Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইয়েমেনের শিশুদের রক্ত শুধু সৌদি-আমিরাতের হাতে না, আমেরিকার হাতেও

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ জুড়েই অস্থিরতা চলছে, কিন্তু ইয়েমেনের পরিস্থিতি অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি খারাপ। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে চলা ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে অন্তত ১৬ হাজার বেসামরিক মানুষ, আহত হয়েছে আরো প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। সেভ দ্য চিলড্রেনের সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী, যুদ্ধ এবং অবরোধের কারণে এই মুহূর্তে ইয়েমেনে প্রায় পঞ্চাশ লাখ শিশু অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এছাড়াও আরও প্রায় চুরাশি লাখ মানুষ সেখানে অপুষ্টির শিকার। জাতিসংঘের মতে তাই সিরিয়া না, বরং ইয়েমেনেই বিশ্বের সবচেয়ে করুণ মানবিক বিপর্যয় বিরাজ করছে।

শুধু মানুষের মৃত্যু না, একের পর এক বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ইয়েমেনের প্রায় সব ধরনের সেবামূলক ব্যবস্থা। আর এই বিমান হামলাগুলোর প্রায় সবগুলোই পরিচালনা করেছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী। যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাহিনীটি ইয়েমেনে প্রায় ১৬,০০০ বিমান হামলা চালিয়েছে। শুধুমাত্র গত জুলাই মাসেই সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের বিমানগুলো ইয়েমেনে ২৭৭টি বিমান হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৪৩ শতাংশ হামলাই হয়েছে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর।

যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই কম-বেশি দোষ থাকে। ইয়েমেনের যুদ্ধেও জাতিসংঘের তদন্তে উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হুথি বিদ্রোহীদের মিসাইল আক্রমণেও সেখানে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের বিমান হামলায় বেসামরিক জনগণের মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির অনুপাত বিদ্রোহীদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। শুধুমাত্র গত আগস্টেই একটি স্কুল বাসের উপর সৌদি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল মোট ৫১ জন, যাদের মধ্যে ৪০ জন ছিল স্কুল ছাত্র। এর আগে গত এপ্রিলে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল ২১ জন, যাদের মধ্যে ১১ জনই ছিল শিশু। আহত হয়েছিল আরো ৯৭ জন, যাদের মধ্যে ৪৮ জনই ছিল শিশু। এবং এই প্রতিটি হামলার মিসাইলগুলো এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে সরাসরি কোনো যুদ্ধে জড়িত নেই। মার্কিন কংগ্রেস ইয়েমেনে কোনো যুদ্ধের অনুমোদন দেয়নি। অধিকাংশ আমেরিকান জানেই না যে, ইয়েমেন যুদ্ধে আমেরিকা কোনোভাবে জড়িত আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের বিমান হামলায় নিহত অধিকাংশ বেসামরিক মানুষের রক্তের দাগ শুধু সৌদি আরব, আরব আমিরাত কিংবা জোটের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য সুন্নী রাষ্ট্রের হাতেই না, যুক্তরাষ্ট্রের হাতেও লেগে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে, তাদের প্রশিক্ষণে, তাদের দেওয়া অস্ত্র দিয়েই সৌদি জোট হত্যা করছে ইয়েমেনের শিশুদেরকে। সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে এবং তাদের যুদ্ধ বিমানগুলোকে আকাশে জ্বালানি ভরতে সহায়তা করছে, যেন তারা দীর্ঘক্ষণ ইয়েমেনের আকাশে অবস্থান করতে পারে।

ইয়েমেনে বেসামরিক জনগণের উপর বিমান আক্রমণে মার্কিন ক্ষেপনাস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি গণমাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএনের তদন্তের ফলে। গত আগস্টের ৯ তারিখে ইয়েমেনের একটি স্কুলবাসের উপর বিমান হামলায় ৪০ জন শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর স্থানীয় সংবাদকর্মী এবং অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সিএনএনের অনুসন্ধানী টিম দেখতে পায়, ঐ হামলায় ২২৭ কেজি ওজনের যে মিসাইলটি ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটি ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ লকহিড মার্টিন নামক অস্ত্র উৎপাদন কোম্পানীর নির্মিত লেজার গাইডেড এমকে-৮২ বোমা।

সিএনএনের রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর মু’আতানা নামে ইয়েমেন ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা তাদের সাথে যোগাযোগ করে। মু’আতানা সংস্থাটি যুদ্ধে জড়িত উভয়পক্ষ কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের উপর কাজ করে থাকে। তাদের কাজের জন্য তারা আগে থেকেই পরিচিত। গত বছর তারা হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট নামে একটি মার্কিন সংস্থার কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছিল। সংস্থাটি ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর সৌদি কোয়ালিশনের বিমান হামলার ঘটনাস্থল থেকে মিসাইলগুলোর টুকরো এবং সেগুলোর ছবি সংগ্রহ করে আসছিল। সম্প্রতি সেই ছবিগুলো তারা সিএনএনের কাছে হস্তান্তর করে।

সিএনএনের তদন্ত টিম ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করে। তারা ছবিগুলোর মেটাডাটার সাথে ঐ সময়ে সংঘটিত হামলাগুলোর ঘটনা মিলিয়ে সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করে। এবং তারা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একটি অস্ত্র বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মিসাইলগুলোর ছবি এবং সিরিয়াল নাম্বার থেকে সেগুলোর উৎসের সন্ধান বের করে। তাদের তদন্তে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্ত্রগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ খ্যাতনামা বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নির্মিত অস্ত্র। মু’আতানার চেয়ারপার্সন রাদিয়া আল-মুতাওয়াকেল সিএনএন এর সাথে সাক্ষাৎকারে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে বলেন, প্রতিদিন ইয়েমেনের শিশুরা মারা যাচ্ছে, কারণ আমেরিকা এই যুদ্ধে রসদ যোগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র যদিও ইয়েমেন যুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থানকে মার্কিন নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্নভাবে যৌক্তিক বলে প্রমাণের চেষ্টা করে, কিন্তু তারা যে মূলত অস্ত্র ব্যবসার কারণেই এই যুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে আসছে, তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় গত বৃহস্পতিবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। গোপন মেমো এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন, কারণ তা না হলে দেশটির কাছে ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রয়ের সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ মাসের শুরুর দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততার ভবিষ্যত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চেয়েছিলেন, কারণ কংগ্রেস থেকে এই যুদ্ধে সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে চাপ আসছিল। অধিকাংশ মধ্যপ্রাচ্য এবং সামরিক বিশেষজ্ঞই যুদ্ধে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এদের মধ্যে ইউএস এইড পরিষ্কারভাবেই যুদ্ধে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ অ্যাফেয়ার্স টিম যখন পম্পেওকে জানায় যে, সহায়তা কিংবা সমর্থন বন্ধ করলে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের কাছে ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১ লাখ ২০ হাজার প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল বিক্রয়ের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যেতে পারে, তখন পম্পেও তাদের পক্ষেই অবস্থান নেন।

দেশে দেশে যুদ্ধ সব সময়ই ছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধে যখন সামরিক বাহিনী এবং সামরিক ঘাঁটির বাইরে গিয়ে নির্বিচারে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা করা হয়, তখন জেনেভা কনভেনশন, মানবাধিকার, এসবের কোনো অর্থ থাকে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের অযুহাতে একের পর এক দেশ আক্রমণ করতে পিছপা হয় না। কিন্তু অন্যদিকে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের মানবতা বিরোধী যুদ্ধে শুধু সমর্থনই দিয়ে যায় না, বরং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করে। মু’আতানার চেয়ারপার্সন রাদিয়া আল-মুতাওয়াকেল যথার্থই বলেছেন, আমেরিকার কাছে নিরাপরাধ মানুষের রক্তের চেয়ে আর্থিক স্বার্থের গুরুত্ব অনেক বেশি।

ফিচার ইমেজ- Mohammed Huwais/AFP/Getty Images

Related Articles