Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিসরীয় চলচ্চিত্র ইশতেবাক: ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের সার্থক চিত্রায়ণ

২০১১ সালে আরব বসন্তের সবচেয়ে সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল মিসরের তাহরির স্কয়ারে, যেখানে লাখো জনতা ৩০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক হুসনি মোবারকের পতনের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। সে সময় সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মোবারককে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। মোবারকের পতনের পর ২০১২ সালে মিসরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সেনা সমর্থিত প্রার্থীকে সামান্য ব্যবধানে হারিয়ে জয়লাভ করে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড তথা এখুয়ানুল মুসলেমিন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোহাম্মদ মুরসি

ক্লাশ চলচ্চিত্রের পোস্টার; Source: IMDB

কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি দেশ চালাতে পারেননি। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান খুবই সামান্য ছিল। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের পক্ষে যত মানুষ ছিল, তার বিপক্ষেও প্রায় সমান সংখ্যক মানুষই ছিল। ক্ষমতা গ্রহণের অল্পদিন পরেই তারা তার বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তাহরির স্কয়ার।

২০১৩ সালে মুরসির ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ৩০ জুন মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আর এ সুযোগে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। মিসরের রাজপথে শুরু হয় ভয়াবহ সংঘর্ষ। একদিকে পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা, অন্যদিকে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থকরা।

ক্লাশ-এর বিকল্প পোস্টারসমূহ; Source: IMDB

এই উত্তাল সময়ের কাহিনী নিয়েই নির্মিত হয়েছে মিসরীয় পলিটিকাল থ্রিলার ফিল্ম ‘ইশতেবাক‘ তথা ‘ক্লাশ’ (Clash)। ২০১৬ সালে নির্মিত এই সিনেমাটির পরিচালক মোহাম্মদ দিয়াব। এটি মোহাম্মদ দিয়াব পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। এর আগে তিনি ‘কায়রো ৬৭৮’ নামে মিসরের নারীদের উপর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছিলেন, যেটি নিয়ে রোর বাংলায় একটি রিভিউ রয়েছে। এই চলচ্চিত্রেও পরিচালক অত্যন্ত সফলভাবে মিসরের সংঘাতময় রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

চলচ্চিত্রটির বৈশিষ্ট্য

ছেলের মুক্তির জন্য সেনাবাহিনীর সাথে তর্ক করছে এক প্রতিবাদকারী; Source: IMDB

ক্লাশ চলচ্চিত্রটির ব্যাপ্তিকাল বেশি না, মাত্র দেড় ঘণ্টা। এই দেড় ঘণ্টার পুরোটাই অতিবাহিত হয় মাত্র ৮ বর্গ মিটারের একটি প্রিজন ভ্যানের ভেতরে। পুরো সময়ে ক্যামেরা একবারের জন্যও ভ্যানের বাইরে যায় না। ভ্যানের ভেতরে থাকা বন্দীরা এবং ঠিক বাইরে থাকা সেনাসদস্যরাই এর প্রধান চরিত্র। ভেতরের বিপরীত মতের বন্দীদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, তাদের উপর সেনা অফিসারদের নির্যাতন, জলকামান থেকে পানি নিক্ষেপ, বাইরের রাজপথের আন্দোলনকারীদের সাথে সেনাবাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ- এসবের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় পুরো সময়টা।

বাইরের রাজপথের দৃশ্যগুলোও ধারণ করা হয় ক্যামেরাটিকে ভ্যানের ভেতরে রেখেই। ভেতরের বন্দীদের মতোই দর্শকরাও ভ্যানের জানালা দিয়েই দৃশ্যগুলো দেখতে বাধ্য হন। কম্পমান ক্যামেরা, অসাধারণ বাস্তবসম্মত সাউন্ড ইফেক্ট, বাস্তবের মিসরীয়দের মতোই প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি, সব মিলিয়ে পরিচালক এমন এক পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, দর্শকের কাছে মনে হবে যেন তারা নিজেরাই বুঝি কায়রোর রাজপথে সংঘর্ষের স্থলে উপস্থিত আছেন। সিনেমার পুরো সময়টাতেই দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন।

কাহিনী সংক্ষেপ

ভ্যানের বাইরে অবস্থিত সেনাসমর্থকরা; Source: IMDB

সিনেমা শুরু হয় দুই সাংবাদিকের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। তাদেরকে ভ্যানে ওঠানোর পরপরই পাশ দিয়ে যেতে থাকা সেনাবাহিনীর পক্ষের একদল মিছিলকারী তাদেরকে মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী সাংবাদিক মনে করে তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আর্মির ভ্যানে পাথর নিক্ষেপ করায় সেনাবাহিনী তাদেরকে ব্রাদারহুড মনে করে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে। তাদের স্থানও হয় ভ্যানের ভেতরে।

এর কিছুক্ষণ পরেই ভ্যানের সামনের রাস্তায় শুরু হয় ব্রাদারহুড সমর্থকদের সাথে আর্মির সংঘর্ষ। আর্মি বেশ কিছু ব্রাদারহুড সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ভ্যানে তুলে দেয়। আর সাথে সাথে সেনাসমর্থকরা নিজেরাই ব্রাদারহুড সদস্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, মারধর করে তাদেরকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে। এক উগ্র সেনাসমর্থক মুখের কোণে থাকা ব্লেড দিয়ে এক ব্রাদারহুড সদস্যের কপালে আঘাত করে। সংঘর্ষ থামাতে না পেরে আর্মি ভ্যানের ভেতর জলকামান দিয়ে পানি নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।

পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু সিনেমার পুরো সময় জুড়েই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা চলতে থাকে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের মধ্য দিয়ে মোবারক পরবর্তী মিসরের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজনটাই প্রকট হয়ে ফুটে উঠতে থাকে।

চলচ্চিত্রে মিসরের সমাজের বাস্তবতা

ভ্যানের ভেতরে অবস্থিত ব্রাদারহুড সদস্যরা; Source: Cannes Film Festival

মোহাম্মদ দিয়াব এর আগেও তার ‘কায়রো ৬৭৮’ চলচ্চিত্রে একই ধরনের পরিস্থিতিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন। ক্লাশ চলচ্চিত্রেও তিনি সে ধারাই বজায় রেখেছেন। ছোট একটি ভ্যানে উঠে সমাজের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী থেকে গৃহহীন পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এদের মধ্যে দুজন নারী এবং একজন বালকও আছে। দুই নারী চরিত্রের একটি হলো নাজুয়া। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন নেলি করিম, যিনি ‘কায়রো ৬৭৮’ চলচ্চিত্রে শিবা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

চলচ্চিত্রে মোটের উপর মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্যদেরকে তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত, সচেতন এবং স্বভাবতই সুসংগঠিত হিসেবে দেখানো হয়েছে। বন্দী অবস্থায়ও তারা একত্রিত হয়ে নিজেদের সাংগঠনিক পরিচয় বিনিময় করে এবং নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অপেক্ষাকৃত উচ্চপদস্থ সদস্যকে নিজেদের নেতা নির্বাচিত করে। তাদের মনোভাব, তারা ইসলামের অস্তিত্বের জন্য লড়ছে। আর সে কারণেই তাদের নৈতিক মনোবল অত্যন্ত সুদৃঢ়।

ভ্যানের ভেতরে জলকামান থেকে পানি নিক্ষেপ; Source: IMDB

বিশেষ করে দ্বিতীয় যে নারী চরিত্রটি আছে, অল্পবয়সী তরুণী আয়েশা, সে আপাদমস্তক হিজাবে আবৃত। তার চরিত্রটি অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। সে নিজেই তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে মিছিলে এসেছিল। সেনাসদস্যদের আচরণের বিরুদ্ধে তাকে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। সংগঠনের কার্যক্রমেও তাকে জোরালোভাবে সমর্থন দিতে দেখা যায়।

সে তুলনায় সেনা সমর্থকদের মধ্যে নাজুয়া চরিত্রটি ছাড়া আর কাউকেই সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি মনে হয়নি। এদের মধ্যে খুব কমই আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মিছিলে এসেছে। কেউ কেউ ব্যক্তিগত ক্ষোভ এবং ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মিছিলে এসে আটকা পড়েছে। তবে তাদের কথপোকথন থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তারা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে এবং সাংবাদিকদেরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে।

ভ্যানের ভেতরে-বাইরে সংঘর্ষ; Source: pyramidefilms.com

মিসরের সমাজে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনীর সমর্থকদের মধ্যকার পারস্পরিক বিভাজন এবং ঘৃণা কোন পর্যায়ে গেছে, সেটা আয়েশার সাথে নাজুয়ার ছেলে ফারেসের একটি কথপোকথনের মধ্য দিয়ে পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠে। ফারেস আয়েশাকে বলে যে, তারা স্কুলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এখুয়ান আর আসকারি (আর্মি) খেলা খেলে। সেখানে তারা এখুয়ানদেরকে ধরতে পারলে তাদেরকে ফাঁসি দেয়। উত্তরে আয়েশা জানায়, তারাও স্কুলে একই খেলা খেলে। আর তারা আর্মিকে ধরতে পারলে জবাই করে হত্যা করে!

তবে বাস্তব জীবনের মতোই সিনেমাতেও দুই দলের দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী হয় না। বিভিন্ন প্রয়োজনে সময়ে সময়ে সবাই একত্রিত হয়ে যায়। সময় কাটানোর জন্য ফুটবল এবং সঙ্গীতের আলোচনা শুরু হলে সবাই তাতে অংশ নেয়। নাজুয়া যখন এক বোতল পানি সংগ্রহ করতে পারে, তখন সবাই সেটা ভাগাভাগি করে পান করে। এমনকি নাজুয়ার স্বামী ব্রাদারহুড বিরোধী হয়েও নিজে না খেয়ে তার পাশে থাকা ব্রাদারহুডের কর্মী আয়েশার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়।

ভ্যানের জানালা দিয়ে পাশের ভ্যানে বন্দীদের সাথে কথা বলছে ব্রাদারহুড সদস্যরা; Source: Cannes Film Festival

সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্য দেখা যায় তখন, যখন আয়েশার টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেনা কর্মকর্তারা অনুমতি দেয় না, সেসময় দলমত ভুলে ভ্যানের ভেতরের সবাই একসাথে প্রতিবাদ শুরু করে। এমনকি উপরস্থ অফিসারের নির্দেশ অমান্য করে একজন সেনা সদস্যও তাদের সাথে যোগ দেয়। পরিচালক সম্ভবত এ বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, আমাদের মধ্যকার সকল বিভাজনই আসলে কৃত্রিম। তীব্র প্রয়োজনের সময় সেসব বিভাজন দূর হয়ে মানবতাই মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে।

প্রশংসা এবং অর্জন

ক্লাশ চলচ্চিত্রটি সমালোচকরা বেশ পছন্দ করেছেন। রটেন টম্যাটোজ ওয়েবসাইটে সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি ৯৩% ফ্রেশ চলচ্চিত্র। এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডেটাবেজ, IMDB-তে দর্শকদের ভোটে এটি 7.8 রেটিং অর্জন করেছে।

কায়রোর রাজপথে ব্রাদারহুড সমর্থকদের সাথে আর্মির সংঘর্ষ; Source: zff.hr

সিনেমাটিকে মিসর থেকে অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানো হলেও এটি অবশ্য মনোনয়ন পায়নি। তবে এটি কান সহ বেশ কিছু সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং প্রশংসা অর্জন করে। এছাড়া কেরালা সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে এটি বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করে।

ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার সহ প্রায় সবগুলো পত্রিকা সিনেমাটির প্রশংসা করেছে এই বলে যে, এটি কারও পক্ষ না নিয়ে, নিরপেক্ষভাবে মিসরের সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পেরেছে। অস্কারজয়ী অভিনেতা টম হ্যাংকস সিনেমাটি সম্পর্কে বলেছেন,

“আপনার যদি মিসরীয় পরিচালক মোহাম্মদ দিয়াবের ক্লাশ চলচ্চিত্রটি দেখার কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে আপনার দেখা উচিত। অবশ্যই দেখা উচিত।”

ফিচার ইমেজ- pyramidefilms.com

Related Articles