত বিমসটেক-এর শীর্ষসম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Twitter handle of Narendra Modi @narendramodi

রাতারাতি গণতন্ত্রে বদলে তার জায়গায় এক জ্ঞানীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়, বোধহয় অসম্ভবও বটে। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাটাই বদলে দেওয়ার পরিবর্তে আমরা যদি একটু একটু করেও তার মধ্যে বসবাস করা সদস্যদের সচেতন করে তোলার চেষ্টা করি এবং সচেতন হওয়ারও সদিচ্ছা দেখাই, তাহলে হয়তো গণতন্ত্রের নুইয়ে পড়া কাঁধ অনেকটাই চাঙ্গা হবে।

প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন আজ এটাই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা আনা, যাতে তারা শাসকের পরিকল্পনামাফিক কাজে না বুঝেই সিলমোহর দিয়ে দেয়। অচেতন বা অবচেতন মনে গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে কোনো কার্যকরী অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। সেটা আমরা আর কবে বুঝব?

Featured Image Source: Washington Post

Related Articles